স্মরণ
প্রথম চলচ্চিত্রেই নিজের জাত চেনান ত্রুফো
চলচ্চিত্র ইতিহাসে ষাটের দশকে একটি নতুন ধারার শুরু হয়েছিল ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ মুভমেন্টের মাধ্যমে। ইতিহাস তৈরি করা ফরাসি চলচ্চিত্রবিষয়ক জার্নাল কাইয়্যে দু সিনেমার চলচ্চিত্র সমালোচকদের হাত ধরে শুরু হওয়া এই চলচ্চিত্র আন্দোলনের প্রধানতম সৈনিক ছিলেন ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো। তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ES QUATRE CENTS COUPS (1959) বা The 400 Blows ছিল এই আন্দোলনের প্রথম দিকের কাজ, সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণও। কাইয়্যে দ্যু সিনেমা পত্রিকার সম্পাদক আঁদ্রে বাঁজার বিখ্যাত অত্যুর তত্ত্বর সেলুলয়েডে প্রথম সফল রূপায়ণ বলে অভিহিত করা যায় এই সিনেমাকে। তৎকালীন সিনেমার নাটুকেপনা ও থিমের গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে এসে রীতিমতো আন্দোলন ঘোষণা করেছিল কাইয়্যে দু সিনেমা। ষাটের দশকের শুরুতে ত্রুফো, জ্যঁ-লুক গদার, এরিখ রোমার, জাক্ রিভেত ও ক্লদ শ্যাব্রল কাইয়্যে দ্যু সিনেমাতে সমকালীন সিনেমার গতানুগতিকতাকে কাটাছেঁড়া করেন এবং ফ্রান্সের ঐতিহাসিক উঁচু মানের নান্দনিক সংস্কৃতির উত্তরাধিকার সেলুলয়েডেও রূপায়িত হতে দেখতে চান। সারা জীবন ধরে যে কথা প্রচার করে এসেছিলেন তার প্রতিচ্ছবি রূপায়ণ করেন ১৯৫৯ সালে নিজের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমায়। ত্রুফোর নিজের জীবনের গল্প দিয়ে প্রভাবিত ES QUATRE CENTS COUPS-এর প্রধান চরিত্র অ্যান্তোইন দোইনেলের মাধ্যমে নিজের শৈশবের স্মৃতিগুলো সেলুলয়েডে রূপায়ণ করেন এবং পাশাপাশি এও দেখিয়ে দেন- ক্যামেরা কীভাবে কলম হয়ে ওঠে। চলচ্চিত্রকার নেহাত চিত্রনাট্যের আজ্ঞাবহ দাস নন, বরং তাঁর নির্দেশনা গুণে কীভাবে তিনি হয়ে উঠেন সেলুলয়েডের অত্যুর।
ত্রুফোর এই সিনেমাকে সাদা চোখে দেখলে একে বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরদের মানসিক টানাপড়েনের গল্প হিসেবেই বর্ণনা করা যেতে পারে, এ মুলুকে তার আস্বাদ যেমন মিলেছে রবি ঠাকুরের ‘ছুটি’তে। ফটিকের সঙ্গে দোইনেলের সাংস্কৃতিক পার্থক্য বাদ দিলে দুজনের মধ্যে অনেক মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তবে ত্রুফোর উদ্দেশ্য কেবল শুধু এই বয়সের কিশোরদের মানসিক সমস্যাটাই ফুটিয়ে তোলা ছিল না, বরং সেই সময়ে সিনেমা ভুবনে নুতন থিম ও ফর্মের বিপ্লবের সূচনা করাও তাতে ছিল বড়ভাবে শামিল। বাঁজার অত্যুর তত্ত্বে সঙ্গত জোগানো ছিল তার বড় টার্গেট। সিনেমার নামেই তার ছাপ, ফরাসি Les Quatre cents coups-এর আরো একটি অর্থ হচ্ছে সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া । কাইয়্যে দুই সিনেমার চলচ্চিত্র সমালোচক থেকে চলচ্চিত্র পরিচালক হওয়া ত্রুফো, গদার, রোমার, রিভেত ও শ্যাব্রলরা ১৯৫৮-৬৪ পর্যন্ত সময়ে সিনেমা ভুবনের প্রচলিত সবকিছুই গুঁড়িয়ে দিয়ে শুরু করেছিলেন নতুন যুগের। ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ ঘরানাকেই ক্ল্যাসিকাল চলচ্চিত্র থেকে আধুনিক চলচ্চিত্র যুগে উত্তরণের যুগসন্ধিক্ষণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় এবং The 400 Blows এই যুগসন্ধিক্ষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
