‘ইবাদতের মতই যুবলীগের দায়িত্ব পালন করেছি’
জাহাঙ্গীর কবির নানক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ১৯৫৪ সালের ১৪ জানুয়ারি বরিশাল সদর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর বাবার নাম বজলুর রহমান, মায়ের নাম নূরুনাহার বেগম। তিনি বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ (বিএম) থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
জাহাঙ্গীর কবির নানক নবম ও দশম জাতীয় সংসদের সদস্য (এমপি) ছিলেন। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি যুবলীগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে ১৯৯৪ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
নানক ১৯৮৪ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে বিএম কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তিনি ভিপি নির্বাচিত হন।
আগামীকাল ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের সপ্তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে। ওই আয়োজন সামনে রেখে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন জাহাঙ্গীর কবির নানক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এনটিভি অনলাইনের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ফখরুল ইসলাম শাহীন।
এনটিভি অনলাইন : কেমন আছেন?
জাহাঙ্গীর কবির নানক : ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
এনটিভি অনলাইন : যুবলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আপনি একসময় যুবলীগের চেয়ারম্যান ছিলেন। যুবলীগ সম্পর্কে কিছু বলুন।
জাহাঙ্গীর কবির নানক : আওয়ামী যুবলীগ একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। স্বাধীনতার পূর্বে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও প্রথিতযশা সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনিকে দিয়ে যুবলীগের যাত্রা শুরু হয়। শুরু থেকেই আমি এর সংস্পর্শে ছিলাম। যখন প্রতিষ্ঠা হয়, তখন আমি বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। ওই কংগ্রেসে আমু (আমির হোসেন আমু) ভাইয়ের সঙ্গে আমিও উপস্থিত ছিলাম। মনি ভাইয়ের প্রিয় সংগঠনটি সম্পর্কে আমার অনেক ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা ছিল। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক করেন। তারপর জয়েন সেক্রেটারি এবং পরে নেত্রীর বদন্যতায় যুবলীগের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই।
এনটিভি অনলাইন : আপনি যখন যুবলীগের চেয়ারম্যান ছিলেন, তখনকার প্রেক্ষাপট কেমন ছিল?
জাহাঙ্গীর কবির নানক : আমি এবং মির্জা আজম যখন দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন যুবলীগ ছিল ভঙ্গুর সংগঠন। যুবলীগের সারা দেশে তেমন কোনো কাঠামোগত অবস্থা ছিল না। ঢাকা মহানগরে কোনো শক্ত কাঠামো ছিল না। পাশাপাশি তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। নেত্রী অত্যন্ত আস্থা রেখে আমাদের দায়িত্ব দিলেন। আমরা পবিত্রতার সঙ্গে চেষ্টা করেছি নেত্রীর সেই আস্থা রক্ষা করতে। আমরা তাঁর নির্দেশনাকে মনে করেছি ইবাদত। আমরা ইবাদতের মতই দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি। আমরা একদিকে যুবলীগের সংগঠনকে দাঁড় করাতে রাত-দিন পরিশ্রম করেছি, চেষ্টা করেছি। এ ক্ষেত্রে আমি একটি কথা বলতে চাই, শুধু সংগঠনের চেয়ারম্যান ও সাধারণ সম্পাদক একা চেষ্টা করলেই দলটি দাঁড়ায় না। এ দলের অন্য যাঁরা সহকর্মী থাকেন, তাঁদের দিয়ে একসঙ্গে কাজ করানোর মধ্য দিয়েই সফলতা ও সার্থকতা আসে। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের মধ্যে আমরাই প্রথম ভিত গঠন করেছিলাম। যেমন যুবলীগের কেন্দ্রীয় একজন সদস্য, তাঁরও নির্দিষ্ট তিন-চারটি উপজেলার দায়িত্ব ছিল। সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদেরও কারো একটি নির্দিষ্ট জেলার দায়িত্ব ছিল। জরুরি অবস্থা মাথায় নিয়ে আমরা সারা দেশে সংগঠনটি দাঁড় করাই। অন্যদিকে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আন্দোলন চাঙা করি। বিএনপি-জামায়াত দ্বারা আমাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়, অনেক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিকূলতাকেই আমরা ভ্রুক্ষেপ করিনি। যুবলীগ আমার একটা স্বপ্নের সংগঠন বলতে পারেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা হয়। ওই গ্রেনেড হামলার পর ঢাকা মহানগর যুবলীগের যে প্রতিক্রিয়া জানানোর কথা ছিল, সেটা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই কারণে ঢাকা মহানগরে ১০৯টি কমিটি আমরা বিলুপ্ত করে দিয়েছিলাম। সেই ১০৯টি কমিটি বিলুপ্ত করে আমরা বসে ছিলাম না। ৯ দিনের মাথায় আবার ১০৯টি কমিটি তৈরি করেছিলাম। এই বাতিলটা কেন করেছিলাম? ব্যর্থতার কারণেই করেছিলাম। আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার ওপর হামলা হয়েছে, বহু মানুষ হতাহত হয়েছে। আমাদের নির্দেশনা ছিল, পুরো ঢাকা কলাপস করে দেবে; কিন্তু তারা সেটা পারেনি, তাই তাদের কমিটি বিলুপ্ত করে দিয়েছিলাম।
এনটিভি অনলাইন : ২০০৬ সালে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের শেষদিকে ঘটা আন্দোলনে যুবলীগের নেতাকর্মীদের একটা ভূমিকা ছিল, সে সম্পর্কে যদি কিছু বলেন?
