ঢাকা থেকে ফাঁকা হয়েই ফিরতে হলো
ঢাকা শহরে রিকশা চালিয়ে কিছু টাকা জমিয়ে বগুড়ায় ফেরার কথা ছিল সূর্যা মিয়ার। কিন্তু লকডাউনের কারণে ফাঁকা পকেটেই ফিরেছেন তিনি।
৬৫ বছর বয়সী সূর্যা মিয়ার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। বছর খানেক হলো, ছোট মেয়ে সাবিনার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের সময় কথা ছিল, সাবিনার স্বামী আবদুল মালেককে ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে। বিয়ের পর থেকে এ পর্যন্ত ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। মাঝেমধ্যে বাকি ২০ হাজার টাকা চান মালেক। মালেকের আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়। সূর্যা মিয়া ভেবেছিলেন, ঈদের আগে কিছু টাকা দেবেন মেয়ের জামাইকে। সেই তাগিদ থেকে গত ৩ এপ্রিল তিনি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা থেকে ঢাকায় পৌঁছান।
ঢাকায় এসে সূর্যা মিয়া জানতে পারেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ইতিমধ্যে ‘লকডাউনের’ ঘোষণা দিয়েছেন। ৫ এপ্রিল থেকে এই ‘লকডাউন’ কার্যকর হবে। তারপরও ৪ এপ্রিল সকাল থেকে রিকশা চালানো শুরু করেন তিনি। কিন্তু এক সপ্তাহের ‘লকডাউনে’ রিকশা চালিয়ে বেশি টাকা আয় হয়নি তাঁর। যা আয় হচ্ছিল, থাকা-খাওয়া ও রিকশাভাড়া বাবদ প্রায় সব চলে যাচ্ছিল।
এদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আরও বেড়ে যাওয়ায় আগামীকাল বুধবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য ‘কঠোর লকডাউনের’ ঘোষণা দিয়েছে সরকার। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, প্রয়োজন ছাড়া কেউ রাস্তায় বের হতে পারবে না। ফলে রিকশাও চালাতে পারবেন না সূর্যা মিয়া। রিকশা না চালাতে পারলে থাকা-খাওয়ার টাকা জোগাবেন কীভাবে? লকডাউনের সঙ্গে আগামীকাল থেকে আবার রোজাও শুরু হচ্ছে। কাছে টাকা না থাকলে রোজা রাখারও ঝামেলা। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন বগুড়ায় ফেরার।
গতকাল সোমবার তিনি রাজধানীর সায়েদাবাদের বাস কাউন্টারে যান খোঁজ নিতে। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, বাস চলবে না। তবে দেড় হাজার টাকা দিলে বগুড়া পর্যন্ত যেতে পারবেন, সেই ব্যবস্থা করবে কাউন্টার কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এত টাকা দিয়ে যাবেন না সূর্যা মিয়া। ফলে কোনো উপায় না দেখে তিনি সন্ধ্যায় চলে আসেন রাজধানীর পান্থপথের বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের বিপরীত দিকের রাস্তায়। অথচ, বুকভরা আসা নিয়ে সূর্যা মিয়া ঢাকায় এসেছিলেন মেয়ের যৌতুকের দায় মেটানোর চেষ্টায়!
রাত যখন সাড়ে ১২টা, তখন সূর্যা মিয়ার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁর ঢাকায় আসা থেকে খালি হাতে ফিরে যাওয়ার সব গল্প নিজেই জানান। গল্পের ছলে সূর্যা বলছিলেন, ‘আট থেকে ১০ বছর হলো আমি মাঝেমধ্যে ঢাকায় আসি। রিকশা চালাই। কিন্তু মাঝের প্রায় এক বছর আর আসিনি। হঠাৎ খুব অভাবে পড়েছি। এখন গ্রামের দিকে তেমন কোনো কাজ নেই। ধান কাটার কাজও শেষ হয়েছে। তাই ভেবেছিলাম, ঢাকায় এসে রিকশা চালিয়ে কিছু টাকা আয় করে ঈদের সময় বাড়ির দিকে যাব। মেয়ের জামাইকে ২০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা আছে। ভেবেছিলাম, এবার একটু বেশি সময় রিকশা চালাব। বাড়িতে গিয়ে জামাইকে কিছু টাকা দেব। তা তো হলোই না, আরও ঝামেলায় পড়লাম।’