ত্রুফোর জীবন ও The 400 Blows
ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো ১৯৩২ সালে এক ১৯ বছর বয়সী কুমারীর গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন। তার মা গর্ভপাত চেয়েছিলেন কিন্তু তার মাতামহীর অনুরোধে ফ্রাঁসোয়া পৃথিবীর মুখ দেখতে পারেন (আন্তোইন এরও তাই)। ১৯৪২ সাল পর্যন্ত তিনি তার মাতামহীর কাছে লালিত হন। মাতামহীর প্রয়াণের পর তাকে আবার মা ও সৎ পিতার সংসারে ফেরত যেতে হয়। তাকে ঘিরে মা-বাবার সংসারে অশান্তির আগুন ঘনিয়ে ওঠে। সংসারের অশান্তিতে বিরক্ত ত্রুফো বই এবং বিশেষ করে চলচ্চিত্রের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দেন। যখনই সুযোগ পেতেন টাকা জমিয়ে বা চুরি করে সিনেমার টিকেট কেনার টাকা জোগাড় করতেন। ১৯৪৮ সালের মধ্যে ত্রুফোর নিজের ফিল্ম ক্লাব তৈরি হয়ে যায়। এই সময়ে ত্রুফো তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটির দেখা পান। কাইয়্যে দ্যু সিনেমার সম্পাদক আঁদ্রে বাঁজা, যিনি ত্রুফোকে সেনাবাহিনী থেকে পলায়নের অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে সহায়তা করেন। তাঁর হাত ধরেই কাইয়্যে দুই সিনেমাতে চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে যোগ দেন এবং খ্যাতি অর্জন করেন। এখানে প্রকাশিত হয় চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সব প্রবন্ধগুলো। ত্রুফো A Certain Tendency of the French Cinema তে আলোচনা করেন ফরাসি চলচ্চিত্র শিল্প সম্পূর্ণ নতুন করে ঢেলে সাজানোর কথা। বাঁজার কাছে তালিম নেন চলচ্চিত্র তত্ত্ব-তর্ক। ইতালির রবার্তো রোসেলিনি, জাঁ ককতোর সেট ঘুরে সিনেমার হাতে কলমে শিক্ষা অর্জন করেন। নিজের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের আগে ‘উন ভিসিত’ ও ‘লে মিসতোঁ’ নামের দুটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মাণ করে হাত পাকিয়ে নেন।
ত্রুফো প্রথমে নিজের আত্মজীবনী নির্ভর একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা ভাবছিলেন। প্রধান চরিত্র অ্যান্তোইন দোইনেল নামটি নিয়েছিলেন জ্যঁ রেনোয়ার সহকারী ও তার প্রিয়পাত্র জিনেত্তে দোইনেলের নাম থেকে। অনেকের মতে আসলে ত্রুফো এই নাম দিয়ে কাহিয়্যের দুই সিনেমার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দোনিওল ভালক্রোজকে সম্মান করে দিয়েছেন। কিন্তু আগের দুটি স্বল্পদৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্রের সাফল্যের পর ত্রুফোর স্ত্রী ম্যাডেলিনের বাবা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণেই অর্থ লগ্নি করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই সময়ে একটা পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গড়ে আড়াই লক্ষ ডলার খরচ হতো। ত্রুফো শুরু করেছিলেন ৭৫ হাজার ডলার হাতে নিয়ে। তিনি চিত্রনাট্য রচনা করার জন্য চিত্রনাট্যকার ও ঔপন্যাসিক মার্সেল মৌসিকে নিয়োগ করেন, কারণ তার প্রথম চলচ্চিত্রতে নিজের জীবনী সেলুলয়েডে প্রদর্শন করার চেয়েও বড় উদ্দেশ্য কাজ করছিল। ত্রুফোর গল্পটা আসলে হয়ে উঠল জ্যঁ পিয়েরে লিউডের। অডিশন দিতে আসা ৬০ জন কিশোরের মধ্যে ত্রুফো লিউডকেই পছন্দ করেন কারণ, তার সঙ্গে নিজের শৈশবের অনেক মিল খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। দুজনই ছিলেন সামাজিক প্রথাবিরোধী এবং সমস্যা সৃষ্টিকারী এবং দুজনই সিনেমার পোকা। ত্রুফোর অ্যান্তোইন দোইনেল হয়ে উঠে লিউড ও ত্রুফোর সম্মিলিত এক প্রতিবিম্ব।