জাহাঙ্গীর কবির নানক : যুবলীগ দিয়েই আন্দোলন করেছিলাম, যেদিন জামায়াত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভেঙে দেবে, সেদিন এ যুবলীগই কিন্তু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। যেটাকে লগি-বৈঠা আন্দোলন বলা হয়।
একদিকে আমরা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম, আরেক দিকে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর যুব সংগঠন ছিল, তাদের নিয়ে যুব সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলেছিলাম। যুব সংগ্রাম পরিষদ তৈরি করে কিন্তু আমরা মূল দলগুলোর অফিসে ধরনা দিয়েছি। তৎকালীন জালেম সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে। একটা সময় আমরা আলটিমেটাম দিয়েছি, যদি আপনারা এক না হন, তাহলে আমরা আপনাদের অফিসগুলোতে প্রতীকী অনশন করব।
এ ছাড়া ওই সময় জনমুখী সব আন্দোলনের সঙ্গে ছিলাম। পানির জন্য ওয়াসা ঘেরাও করেছি।
এনটিভি অনলাইন : যে লক্ষ্যে যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে?
জাহাঙ্গীর কবির নানক : ১৯৭৫-এর পর এই যুবলীগের ওপর সবচেয়ে বেশি আঘাত এসেছে এবং যুবলীগকে ধ্বংস করার জন্য চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের জঘন্য হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সর্বপ্রথম প্রতিবাদ গড়তে গিয়ে যুবলীগ নেতা বগুড়ার খসরু, চট্টগ্রামের মৌলভি সৈয়দ জীবন দিয়েছেন। এ ছাড়া এমন হাজারো নেতাকর্মীর নাম আমি বলতে পারব, হয় কারাবরণ করেছে নয়তো জীবন দিয়েছেন।
যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যুবসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য। যুবলীগের যুবসদস্যরা দেশ গঠনে কাজে নামবে, দেশ পুনর্গঠনে হাত দেবে; এটাই ছিল উদ্দেশ্য।
একটা সময় দেশে বিএনপি-জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের অবাধ বিচরণ ছিল। সব মিলিয়ে যে পরিস্থিতি ছিল, সেটা কিন্তু যুবলীগ মোকাবিলা করেছে। যুবলীগ প্রতিরোধ গড়েছিল। এরপর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে সরকার গঠন করা হয়, সেখানে কিন্তু একটি মুখ্য ভূমিকা রাখে যুবলীগ। যুবলীগ সাংগঠনিকভাবে তখন একটি মজবুত সংগঠন ছিল।
এনটিভি অনলাইন : বেকারত্ব দূরীকরণে যুবলীগের কোনো ভূমিকা রয়েছে কিনা?
জাহাঙ্গীর কবির নানক : প্রধানমন্ত্রীর কাছে যুবসমাজের কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছে যুবলীগ। মমতাময়ী নেত্রী সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন করেছেন। যুবলীগের প্যাটার্নকে পরিবর্তন করতে হবে। যুবলীগ মানে বুক ফুলিয়ে চলা নয়। এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করা যুবলীগের কাজ নয়। যুবলীগ হলো এমন একটি সংগঠন, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলবে।
এনটিভি অনলাইন : যুবলীগের নেতৃত্ব নির্বাচনে কোন কোন বিষয় বেশি গুরুত্ব দেবেন?
