তিনি কি এক্সপার্ট? তিনি কি ডাক্তার? তিনি কীভাবে বুঝবেন?
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের ওপর দুপুর ২টায় আদেশ দেবেন হাইকোর্ট। আজ বৃহস্পতিবার বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ শুনানি শেষে এ আদেশ দেন।
এর আগে বেলা ১১টায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় জামিন আবেদনের শুনানি শুরু হয়। শুনানির শুরুতে আদালত খালেদা জিয়ার সর্বশেষ মেডিকেল রিপোর্ট পড়ে শোনান। রিপোর্টে সাত সদস্যের বোর্ড তাদের মতামত দিয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়, খালেদা জিয়ার ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, অ্যাজমা, ব্যাকপেইন ও আর্থ্রাইটিজের সমস্যা রয়েছে। তবে ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, অ্যাজমা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কিন্তু আর্থ্রাইটিজ ও ব্যাকপেইনের চিকিৎসার জন্য যেসব মেডিসিন পুশ করা দরকার, তার জন্য খালেদা জিয়া অনুমতি দেননি। এতে করে উন্নত চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে না। এ সময় আদালত বলেন, ‘আমরা এখন আদেশ দিব।’
এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী আ্যডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘মাই লর্ড, আমাদের একটু আবেদন রয়েছে। তিনি কেন অনুমতি দেননি, তা জানা দরকার। আমরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমরা তাঁর কাছে জানব, কেন তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন না।’
জবাবে আদালত বলেন, ‘এটা আমরা দিতে পারি না। এটার কোনো সুযোগ নেই। আমরা আদেশ দিচ্ছি।’
এ সময় জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘মাই লর্ড, এক্ষুনি আদেশ দিয়েন না। আমাদের জানা দরকার কেন তিনি চিকিৎসা নেবেন না। প্লিজ, আমাদের অনুমতি দেন।’
জবাবে আদালত বলেন, ‘এটা আমরা দিতে পারব না। আমরা আদেশ দেব।’
এ সময় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘মাই লর্ড, যেই মেডিসিন পুশ করার কথা বলা হচ্ছে, তা বিদেশি ওষুধ। তা পুশ করার পর কী রিঅ্যাকশন হবে, সেটা দেখা দরকার।’
আদালত বলেন, ‘তিনি কি এক্সপার্ট? তিনি কি ডাক্তার? তিনি কীভাবে বুঝবেন?’
আদালত বলেন, ‘আমরাও চিকিৎসার জন্য দরকার হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডাক্তারদের কনসান নিয়ে চিকিৎসা করি। আমাদের একজন বিচারপতি প্যারালাইজড হয়ে গেছেন। তিনিও চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে গেছেন। কিন্তু যাওয়ার আগে ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তারের কনসান নিয়ে গেছেন।’
এ সময় মওদুদ আহমদ বলেন, ‘মাই লর্ড, আমাদের দেখা করে জানার দরকার।’
জবাবে আদালত বলেন, ‘আপনারা কি ডাক্তার? আপনারা কি জানেন ট্রিটমেন্ট কী?’
