চশমায় সাঁটানো স্কচ টেপ সূত্রে হত্যারহস্য উদঘাটন
একটি চশমায় সাঁটানো কালো স্কচ টেপের সূত্রে সন্ধান মিললো হত্যাকারী চক্রের। মহাসড়কে যাত্রী ও চালক বেশে ফাঁদ পেতে থাকা এমন এক অপহরণচক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকার উত্তর গোয়েন্দা পুলিশ।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন পাবনার আমিনপুর থানাধীন টাংবাড়ী গ্রামের মাসুম শেখ (৩৫), খুলনার সোনাডাঙা থানাধীন রায়েরমহল গ্রামের মোহাম্মদ জনি (৩২) ও পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার উদয়পুর মিয়াবাড়ী গ্রামের আব্দুর রব মিয়া (৪২)।
সাভারে সাবেক সেনা সদস্য ফজলুল হক হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে সংঘবদ্ধ এমন একটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশ। এ চক্রের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি প্রাইভেটকার।
জানা যায়, চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলার মহাসড়কে যাত্রী নেওয়ার নাম করে ছিনতাই এবং মুক্তিপণ না পেয়ে হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ চালিয়ে আসছিল।
ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক নাজমুল হাসান বলেন, ‘চালক ছাড়াও এ দলের সদস্যরা যাত্রীবেশে থাকতেন প্রাইভেটকারে। তারা নিরীহ যাত্রীদের টার্গেট করে দীর্ঘদিন ধরে এমন অপকর্ম চালিয়ে আসছে বলে আমাদের কাছে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে। পরে তাদের নাম ঠিকানা যাচাই করে দেখা যায়, তারা বিভিন্ন থানার একই ধরনের অপরাধের পলাতক আসামি। গ্রেপ্তারের পর আসামিরা আদালতে নিজেদের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।’
ডিবি পরিদর্শক নাজমুল হাসান আরও বলেন, ‘চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি সাভারের বিরুলিয়া কমলাপুর এলাকায় সড়কের পাশে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ মরদেহের পাশে পড়ে ছিল একটি মানিব্যাগ ও একটি টিফিন ক্যারিয়ার। এর কিছু দূরে পড়েছিল একটি মোবাইল ও একটি চশমা। চশমাটির গ্লাস ছিল কালো স্কচ টেপে সাঁটানো। লাশ উদ্ধারের পরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাভার মডেল থানা পুলিশ, ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশ, পিবিআই ও র্যাব সদস্যরা। প্রাথমিক তদন্তে অজ্ঞাত মরদেহটি ফজলুল হকের (৪৫) বলে শনাক্ত করা হয়। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়া ফজলুল হক মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় থানা কাতরাসীন শশীনারা গ্রামের বাসিন্দা।’
‘পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্স লিমিটেডের নিরাপত্তা প্রধান (সিকিউরিটি ইনচার্জ) হিসেবে কর্মরত ছিলেন ফজলুল। ঘটনার দিন গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার উথুলি থেকে অফিসের উদ্দেশে বের হয়েই নিখোঁজ হন তিনি। পরে তাঁর লাশ মেলে সাভারের বিরুলিয়ায়। লাশ শনাক্তের পর গত ২৫ জানুয়ারি নিহত ফজলুল হকের স্ত্রী রাবেয়া বেগম (৪০) সাভার মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এরপর ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদারের নির্দেশে মামলাটির তদন্তভার দেওয়া হয় ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশকে।’-বলেন ওই ডিবি কর্মকর্তা।
ডিবি পরিদর্শক নাজমুল হাসান বলেন, ‘মানি ব্যাগ থেকে টাকা খোয়া যাওয়ায় আমাদের সন্দেহ ছিল ছিনতাকারীদের। পাশাপাশি নিহত ফজলুলের সঙ্গে কারো কোনো বিরোধ ছিল কিনা সেটি বিবেচনায় রেখে এগুতে থাকে মামলার তদন্ত। তদন্তে দেখা যায়, অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে বিরোধের জেরে ফজলুল নিজেও দুটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। তবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জব্দ আলামতের মধ্যে স্কচ টেপে মোড়ানো একটি চশমা দেখে আমাদের সন্দেহ প্রকট হয়। সেই সূত্র ধরে এই ধরনের অপরাধে জড়িত এমন দুটি গ্রুপকে আমরা শনাক্ত করি। তবে সেখান থেকে কোনো তথ্য না পেয়ে মানিকগঞ্জ থেকে সাভারের বিরুলিয়া পর্যন্ত সড়কের পাশের ৩৫টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করি।’
‘সেখানেও কাঙ্ক্ষিত তথ্য না পাওয়ায় আমরা শিবালয় থানায় দুটি সাধারণ ডায়েরির সন্ধান পাই। সেখানে দুজনের অভিযোগ ছিল নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাওয়ার জন্য অল্প ভাড়ায় প্রাইভেটকারে উঠে তাঁরা অপহরণকারীর খপ্পরে পড়েন। তাঁদের একজন বিকাশের মাধ্যমে ও আরেকজন বুথ থেকে টাকা তুলে দিয়ে প্রাণে রক্ষা পান। সেই বিকাশের নম্বর ধরে শুরু হয় নতুন তদন্ত। এরপর বেড়িয়ে আসে আসল তথ্য।’ –বলেন ডিবি কর্মকর্তা।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা জানান, গত ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় মানিকগঞ্জের উথুলি বাসস্ট্যান্ড থেকে মতিঝিল পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে ফজলুলকে প্রাইভেটকারে ওঠানো হয়। পরে তাঁর কাছে থাকা মোবাইল ও টাকা ছিনিয়ে নিতে চাইলে ফজলুল বাধা দেন। এ সময় তাঁর হাত পা বেঁধে কালো চশমা পরিয়ে দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে চিৎকার চেঁচামেচি করলে গলায় থাকা মাফলারটি পেঁচিয়ে দুজন দুদিকে টেনে ধরলে ফজলুল মারা যান। পরে সাভারের কমলাপুর এলাকায় মরদেহ ফেলে মিরপুরের দিকে চলে যায় তারা।
তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অপহরণ ও ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত প্রাইভেটকারটি জব্দ করা হয়েছে বলে জানান ওই ডিবি কর্মকর্তা।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন সরদার জানান, উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক নাজমুল হাসানের নেতৃত্বে সম্পূর্ণ একটি তথ্যবিহীন হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করেছে গোয়েন্দারা। এসব চক্র বিভিন্ন সড়কে সক্রিয়।
তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনার কথাও জানিয়েছেন পুলিশ সুপার।