ইয়াবায় পুড়ছে নতুন টাকা, চলছে না বাজারে
ভ্রাম্যমাণ সিগারেট বিক্রেতা মো. হাসেম। এক ক্রেতা ১০০ টাকার একটি নতুন নোট দিয়ে সিগারেট কিনেছিলেন হাসেমের কাছ থেকে। নতুন নোট দেখে কোনো চিন্তা ছাড়াই তা পকেটে ঢুকিয়েছিলেন হাসেম।
তবে হাসেম যখন নোটটি খরচ করতে যান তখন তা কেউ নিচ্ছিল না। কারণ নোটটির এক কোনা পোড়া ছিল।
একাধিক ব্যক্তি, দোকানদারের সঙ্গে কথা বলেও একই তথ্য জানা গেল। জানা যায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মানুষের কাছে এমন টাকার নোট আছে যার কোনা পোড়া থাকে। আর এই কোনা পোড়া নোট কেউ নিতে চায় না, যা ১০ টাকার নোট হোক বা ৫০০ টাকার নোট হোক। মানুষকে পড়তে হচ্ছে চরম ভোগান্তিতে।
ইয়াবায় পুড়ছে টাকা
জানা গেল, নোটের কোনা পুড়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে ইয়াবা। ওই মাদকটি সেবনের সময় মাদকাসক্তরা নতুন নোট ব্যবহার করে। আর তাতেই পুড়ে যাচ্ছে নোটের কোনা। যা বাজারে চালানো রীতিমতো কষ্টকর। প্রায় অচলই হয়ে পড়ে ওই নোট।
সিগারেট বিক্রেতা হাসেম কোনো মতেই ১০০ টাকার নোটটি চালাতে পারেননি। পরে উপায় না দেখে অন্য এক দোকানদারের কাছে ১০০ টাকার নোটটি ৫০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।
সম্প্রতি রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের সামনে কথা হলে মো. হাসেম এনটিভি অনলাইনকে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমি দু-টাকার ব্যবসায়ী। আমারই ৫০ টাকা গচ্চা গেল। ভেবেছিলাম পুরো টাকাটা গচ্চা যাবে।’
মো. হাসেম বলেন, ‘এই টাকা দিয়ে ইয়াবা টানার পাইপ বানায়ছিল ইয়াবাখোর পোলাপান। আগুনে খানিকটা পুড়ে গেছে এক কোনা। ছেঁড়া টাকা চলে, কিন্তু পোড়া টাকা কেউ নিতে চায় না। শুধু এইডা না, এর আগেও এমন টাকা পেয়েছি। একবার ১০ টাকার দুটো নোট চালাতে পারেনি। তাই ছোট ছেলেকে খেলতে দিছিলাম।’
মো. হাসেমের কথার সূত্র ধরে কয়েকটি মুদি খানা ও সিগারেটের দোকানদারের সঙ্গে কথা হয় এনটিভি অনলাইনের। অধিকাংশ দোকানেরই অভিযোগ, প্রায় প্রায় তারা কোনা পোড়া টাকা পান। এই টাকাগুলো চালাতে তাদের অনেক কষ্ট হয়। অধিকাংশ সময় চালানো যায় না। টাকার ভেতরে পোড়া টাকা দিয়ে ক্রেতারা এই টাকা চালান। এসব টাকার অধিকাংশ পাঁচ আর ১০ টাকার নোট। ৫-১০ টাকার নোট তত বেশি ‘চেক’ করেও নেওয়া হয় না। আর এই সুযোগেই ইয়াবাসেবীরা টাকাগুলো চালিয়ে দেন বলে অভিযোগ দোকানিদের।
রাজধানীর শুক্রাবাদের নাসির নামের এক মুদি দোকানি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘অসাবধান থাকার কারণে অনেক সময় টাকাগুলো আমাদের কাছে চালিয়ে দেয় লোকজন। পরে আমরা আর চালাতে পারি না। পুড়ে গেছে অথচ বোঝা যায় না এমন নোট হলে চালানো সম্ভব হয় না। এই নোটগুলির ভেতরে ১০ আর পাঁচ টাকার নোট বেশি। বেশ কিছুদিন আগে একটি ১০০ টাকার নোট পেয়েছিলাম। তবে সেটা সিস্টেমে চালিয়ে দিয়েছিলাম।’
‘গুলিস্তান থেকে নোট কিনি’
নিয়মিত ইয়াবা সেবন করা দুই ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয় এনটিভি অনলাইনের। এদের ভেতরে একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পাঁচ মাস আগে গুলিস্তান থেকে পাঁচ টাকার ১০০টি নতুন নোট কিনেছিলাম ৭০০ টাকা দিয়ে। সেই টাকা দিয়ে ইয়াবার ধোঁয়া টেনে নিতে সুবিধা হয়। ১০ টাকার নোটেও সুবিধা হয়। টাকার নোটগুলি শক্ত হওয়াতে এটা ব্যবহারে সুবিধা হয়। তবে এখন আর পাঁচ টাকার নোট পাওয়া যাচ্ছে না।’
আরেকজন ইয়াবাসেবীও বললেন একই কথা। নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি বলেন, ‘এখন আর পাঁচ টাকা কিংবা দুই টাকার নতুন নোট গুলিস্তানে পাওয়া যায় না। তাই বাধ্য হয়ে ১০ টাকার নোট কিনতে হয়। ১০ টাকার নোট ১০০টি কিনলে মোট ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি দিতে হয়।’
দুই ইয়াবাসেবীর কথার সূত্র ধরে রাজধানীর গুলিস্তান কমপ্লেক্সের সামনে নতুন টাকার কয়েকজন বিক্রয়কারীদের সঙ্গে কথা হয় এনটিভি অনলাইনের। আমির হোসেন নামের এক বিক্রয়কারী বলেন, ‘আগে এক সময় দুই আর পাঁচ টাকার নোট ইয়াবাসেবীরা বেশি কিনত। কিন্তু এখন ওই টাকাগুলো মার্কেট আউট। এখন বেশি বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকার নোট। আপনি যদি কিনতে চান আমি কি আপনাকে বলতে পারব, আপনি ইয়াবা খাবেন কেন?’