পুরো শুটিংয়ের সময় ত্রুফো লিউডকে স্ক্রিপ্টের বাইরে গিয়ে নিজস্বতা ফুটিয়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করেন। এতে পারফরম্যান্সে যেন বাস্তবতাটা আরো প্রকট হয়ে ওঠে এবং ন্যারেটিভের মধ্যে প্রকৃত আবেগ সঞ্চারিত হয়। সিনেমার প্রোডাকশনের কাজ কোনো স্টুডিওতে নয় বরং সত্যিকারের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং, প্যারিসের রাস্তায় করা হয়েছে। স্কুলের শুটিং করা হয়েছিল ক্রিসমাসের ছুটির মধ্যে। ত্রুফোর সিনেমার শুটিংয়ের প্রথম দিনেই তার শিক্ষাগুরু বাঁজা দীর্ঘদিনের যক্ষ্মায় ভুগে না ফেরার দেশে চলে যান। বাজিনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিজের প্রথম সিনেমা উৎসর্গ করেন ত্রুফো।
ত্রুফোর জীবনের মতোই অ্যান্তোইন তার মা-বাবার সঙ্গে একটি নিম্নমধ্যবিত্ত অ্যাপার্টমেন্টে বাস করে। ধৈর্যহীন মা এবং অনুমেয় মনোভাবের সৎবাবার সঙ্গে বসবাস অ্যান্তোইনের জন্য অনেক কষ্টকর। সন্তানের সামনেই একে অপরের বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন তোলা এবং বিচ্ছিন্ন আচরণে নিজেদের সন্তানের দায়িত্ব পালনের অযোগ্য মা-বাবা হিসেবে প্রমাণ করে। তবে গতানুগতিক চলচ্চিত্রের মতো চরিত্রগুলো একরৈখিক নয় বরং বেশ জটিলতা আছে এই দুজনের মধ্যে। অ্যান্তোইনের মা স্বার্থপর, উন্নতির জন্য নিজের অফিসের বসের সঙ্গে পরকীয়া করতে গিয়ে সন্তানের হাতে ধরা পড়ে যায়। আবার সন্তানের প্রতি তার আচরণের জন্য সে আবার অন্তর্জ্বালাও বোধ করে। এজন্য আবার তাঁকে দেখা যায় ঘর থেকে পালিয়ে যাওয়া অ্যান্তোইনকে ঘরে নিয়ে এসে নিজের হাতে গোসল করিয়ে তাকে মাতৃস্নেহে ভাসিয়ে দিতে। আন্তোইনের সৎ বাবা চরিত্রটিও জটিলতায় পরিপূর্ণ। সন্তানসহ কুমারী মেয়েকে বিয়ে করার মতো যথেষ্ট মানবিকতাও আছে তার মধ্যে। পরস্পরবিরোধী চরিত্রের অধিকারী বাবাকে প্রথমে আন্তোইনের বেশি কাছের মনে হয়, যদিও সে নিজের বাবা নয়। কিন্তু আবার তাকে দেখা যায় নিজের মিশেলিন গাইড হারিয়ে মেজাজ হারিয়ে ফেলে বিপরীত আচরণ করতে। তা ছাড়া সন্তানকে নিজের হাতে কিশোর সংশোধনাগারে দিয়ে আসার মতো অ-পিতৃসুলভ কাজটি করে আন্তোইনের বাবা দর্শকের মনে শেষ পর্যন্ত নিজের ব্যাপারে একটা ধাঁধার সৃষ্টি করে। স্কুলেও আন্তোইন শিক্ষকের হাতে নানাভাবে নিপীড়িত হয়। তার অসহায় অবস্থা দেখে দর্শকের মনে সমবেদনা তৈরি হতে পারে কিন্তু তার চরিত্রও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। বাবার মিশেলিন গাইডটি চুরি করেও অস্বীকার করে সে। হোমওয়ার্ক না করে স্কুল ফাঁকি দিয়ে বন্ধু রেনের সঙ্গে সিনেমা দেখে এবং কার্নিভালে ঘুরে বেড়ায়।
