‘দর্জি’ মনির চার দিনের রিমান্ডে
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও চাঁদাবাজির মামলায় ‘বাংলাদেশ জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদ’ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মনির খান ওরফে ‘দর্জি’ মনিরের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। আজ বুধবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ধীমান চন্দ্র মণ্ডল এ আদেশ দেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের পুলিশ পরিদর্শক মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম আজ ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে (সিএমএম) ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে আবেদন করেন। অপরদিকে, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রিমান্ডের জোর দাবি জানান। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ধীমান চন্দ্র মণ্ডলের আদালত রিমান্ডের এ আদেশ দেন।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) তাপস কুমার পাল এনটিভি অনলাইনকে নিশ্চিত করেছেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে দর্জি মনিরের বিরুদ্ধে গতকাল কামরাঙ্গীরচর থানায় মামলা করেন ইসমাইল হোসেন নামের এক ব্যক্তি। গত রোববার রাতে আটক মনিরকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
এজাহারে বাদী ইসমাইল হোসেন বলেন, আসামি মনিরকে আমি ১৫ বছর ধরে চিনি। তিনি একটি ছোট দর্জির দোকানে চাকরি করতেন। হঠাৎ তিনি নিজেকে রাজনৈতিক বড় নেতা পরিচয় দেওয়া শুরু করেন। তিনি একেক সময় একেক রাজনৈতিক পরিচয়সহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে পরিচয় দিতেন।
এ ছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি-প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক ও স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ছাড়াও আরও অনেক মন্ত্রী-এমপির সঙ্গে নিজের ছবি কম্পিউটার সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে এডিট করে বসিয়ে নিজেকে ‘বাংলাদেশ জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদ’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি দাবি করতেন।
বাদী অভিযোগ করেন, এসব পদ ব্যবহার করে ঢাকা মহানগরী এবং বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় কমিটি দেওয়ার নাম করে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদা দাবি করতেন মনির। গত ৩০ জুলাই কামরাঙ্গীরচর থানা এলাকার মাদবর বাজার এলাকার ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের এক জানাজায় বাদীকে তাঁর সংগঠনের পদ এবং বিভিন্ন বড় বড় নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক করিয়ে দেওয়ার নাম করে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন তিনি।
ইসমাইল হোসেন এজাহারে দাবি করেন, আসামি ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে ছবি এডিট করতেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে নিজের ছবি বসিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিথ্যা তথ্য প্রচার করে সাধারণ মানুষকে ঠকানোর উদ্দেশে বিশ্বাস স্থাপন করতেন। এ ছাড়া আসামি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যবহার করে নিজেকে ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য প্রার্থী হিসেবে প্রচার করে এলাকায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সৃষ্টি করেন। যার ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়।
গতকাল রাতে কামরাঙ্গীরচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মুস্তাফিজুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ইসমাইল হোসেন নামের এক ব্যক্তি দর্জি মনিরের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও চাঁদাবাজির অভিযোগে মামলা করেছেন। মামলা নম্বর চার।’
মামলায় কী অভিযোগ করা হয়েছে জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘দর্জি মনির ভুঁইফোঁড় সংগঠনের প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ছবি এডিট করে জোড়া দিয়ে তা নিয়েও ভুয়া প্রচার চালিয়ে নিজেকে জাহির করেছেন। এ ছাড়া তিনি ভুয়া সংগঠনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে চাঁদাবাজি করেছেন বলেও মামলার বাদী ইসলাইল হোসেনের দাবি। মামলার এজারের তিনি এসব অভিযোগ এনেছেন।’
গত রোববার রাতে ‘দর্জি’ মনিরকে আটক করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। ডিবির যুগ্ম কমিশনার মো. হারুন অর রশীদ এ তথ্য নিশ্চিত করে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, “দর্জি মনির এখন ডিবির হেফাজতে আছেন। তিনি তো একটা টাউট লোক। আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের অনুমতি ছাড়া তিনি একটি দোকান (সংগঠন) খুলেছেন। সংগঠনটির নাম হচ্ছে ‘বাংলাদেশ জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদ’। এই সংগঠনের নাম দিয়ে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন লোককে কমিটিতে নেওয়া ও বাদ দেওয়ার কাজ করেছেন। শুধু এটা না, তিনি আরও ১০-১৫টি সংগঠন খুলেছেন। তিনি অটিজমের চেয়ারম্যান, রূপসী বাংলার চেয়ারম্যান, ওমুকের চেয়ারম্যান, তমুকের চেয়ারম্যান, হাজারও চেয়ারম্যান; কিন্তু কোনোটার কোনো কাগজপত্র নেই। তাঁর কাছে কিছু প্যাড পেয়েছি। মানে, নানান ধরনের অনিয়ম।’
আটক অবস্থায় দর্জি মনিরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন ডিবির এমন একটি সূত্র জানিয়েছেন, দর্জি মনির বিয়ে করেছেন তিনটি। এর মধ্যে এক স্ত্রী থাকেন কামরাঙ্গীরচর। তাঁর কোনো খোঁজ-খবর নেই। চার ছেলে-মেয়ে। তিনি একজন বয়স্ক নার্সকেও বিয়ে করেছেন। বিয়ে করার পরে নার্সের কাছ থেকে টাকা নিয়ে একটি মুজিব কোট, একটি সুন্দর পায়জামা ও আরেকটা নৌকার চেইন বানিয়েছেন। এটা নিয়ে ঘোরেন। এই হলো দর্জি মনিরের পরিচয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতার সঙ্গেই মনির খানের ‘ওঠা-বসার ছবি’ আছে। অভিযোগ আছে, এসব ছবির অধিকাংশই ফটোশপে কারসাজি করে তৈরি করা। যদিও তিনি তাঁর ফেসবুকে দাবি করেছেন, ছবিগুলো সত্যি। ফটোশপ করা হয়নি।
মনির খান জমির দালালি ও তদবির-বাণিজ্য করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে। তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে কেরানীগঞ্জ ও সাভারের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্রও সংগ্রহ করেছিলেন। তবে তিনি মনোনয়ন পাননি।
আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করেছেন, ‘বাংলাদেশ জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদ’-এর মতো সংগঠনের সঙ্গে দলটির কোনো সম্পৃক্ততা নেই। যারা এ ধরনের ভুঁইফোঁড় সংগঠন চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে।
এর আগে ‘চাকরিজীবী লীগের’ নামে সংগঠন দাঁড় করানো এবং জেলা-উপজেলায় কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টি ভাইরাল হওয়ার পর পরই আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীরকে। পরে গত শুক্রবার রাতে তাঁকেও গ্রেপ্তারও করা হয়। এখন তিনি রিমান্ডে রয়েছেন।