চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রযুক্তির সহজ হস্তান্তর চান প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে প্রযুক্তির সহজলভ্য ও পর্যাপ্ত হস্তান্তর নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের (ফোরআইআর) সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা। তিনি বলেন, সরকার চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আসন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিভিন্ন সময়োপযোগী নীতি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
‘সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিজেদের মতো করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা- যদি প্রযুক্তি সহজলভ্য এবং সহজে হস্তান্তরযোগ্য না হয়,’ যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা গণভবন থেকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করে এসব কথা বলেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ১০ ডিসেম্বর থেকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বিষয়ক দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ সৃষ্টি করেছি। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে কৃতিত্ব প্রদান করেন। তিনি বলেন, আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই শিল্পোন্নয়নে (আইএসআইডি) কাজ করছি, ‘এসডিজি প্রোগ্রেস অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছি। আমরা লক্ষ্য স্থির করে দেশ পরিচালনা করি। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পর এখন আমরা ‘উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ২০৪১ সালের মধ্যে যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখছি, সেটাই হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ভিত্তি হিসেবে তিনটি বিষয় তাঁর সরকারের কাছে অত্যন্ত গুরুত্ব পাচ্ছে- উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এর মধ্যে রয়েছে- অত্যাধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে শিল্পের বিকাশ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী বাহিনী সৃষ্টি এবং পরিবেশ সংরক্ষণ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা শেখ মুজিব স্বাধীনতা অর্জনের পর মাত্র নয় মাসেই একটি সংবিধান প্রণয়ন করেছেন এবং এই তিনটি বিষয়কে রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছেন- ১৬-অনুচ্ছেদে ‘জীবন যাত্রার মানের বৈষম্য দূরীকরণে গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতায়ন, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ’, ১৭(খ)-অনুচ্ছেদে ‘সময়ের প্রয়োজনে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নাগরিক সৃষ্টি’ এবং ১৮(ক) অনুচ্ছেদে ‘বর্তমান ও ভবিষ্যত নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ’।
জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনকালেই দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চালু করেন এবং ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠা করেন। বিজ্ঞান ও গবেষণা ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ‘কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন’ গঠন করেন বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
’৭৫-এর বিয়োগান্তক অধ্যায় স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্ভাগ্য, জাতির পিতা মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন। সংক্ষিপ্ত সময়েই তিনি শিক্ষা, কৃষি ও শিল্প খাতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধন করেছিলেন। ১৯৭৪-১৯৭৫ অর্থবছরে নয় শতাংশের উপরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। যা ধরে রাখতে পারলে পরবর্তী ১০ বছরেই বাংলাদেশ হয়ে উঠত তাঁর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলাদেশ’।
সরকারপ্রধান বলেন, আমি অত্যন্ত আনন্দিত, এই সম্মেলনে দেশ-বিদেশের বিপুল সংখ্যক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিল্পউদ্যোক্তাসহ অনেকেই অংশগ্রহণ করেছেন। তিনজন নোবেল বিজয়ী এবং ছয়জন খ্যাতিমান বিজ্ঞানী মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। দুটি সাইড ইভেন্ট ‘মুজিব-১০০ আইডিয়া কনটেস্ট’ এবং ‘মুজিব-১০০ ইন্ডাস্ট্রিয়াল এক্সিবিট’ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৭টি দেশ থেকে মোট ৫২৫টি গবেষণাপত্র জমা হয়েছে এবং তার মধ্য থেকে ১০০টি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। এ ছাড়া, সহস্রাধিক আইডিয়া থেকে ১০টিকে সেরা হিসেবে বাছাই করা হয়েছে, যারা প্রত্যেকে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার পাবেন। আমি সব অংশগ্রহণকারীদের অভিনন্দন জানাই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি মনে করি, ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আন্তর্জাতিক সম্মেলন’ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আমি আশা করি, এই সম্মেলনে অর্জিত জ্ঞান আমাদের শিক্ষা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি নিবিড় বন্ধন সৃষ্টি করবে। ফলে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সম্পর্কিত গবেষণা এবং উদ্ভাবনকে বাস্তবে রূপদান করা সহজতর হবে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তৃতা করেন শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ ও সদস্য মো. সাজ্জাদ হোসেন। অনুষ্ঠানের একটি ভিডিও উপস্থাপনা প্রদর্শিত হয়।
ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোন এবং ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের সব শহীদকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
প্রায় ১০০ বছর পর পর শিল্পায়নের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী বিবর্তনের বিষয়টি লক্ষ্যণীয়- উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায় অতিক্রম করে আমরা আজ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছি। এ পর্যায়ে সাশ্রয়ী এবং সবুজ ভ্যালু-চেইন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে- একদিকে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনকারী ও সহজে ব্যবহারকারী সম্পদশালী দেশগুলো এবং অন্যদিকে উক্ত ক্ষেত্রে বিনিয়োগে অক্ষম রাষ্ট্রপুঞ্জ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, অদূর ভবিষ্যতে মানুষকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রের সঙ্গে সহাবস্থান করতে হবে। কিছু নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যেমন- মেশিন মানুষের কর্মক্ষেত্রকে সংকুচিত করবে, সস্তা শ্রমের চাহিদা কমে যাবে, অসমতা বৃদ্ধি পাবে এবং অভিবাসনকে উৎসাহিত করবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমবে এবং প্রযুক্তিজ্ঞান ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়বে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো যার যার গতিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে, যদি প্রযুক্তি সহজলভ্য এবং সহজে হস্তান্তরযোগ্য না হয়।’
শেখ হাসিনা বলেন, অস্ট্রীয় বংশোদ্ভূত অর্থনীতিবিদ যোসেফ সুম্পিটারের ‘ক্রিয়েটিভ ডেস্ট্রাকশন’ তত্ত্ব অনুযায়ী নিত্যনতুন উদ্ভাবনের ফলে প্রচলিত কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হবে ঠিকই, কিন্তু নতুন ধরনের কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হবে।
সেই অনুযায়ী দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন জনশক্তিতে রূপান্তর করতে তাঁর সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এ.আই), রোবোটিক্স, ইন্টারনেট অফ থিংস সফলভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হব।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর থেকে তাঁর সরকার ধারাবাহিকভাবে শিল্পখাতে উদ্ভাবনী প্রযুক্তির সন্নিবেশসহ ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য কাজ করে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর ফলে দেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি অতিক্রম করেছে। শিগগিরই আমরা ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক সেবা চালু করছি। এটি ব্যবসার মডেল, শিক্ষা-পদ্ধতি, জীবনযাত্রার মান এবং প্রচলিত ডিজিটাল এবং সোশ্যাল মিডিয়াকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দিবে।
তাঁর সরকারের ডাকঘরগুলোকে ডিজিটাল সেন্টারে রূপান্তরের উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলোকে ফাইবার অপটিক্যাল তারে যুক্ত করা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন, হাজার হাজার ইন্টারেক্টিভ কন্টেন্ট এবং ই-বুক ডিজাইন করা হয়েছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পপণ্যগুলোকে ই-কমার্স প্লাটফর্মে যুক্ত, অটোমেশন, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট এবং ফ্রিল্যান্সিং ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান উন্নতি করা হচ্ছে। তিনি দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করে বলেন, অদূর ভবিষ্যতে আইসিটি ও সফটওয়্যার শিল্প আমাদের রপ্তানি খাতকে নেতৃত্ব দিবে।