আবরার হত্যায় রুমমেট মিজান যে কারণে ‘মূল হোতা’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে হত্যার পরিকল্পনা মূলত শুরু হয় তাঁরই রুমমেট মিজানুর রহমান মিজানের সন্দেহের মধ্য দিয়ে। তিনিই প্রথম আবরারকে ‘শিবির’ বলে সন্দেহ করেন। এবং সেটি ছাত্রলীগের ঊর্ধ্বতন নেতাদের জানান। তার পরই আবরার বিষয়ে কয়েকদফা সভা করে ছাত্রলীগ নেতারা; যেখানে মিজান উপস্থিত ছিল। আর এই সন্দেহবশতই আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের নেতারা। সেজন্য মিজানকে ‘হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা ও সূচনাকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
গত ১৩ নভেম্বর আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ২৫ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা ও অপরাধতথ্য শাখা (ডিবি)। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ডিবির পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জমান আদালতে এই অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রের একটি অংশ এনটিভি অনলাইনের হাতে এসেছে।
মিজানুর রহমান মিজান বুয়েটের ওয়াটার রিসোর্চ অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আবরার হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে মিজানকে ঘটনার চার দিন পর গত ১০ অক্টোবর আটক করা হয়। ঘটনার পর থেকে তিনি রুমেই ছিলেন। সেখান থেকেই গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ তাঁকে আটক করে। গত ৬ অক্টোবর রাতভর নির্যাতন চালিয়ে আবরার ফাহাদকে হত্যা করে ছাত্রলীগের নেতারা। এ ঘটনার পর আবরারের বাবা ১৯ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। পুলিশ তন্ত চালিয়ে এ ঘটনায় আরো ছয়জনের সম্পৃক্ততা পায়। এ মামলায় মোট ২১ জন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন। চারজন আসামি এখনো পলাতক রয়েছে।
সন্দেহ ও হল ক্যান্টিনে মিটিং
আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত ঘটনা বর্ণনা করে ওয়াহিদুজ্জমান অভিযোগপত্রে বলেন, “মিজানুর রহমান মিজান আবরার ফাহাদের রুমমেট। মিজান আসামি মেহেদী হাসান রবিনকে বলে, ‘আবরার ফাহাদকে শিবির বলে তার সন্দেহ হয়’। তারই পরিপেক্ষিতে আসামি রবিন বিষয়টি তাদের ‘এসবিএইচএসএল- ১৫/১৬’ গ্রুপের সবাইকে ফেসবুকে ম্যাসেঞ্জারে দেয়। পরে শেরেবাংলা আবাসিক হল ক্যান্টিনে আসামি মেহেদী হাসান রবিন ও ইসতিয়াক আহমেদ মুন্নার নেতৃত্বে অমিত সাহা, ইফতি মোশাররফ সকাল, আকাশ হোসেন, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান মনির, মেফতাহুল ইসলাম জিয়নসহ অন্য আসামিরা উপস্থিত থেকে মিটিং করে।”
পরের দিন গেস্টরুমে মিটিং ও হত্যার সিদ্ধান্ত
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘মিটিং চলাকালীন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আবরার রুমে আছে কি না, একাধিক আসামি পাঠিয়ে খোঁজ নেওয়া হয়। কিন্তু আবরার গ্রামের বাড়ি থাকায় পরের দিন মনিরুজ্জামান মনিরের নেতৃত্বে আসামি হোসেন মোহাম্মদ তোহা, আকাশ হোসেন, মাজেদুর রহমান মাজেদ, মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম, মোয়াজ আবু হোরায়রা ওরফে মোয়াজসহ গেস্টরুমে একত্রিত হয়ে মিটিং করে আবরারকে পিটিয়ে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়।’
বাড়ি থেকে ফিরে আসে আবরার
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় আসামি মুজতবা রাফিদ, তাঁর সহযোগী ইফতি মোশাররফ ও মেহেদী হাসান রবিনকে জানায়, সে (রাফিদ) বাড়ি যাবে, আবরারকে ধরতে হলে আজই ধরতে হবে।
এর কিছু পরই আসামি হোসেন মোহাম্মদ তোহা, শামসুল আরেফিন ও ইফতি মোশাররফ সকলকে জানায়, আবরার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া থেকে হলে ফিরেছে।
‘ওই খবর পাওয়ার পর পরই সব আসামি একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে অপরাধ সংগঠনের ইচ্ছা, উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়ে সংঘবদ্ধ হয়ে’ ২০১১ নম্বর কক্ষে যায় বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়। রাত আনুমানিক ৮টার পরে মেহেদী ও ইফতির নির্দেশে এহতেশামুল রাব্বি তানিম, মুনতাসির আল জেমি, এ এস এম নাজমুস সাদাত মিলে আবরারের (১০১১ নম্বর) রুমে যায়।
‘বড় ভাইয়েরা তোকে ডাকছে’
আসামিরা ২০১১ নম্বর কক্ষে গিয়ে দেখে আবরার ঘুমাচ্ছেন। আসামি তামিম আবরারকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে বলে, ‘বড় ভাইয়েরা তোকে ডাকছে, ২০১১ নম্বর রুমে যেতে হবে।’
আবরার ফাহাদ বলে, ‘কেন?’
তখন তামিম বলে, ‘গেলেই দেখতে পাবি।’
এই বলে আসামিরা আবরারকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর ব্যবহৃত ল্যাপটপ, একটি টাচ মোবাইল ও একটি বাটন মোবাইল সেট ২০১১ নম্বর রুমে নেয়। পরে আসামি খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর, ইফতি মোশাররফ ও মুজতবা রাফিদ তাঁর মোবাইল ও ল্যাপটপ চেক করতে থাকে। তখন আসামিরা বলে, আবরারের মোবাইলে শিবিরের তথ্য পাওয়া গেছে। এমনটাই বলা হয়েছে মামলার অভিযোগপত্রে।