তবে এই প্রতিবেদক গুলিস্তান কমপ্লেক্সের নোট বিক্রয়কারীর কাছে ইয়াবাসেবীর পরিচয় দিয়ে পাঁচ টাকার নোট নিতে যান। তিনি বলেন, ‘দিতে পারব তবে পাঁচ টাকার ১০০ নোট নিতে হলে আপনাকে ৮০০ টাকা দিতে হবে। মার্কেটে নাই, তবু আপনার সুবিধার জন্য আমি ব্যবস্থা করে দেব।’
‘টাকা বিকৃত করা অপরাধ’
এসব নোট আর এ বিষয়ে মানুষের ভোগান্তি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘কারো কাছে যদি পোড়া টাকা থাকে এবং সেই টাকা না চালাতে পারেন, তাহলে ওই টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকসহ যেকোনো ব্যাংকে জমা দিয়ে পরিবর্তন করে নিতে পারবেন।’
সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ইয়াবাতে পোড়া নাকি অন্যকিছুতে পোড়া সেটা কিন্তু বিষয় নয়। বিষয় হচ্ছে পোড়া টাকা। আপনি যেকোনো ব্যাংকে গেলেই পোড়া টাকা দিয়ে ভালো টাকা নিতে পারবেন। এসব ক্ষেত্রে কিন্তু শাস্তির ব্যবস্থা রাখাও মুশকিল। কারণ, আপনি কীভাবে প্রমাণ করবেন টাকাটা ইয়াবা সেবন করতে গিয়ে পুড়েছে?’
এসব বিষয়ে কথা হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) উত্তরের উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমানের সঙ্গে। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশ হেডকোয়ার্টারের জাল মুদ্রা সংক্রান্ত কমিটির একজন সদস্য। এ ছাড়া এক সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কমিটির সদস্য ছিলেন। মশিউর রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘পেনাল কোড ৩২৮ অনুযায়ী টাকাকে ইচ্ছেকৃত নষ্ট করা বা বিকৃত করা এক ধরনের অপরাধ। বর্তমানে অর্থ সংক্রান্ত নতুন একটি আইন হচ্ছে সেখানে মুদ্রাকে বিকৃত করা বা টেম্পর করা সেটাও একটি অপরাধ। ইয়াবা সেবনের সময় টাকা নষ্ট করা বা টেম্পর করা হচ্ছে এটাও অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।’
‘প্রচুর টাকা নষ্ট হচ্ছে মাদকে’
নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পাঁচ, ১০ আর ২০ টাকার কোনা পোড়া নোটে ভরে গেছে মার্কেট। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা পুড়ছে ইয়াবার পাইপে। সব দোকান সার্চ করার সুযোগ আপনাকে দেওয়া হলে আপনি নিজেই কোটি কোটি টাকা পাবেন।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ঢাকা-মেট্রো উত্তর) সহকারী পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, ‘প্রচুর টাকা এভাবে নষ্ট হচ্ছে। অধিকাংশ দোকানে গেলেই দু-একটা ইয়াবার আগুনে পোড়া টাকা পাওয়া যাবে। বহু টাকা এভাবে নষ্ট হচ্ছে। তবে সেই হিসাব কোটি, নাকি বিলিয়নে গিয়ে ঠেকবে তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো এর সঠিক হিসাব দিতে পারবে। মাদক সেবনে কড়াকড়ি বা মাদকাসক্তদের চিকিৎসা দিয়ে এর থেকে বের হওয়া সম্ভব।’