কার্নিভাল থেকে ঘরে ফেরার পথে অ্যান্তোইন দেখতে পায় তার মা অন্য একজন পুরুষকে চুমু খাচ্ছে। মা-ছেলের মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে দুইজনই দুজনের থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। দুজনই অপরাধী, একজন বিবাহ বহির্ভূত প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে, অন্যজন স্কুল ফাঁকি দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পরের দিন স্কুলে গিয়ে স্কুল মিস করার কারণ হিসেবে বলে তার মা মারা গেছে। স্পষ্টতই সেটি মার প্রতি রাগ থেকে। এই কথা শুনে শিক্ষক তার প্রতি সমবেদনা জানায়, কিন্তু স্কুলে এসে তার বন্ধুদের সামনে বাবার হাতে চড় খেয়ে মিথ্যাবাদী অপবাদ পাওয়ার পর সে বাড়ি থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তী সময়ে তাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসার পর মা তাকে নিজের হাতে গোসল করিয়ে মাতৃসুলভ স্নেহে আদর করে অ্যান্তোইনকে। সন্তানের কাছে নিজের গোপন অভিসার ধরা পড়ে যাওয়ায় সেটি যাতে প্রকাশিত না হয়, সেজন্য তাকে অর্থলোভ দেখায় তার মা। যদিও সংলাপে বিষয়টি উহ্য ছিল। ছাত্র হিসেবে ত্রুফো একবার স্কুলে তার বাবাকে নাৎসিরা ধরে নিয়ে গেছে বলে শিক্ষকরা বলেছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে ১৯৬৮ সালের দিকে একজন প্রাইভেট ডিটেক্টিভ আবিষ্কার করেন যে ত্রুফোর জৈবিক বাবা ছিলেন একজন ইহুদি ডেন্টিস্ট। আন্তোইনের ক্লাসে ইংরেজি শিক্ষার সময় একজন ছাত্র Where is the father? উচ্চারণ করতে সমস্যায় পড়ে। এই প্রশ্নই পুরো সিনেমাজুড়ে প্রতিবিম্বিত হয়েছে। ত্রুফোর জীবনে সত্যিকারের মা-বাবার অনুপস্থিতি বিশেষ করে একজন বাবার অনুপস্থিতিই ছিল The 400 Blows-এর চলমান আবহ।
অ্যান্তোইনের খাপছাড়া আচরণের কারণ একজন বাবার অনুপস্থিতির কারণে হতে পারে। কিন্তু ত্রুফো এটিও দেখিয়েছেন পৃথিবী একটি অন্যায্য জায়গা যেখানে খারাপ আচরণ করে যে শাস্তি পেতে হয় ভালো আচরণ করেও একই শাস্তি পেতে হয়। মার অর্থের লোভে পড়াশোনা করে খুব ভালো রচনা লেখার পরও শিক্ষক তাকে চুরি করে লেখার শাস্তি দেয়। অথচ সে বিখ্যাত ফরাসি লেখক ও দার্শনিক বালজাকের La Recherche de l’Absol পড়ে মুখস্থ করে লিখেছিল। এমনকি ঘরে বালজাকের ছবির নিচে মোমবাতি জালিয়ে শ্রদ্ধাও পোষণ করে সে। কিন্তু ঘরে আগুন লেগে যাওয়ার পর আবার গণ্ডগোল বেধে যায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি পারিবারিক ভাবে সিনেমা দেখতে যাওযার সিদ্ধান্তে আপাত সমাধান হয়। বালজাকই ছিল তার ঘরে টিকে থাকার একমাত্র সুতো। তাকে হারিয়ে আবার বাড়ি ছেড়ে চলে যায় অ্যান্তোইন। আশ্রয় নেয় বন্ধু রেনের বাড়িতে, যার মা-বাবাও তার মতোই থেকেও নেই। এই দুজন স্বল্প সময়ের জন্য সম্পূর্ণ স্বাধীন জীবন-যাপন করে। অ্যান্তোইনের বাবার অফিস থেকে টাইপরাইটার চুরি করার আগ পর্যন্ত এই দুজন সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল। টাইপরাইটারটি বিক্রি করতে ব্যর্থ হয়ে অফিসে ফিরিয়ে দিতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় অ্যান্তোইন। অ্যান্তোইনের ব্যাপারে তার মা-বাবা হাল ছেড়ে দেয় এবং তাকে কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর জন্য তাদের অভিভাবকত্বর অধিকার সম্পূর্ণভাবে সংশোধনাগারের কাছে অর্পণ করতে হয় লিখিতভাবে। অ্যান্তোইনকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হলে তাকে এক রাত পুলিশ হাজতে দাগি অপরাধী ও পতিতাদের সঙ্গে কাটাতে হয়। ত্রুফোর জীবনেও কাছাকাছি একটি ঘটনা ঘটেছিল। সিনেমা ক্লাব করতে গিয়ে ১৭ বছর বয়সী ত্রুফো অনেক দেনার সম্মুখীন হন বলে তাঁর সৎ বাবা তাঁকে পুলিশে সোপর্দ করেন এবং এরপর একটি কিশোর সংশোধনাগারে তাকে তিন মাস কাটাতে হয়।