জাহাঙ্গীর কবির নানক : কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগে যেভাবে নেতৃত্ব এসেছে, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন। নেত্রী সৎ, যোগ্যদের নেতৃত্বে আনছেন। আমি আপনাকে বলতে পারি, সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বা চেয়ারম্যান-সাধারণ সম্পাদক সৎ নিষ্কলুষ হলেই হবে না; পুরো কমিটিই নিষ্কলুষ হতে হবে। সেহেতু আমাদের লক্ষ্য কিন্তু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নয়; পুরো কাঠামোই নিষ্কলুষ, নির্ভীক ও দেশপ্রেমিক হতে হবে।
এনটিভি অনলাইন : ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের নিয়ে যুবলীগের আগামী দিনের পরিকল্পনা আছে কি?
জাহাঙ্গীর কবির নানক : সব সময় কিন্তু তাই হয়েছে। আমি নিজেও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। ছাত্রলীগ থেকে বিদায় নেওয়ার পরই যুবলীগে এসেছি এবং গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক সম্পাদক পদে ছিলাম, যা একটি মাত্র পদ ছিল। আজকে যিনি ছাত্রলীগ করেছেন, কাল তিনি যুবলীগ করবেন। কাল যিনি যুবলীগ করবেন, তিনি সারা জীবন যুবলীগ করবেন না। তিনি যুবলীগ থেকে বিদায় নেবেন, আওয়ামী লীগ করবেন। তাই আমরা আশা করি, ছাত্রলীগ থেকে যে তরুণ বন্ধুরা বেরিয়ে এসেছে, যাঁরা রাজনীতি করতে চান, যুবলীগ করতে চান, আদর্শ ও মস্তিষ্ক রয়েছে, তাঁরা অবশ্যই যুবলীগে জায়গা করে নেবেন।
এনটিভি অনলাইন : ক্যাসিনোকাণ্ডে যুবলীগের অনেক নেতার সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। আগামী দিনে ওই বদনাম ঘোচাতে কী ভূমিকা নেবে যুবলীগ?
জাহাঙ্গীর কবির নানক : যুবলীগের ওপর নেত্রীর ব্যাপক একটা আস্থা ছিল। সেই আস্থার জায়গাটার ওপর কিন্তু আঘাত পড়েছেম যা নেত্রী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কোনো মা-ই চান না, তাঁর সন্তানটি খারাপ হোক, উনি আমাদের মা সমতুল্য, আমাদের যেকোনো ভুলে তো উনি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেনই।
এনটিভি অনলাইন : যুবলীগে নতুনদের উদ্দেশ্য কিছু বলবেন কি?
জাহাঙ্গীর কবির নানক : দেখুন, নেত্রী একটা বার্তা দিয়েছেন। আমি এবং দল যদি বার্তাটি না বুঝি, তাহলে মনে হয় সেই দলের একজন কর্মী হিসেবে না বুঝতে পারি, তাহলে রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ব। আজ, কাল অথবা পরশু। কাজেই নেত্রীর বার্তাটি বুঝতে হবে সবাইকেই। নেত্রী কী চাচ্ছেন, উনার মানসিকতা কী। নেতার চাওয়া যদি বুঝতে না পারে, সে তাহলে হারিয়ে যাবেই।
এনটিভি অনলাইন : যে কথাটি বলা হয়নি আজও?
জাহাঙ্গীর কবির নানক : এমন না বলা কথা অনেক রয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে কত কথা আছে। যে কথাগুলো দেশের মানুষ জানেন না, কাছের অনেকেও জানেন না, বিডিআর বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর নেত্রীর নির্দেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘটনাস্থলে যাই। তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। আমরা মোকাবিলা করেছি। কিন্তু সেখানের অনেক কথাই বলা হয়নি। আরেকটি কথা আমি বক্তব্যতেও বলে থাকি, আমি ছাত্রনেত্রী শেখ হাসিনাকে দেখেছি, আমি গৃহবধূ শেখ হাসিনাকে দেখেছি, আমি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে দেখেছি, আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেখেছি, আজকে সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকে দেখছি। এটা আমার ভাগ্য ভালো। সেদিন বিডিআর সদস্যদের গুলিতে মরে গেলে হয়তো তা দেখে যেতে পারতাম না। এটা আমার সৌভাগ্য।