এ সময় অপর আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমাদের বারবার আপনাদের কাছেই আসতে হয়। আমাদের সবকিছু বন্ধ করবেন না। আমাদের একটু অনুমতি দেন। আর এ বিষয়ে আদেশের জন্য আগামী রোববার দিন ধার্য রাখেন।’
আদালত বলেন, ‘আমাদের একটি প্ল্যান রয়েছে। কোর্টের নিজস্ব প্ল্যান থাকে। সেই অনুযায়ী কোর্ট চলে।’
জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘মাই লর্ড, এইটুকু কনসিডার করেন। আপনাদের কাছে বার বার আসতে হয়। আগামী রোববার আদেশের জন্য রাখেন।’
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘মেডিকেল বোর্ড রিপোর্ট দিয়েছে। তিনি (খালেদা জিয়া) যদি চিকিৎসার অনুমতি না দেন, তাহলে মেডিকেল বোর্ডের কী করার আছে? উনার সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।’
এ সময় আদালত বলেন, ‘ব্যাকপেইন ও আর্থ্রাইটিসের সমস্যা রয়েছে। ঠিক আছে আমরা আদেশ দিই।’
পরে আবার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘মাই লর্ড, দুপুর ২টা রাখেন।’ পরে আদালত জামিনের আদেশের জন্য দুপুর ২টায় সময় দেন।
খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনজীবী ছিলেন খন্দকার মাহবুব হোসেন, মওদুদ আহমদ, জয়নুল আবেদীন, এ জে মোহাম্মদ আলী ও ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন।
উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে খুরশিদ আলম খান।
এর আগে সকাল পৌনে ১১টার দিকে রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবর বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চে খালেদা জিয়ার সর্বশেষ মেডিকেল রিপোর্ট উপস্থাপন করেন।
এরপর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন শুনানি শুরু হয়।
এদিকে জামিন শুনানিকে ঘিরে হাইকোর্ট এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে পুলিশ। প্রত্যেককে তল্লাশি করে ও পরিচয়পত্র যাচাই করে তবেই হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়।
এদিকে, আদালতের নির্দেশানুযায়ী গতকাল বুধবার দুপুরে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা-সংক্রান্ত মেডিকেল রিপোর্ট জমা দেয় বিএসএমএমইউ। এরপর জামিন আবেদনের শুনানি এবং সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে জরুরি বৈঠক করেন বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণীয় ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্যরা।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জামিন আবেদনের ওপর আদেশকে কেন্দ্র করে সবার চোখ আজ উচ্চ আদালতের দিকে। বিএনপি নেতা ও আইনজীবীরা বলছেন, ন্যায়বিচার পেলে খালেদা জিয়া জামিন পাবেন বলে আশাবাদী।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় মোট ১৭ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে কারাবন্দি খালেদা জিয়া গত বছরের ১ এপ্রিল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। দল ও পরিবারের সদস্যরা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে অন্য হাসপাতালে নিতে চাইলে তাতে অনুমতি মেলেনি।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় জামিন চেয়ে এর আগেও হাইকোর্টে আবেদন করেন খালেদা জিয়া। কিন্তু অপরাধের গুরুত্ব, সংশ্লিষ্ট আইনের সর্বোচ্চ সাজা এবং বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়াসহ অন্য আসামিদের করা আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুত—এমন তিন বিবেচনায় হাইকোর্ট বেঞ্চ ৩১ জুলাই সেই আবেদন খারিজ করে দেন। এর পর খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা আপিল বিভাগে যান।
গত বছরের ১২ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়ে জামিন আবেদনটি খারিজ করে দেন। আপিল বিভাগের ওই রায়ে বলা হয়, বিএনপি চেয়ারপারসনের সম্মতি থাকলে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী তাঁকে দ্রুত ‘অ্যাডভান্সড ট্রিটমেন্ট’ দেওয়ার পদক্ষেপ নিতে।
সেই রায় ১৯ জানুয়ারি প্রকাশিত হওয়ার পর হাইকোর্টে নতুন করে জামিন আবেদন করার উদ্যোগ নেন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় দায়ের করেন তাঁর আইনজীবী সগীর হোসেন লিয়ন। ১৯ ফেব্রুয়ারি জামিন আবেদনটি উপস্থাপনের পর আদালত ২৩ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেছিলেন। সেদিন শুনানির পর আদালত আজ দিন ধার্য করেন।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ডাদেশ পেয়ে বন্দি রয়েছেন খালেদা জিয়া। আপিলের পর হাইকোর্টে যা বেড়ে ১০ বছর সাজা হয়। বর্তমানে তিনি কারা হেফাজতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন।
পরে ২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর খালাস চেয়ে আপিল বিভাগে খালেদা জিয়া জামিন আবেদন করেন। তবে সেই আবেদন এখনো আদালতে উপস্থাপন করেননি তাঁর আইনজীবীরা।
২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের ৭ নম্বর কক্ষে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক মো. আখতারুজ্জামান (বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি) জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন। একই সঙ্গে তাঁকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো ছয় মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। একই সাজা হয়েছে মামলার অপর তিন আসামিরও।
দণ্ডাদেশ পাওয়া অপর তিন আসামি হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছ চৌধুরীর তৎকালীন একান্ত সচিব জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।
২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা করা হয়। ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগে মামলাটি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
তদন্ত শেষে ২০১২ সালে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ খালেদাসহ চার আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম শেষ হলে দুদকের পক্ষে এই মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণা করা হয়।