সংশোধনাগারে একজন মনোবিদ যাকে স্ক্রিনে কখনো দেখা যায়নি, অ্যান্তোইনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। প্রায় একই রকম একটি দৃশ্য আছে সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ সিনেমাতে যখন সিদ্ধার্থকে তার রাজনৈতিক গুরু রেস্টুরেন্টের টেবিলে বসে বিভিন্ন প্রশ্ন করে তার মনের অবস্থাটা সেলুলয়েডে ফুটিয়ে তুলে। অ্যান্তোইনের চরিত্রে অভিনয় করা লিউড এই সিকুয়েন্সে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে প্রশ্নের উত্তর দেয়। এখানে সে স্বীকার করে ত্রুফোর মতো তার মাও তাকে জন্ম দিতে চায়নি কিন্তু এই কথাও স্বীকার করে যে তাকে পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ করে দেওয়া মাতামহীর কাছ থেকে টাকা চুরি করেছে। অ্যান্তোইন দোষ-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। সংশোধনাগারে অ্যান্তোইনের মা তাকে দেখতে আসে। অ্যান্তোইন চিঠি লিখে তার বাবাকে মায়ের গোপন প্রণয়ের কথা ফাস করে দিয়েছিল বলে জানা যায়। তখন তার মা এসে জানায় যে তাকে আবারও ফিরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা কিন্তু এখন আর তাকে নিয়ে আর কিছু করবে না তারা। সব ধরনের সম্পর্ক থেকে মুক্ত অ্যান্তোইন সংশোধনাগার থেকে পালায়। অ্যান্তোইনের মুক্তির পথে সমুদ্র যাত্রাটি দীর্ঘক্ষণ ধরে দেখানো হয় এবং শেষ পর্যন্ত সমুদ্রের পাশে অ্যান্তোইনের একটি ফ্রিজ ফ্রেম দিয়ে শেষ হয় সিনেমা।
ত্রুফোর ফ্রিজ ফ্রেম
নিউ ওয়েভ ছবির মধ্যে উদ্ভাবনী ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ দেখা গিয়েছিল ত্রুফোর কাজে। The 400 blows-এর শেষ দৃশ্যটি একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্তে পরিণত হয়। সত্যজিত রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র শেষ দৃশ্যেও সিদ্ধার্থের ফ্রিজ ফ্রেম দিয়ে শেষ হয়। ত্রুফোর শেষ দৃশ্যটির অনেক রকমভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কারো মতে, এই শটের মাধ্যমে ত্রুফো অ্যান্তোইনকে একজন বিপ্লবী তরুণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কারো মতে এটি ছিল প্রকৃত অর্থে সিনেমাটিক পোট্রেট। ত্রুফো এমন মূহূর্তে ফ্রেমটি ফ্রিজ করেছিলেন যখন অ্যান্তোইন তার জীবনের সন্ধিস্থলে অবস্থান করছে। তার পেছনে পারিবারিক ও মানসিক দুঃখ পরিপূর্ণ জীবনের দুঃসহ ইতিহাস অর্থাৎ পেছনে ফেলে আসা কিশোর সংশোধনাগার এবং সামনে অসীম সম্ভাবনা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সমুদ্র। ফ্রেমের ঠিক মাঝখানে অ্যান্তোইনের মুখ, ফেলে আসা অতীতে কিছুটা বিবর্ণ আবার ভবিষ্যতের সম্ভাবনায় উজ্জ্বল। এই দ্ব্যর্থকতা তৈরির কারণ হচ্ছে ওই সময়ে অভিনেতা লিউডের মুখের প্রকাশভঙ্গি দেখে পরিষ্কার কোনো কিছু বোঝা সম্ভব নয়। ফরাসি সংস্কৃতিতে যেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি তাঁর মোনালিসা নিয়ে ফিরে এসেছিলেন ত্রুফোর নান্দনিক পরিচালনার হাত ধরে।