‘লকডাউন শেষ হলে আবার ফিরে আসব। কিন্তু কবে ঠিক হবে তা জানি না। সেজন্য বাড়ি যাচ্ছি। যদি জানতাম, তাড়াতাড়ি লকডাউন শেষ হবে, তাহলে থেকে যেতাম। কিন্তু ঠিক না হয়ে তো বাড়তেও পারে। আবার সব রোজা থাকি। নামাজ-কালাম করি। সব মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে যাচ্ছি। কিন্তু কখন ট্রাকে উঠতে পারব, তাও জানি না। যত রাতই হোক, বাড়ি চলে যাব। না হলে পরে আর যেতে পারব না’, যোগ করেন সূর্যা মিয়া।
শুধু সূর্যা মিয়া নন, গতকাল সোমবার সন্ধ্যা থেকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের চারপাশে ছিল গ্রামমুখী মানুষের ঢল। শত শত মানুষ অপেক্ষা করছিলেন গ্রাম থেকে কাঁচামাল নিয়ে ঢাকায় আসা ট্রাকের। কারওয়ান বাজারে মালামাল নামিয়ে যখন ট্রাক ফিরে যাবে গ্রামে, সে সময় ট্রাকে চড়ে গ্রামে ফেরার প্রত্যাশা নিয়ে সবাই বসেছিলেন। হাজার হাজার মানুষ, এদের অধিকাংশই শ্রমজীবী। কেউ রিকশাচালক, কেউ-বা ভ্যানচালক। অনেকেই আবার বিভিন্ন দোকানপাট ও মার্কেটে কাজ করেন। সবাই তল্পিতল্পা গুছিয়ে বের হয়েছেন। উদ্দেশ্য, যাঁর যাঁর গ্রামে ফেরা।
কায়সার (৫৪) একজন রিকশাচালক। তিনি ৩২ বছর ধরে ঢাকায় রিকশা চালান। সোমবার রাতে তাঁকে কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারার চত্বরে বসে থাকতে দেখা যায়। ওই স্থানে কায়সারের সঙ্গে আরও ৪০ জনের মতো শ্রমজীবী বসেছিলেন। কায়সার যাবেন কুড়িগ্রামে। কথা প্রসঙ্গে কায়সার এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, ‘বাস কাউন্টারে গেলাম, বাস ছাড়বে না। তয়, কাউন্টারের একজন লোক কইল, দেড় হাজার টাকা দিলি পরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবানি। এত টাকা কই পামু আমি? ওখান থেকে সন্ধ্যার দিকে কারওয়ান বাজার চলি এলাম। এখন রাত ১২টার বেশি বাজে, কখন যেতে পারব জানি না। কারওয়ান বাজারে ট্রাক ড্রাইভারের কাছে লোক পাঠাইছি। শুনেছি এক হাজার করি নিবে। তাও তো যাওয়া যাচ্ছে না। খুব চিন্তায় পড়ি গিছি। অনেক কষ্ট করে কিছু টাকা জমেছে, এবার সেগুলোও শেষ হবে।’
গ্রামে ফিরছেন কেন- এমন প্রশ্নে কায়সার আরও বললেন, ‘আগে রিকশা চালিয়ে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত ইনকাম করছি। লকডাউন দেওয়ার পর থেকে ৫০০ টাকার বেশি করতে পারি না। সামনের লকডাউনে শুনলাম, ঘর থেকে বের হতে দেবে না। তাহলে রিকশা চালাতে পারব না। ঢাকায় থেকে কী করব? রোজা রাখতেও সমস্যা হবে। তাই কুড়িগ্রাম যাচ্ছি। লকডাউন উঠে গেলে আবার চলে আসব।’
বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের বিপরীত পাশে দেখা যায়, পাঁচ শতাধিক মানুষ। কারওয়ান বাজার থেকে পণ্যবাহী ফিরতি ট্রাক সেখানে গিয়ে পৌঁছালে মানুষ হুমড়ি খেয়ে ওঠার চেষ্টা করে তাতে। রাত ১২টার দিকে একটি ট্রাক গিয়ে দাঁড়ায় সেখানে। সঙ্গে সঙ্গে অন্তত ৩০ জন উঠে পড়ে তাতে। ট্রাকটি পরে নাটোরের বনগ্রামের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে।
ট্রাকে উঠে সাইফুর নামের এক ভ্যানচালক বলেন, ‘সেই বিকেল থেকে এখানে অপেক্ষা করছি। এখন ট্রাকে উঠেছি। এক হাজার টাকা ভাড়া দিতে হবে। খাব কী এখানে থেকে? ওর চেয়ে বাড়িতে গিয়ে রোজা-কালাম করি।’
দীর্ঘ সময় ট্রাকের অপেক্ষায় থাকা ভ্যানচালক নাহিদ বলছিলেন, ‘সন্ধ্যার পর এখানে এসেছি। এখনও বসে আছি। কখন ট্রাক ছাড়বে তার ঠিক নেই। আমি যাব রংপুরে। ভাড়া চাচ্ছে অনেক। তারপরও বাসায় যেতে হবে। লকডাউনের মধ্যে তেমন কেউ বাসা পরিবর্তন করে না। সুতরাং এখানে থেকে কোনো লাভ নেই। কারওয়ান বাজার থেকে মাল নিয়ে আসা ট্রাক বের হলে তাতে উঠে চলে যাব। শুনছি, লকডাউন বাড়বে না কি। তাহলে এখানে থেকে কী করব? দেখা যাবে, গতবারের মতো ঈদের আগে আর লকডাউন খুলবে না। তাই বাসায় চলে যাচ্ছি। বাড়ি গিয়েও সমস্যা। টাকা থাকবে না। এখন গ্রামের দিকে ধানকাটার কাজও নেই। সব স্থানে আসলে সমস্যা। গরিবের এমনই হয়। আমাদের জন্য কেউ থাকে না।’