ইতালিয়ান নিও রিয়ালিজম দ্বারা প্রচণ্ড প্রভাবিত ত্রুফো নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবন আলেখ্য ফুটিয়ে তুলেছেন। সত্যিকারের লোকেশন শুটিং ও বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে বাস্তবতা ছাপিয়ে শিল্প হয়ে উঠে। অ্যান্তোইন ও রেনের স্কুল ফাঁকি দিয়ে কার্নিভালে কাটানোর কথাই বিবেচনা করা যাক। সম্পাদনার মাধ্যমে স্পিনিং হুইল ও উপরের দৃশ্যের সংযোগ স্থাপিত হয়। ত্রুফোর সহজে বহনযোগ্য ক্যামেরা আমাদের স্পিনিং হুইলের ভিতরে নিয়ে যায়। স্পিনিং হুইলে উল্লসিত অ্যান্তোইনের মাথার মধ্যে গা গুলানো ভাবটা দর্শকের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। পুরো সিনেমাতেই এমন কিছু চমক রয়েছে যেমন এই সিকুয়েন্সের পরই হঠাৎ করে আবার অ্যান্তোইনের মায়ের পরপুরুষকে চুমু খাওয়ার দৃশ্য যা কারো পক্ষে এই অবস্থায় অনুমান করা অসম্ভব ছিল। তৎকালীন বাজারমুখী সিনেমা শিল্পের সমালোচনাও করেছেন। তখন ফরাসি পরিচালকরা বহুপ্রজ হয়ে উঠেছিলেন। বছরে দুই-তিনটি সিনেমা নির্মাণ করতেন তারা। তাঁদের সমালোচনা ত্রুফো করেন একটি সিকুয়েন্সের মাধ্যমে, প্রথমে অ্যান্তোইন বাজার করতে গিয়ে দুই নারীর কথোপকথন শুনে যেখানে তারা অনেক বেশি সন্তান নেওয়া নারীদের সমালোচনা করছে। বাবার সঙ্গে ঘরে ফেরার পর অ্যান্তোইনের মাকে জানানো হয় যে তার এক বোন আবার গর্ভবতী হয়েছে। শ্লেষের সঙ্গে অ্যান্তোইনের মা উত্তর দেয় যে চার বছরে তিনবার! এত খরগোশের চেয়েও খারাপ অবস্থা!
যদিও The 400 Blows প্রথম নিউ ওয়েভ সিনেমা নয় তারপরও এই সিনেমার মাধ্যমেই নিউ ওয়েভ আন্দোলন সারা বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালকের পুরস্কার জেতার পর The 400 Blows সারা ফ্রান্সে সমাদৃত হয় এবং দারুণ আর্থিক সাফল্য অর্জন করে, যা নিউওয়েভ মুভমেন্টের জন্য অনেক বড় একটি সাফল্য ছিল। ফ্রান্সে সাফল্য পাওয়ার পর দ্রুতই সারা বিশ্বে ত্রুফোর নাম ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের সিনেমা বিশ্লেষকরা একবাক্যে ত্রুফোর প্রথম সিনেমাকে মাস্টারপিস বলে আখ্যায়িত করতে থাকেন। অস্কারে সেরা মৌলিক চিত্রনাট্যের জন্য মনোনয়নও মিলেছিল ত্রুফোর। অ্যান্তোইন নামটি ত্রুফো ও লিউডের সঙ্গে সারাজীবন সমার্থক থেকে যায়। ১৯৬২ সালে ‘অ্যান্তোইন অ্যান্ড কলেত্তে’ (Antoine and Collette) নামে শর্ট ফিল্ম এবং ১৯৬৮ সালে Stolen Kisses এবং ১৯৭০ সালে The pleasant Bed and Board নির্মাণ করেন। প্রতিটি সিক্যুয়েল নিজস্বগুণে গুণান্বিত। কিন্তু The 400 Blows ছিল ত্রুফোর জন্য বিশেষ কিছু। সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম সেরা দৃশ্য হচ্ছে এই সিনেমার শেষে ফ্রিজ ফ্রেমটি। গদারের Breathless, ত্রুফোর Shoot the Piano Player ও Jules and Jim নিউওয়েভ আন্দোলনের প্রধান ছবি হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। তিনি সহ কাহিয়্যের দু সিনেমা জার্নালের লেখকরা যা বছরের পর বছর ধরে করার আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন সেটিই ত্রুফো প্রথম সেলুলয়েডে ফুটিয়ে তুলেন। কিন্তু অন্য যেকোনো সিনেমা থেকে ত্রুফো কালজয়ী মাস্টারপিস তাঁর সাংস্কৃতিক গণ্ডি পেরিয়ে পৃথিবীর সর্বত্র বয়ঃসন্ধিকালের আবেগকে স্পর্শ করতে সমর্থ হয়েছে।