গল্প

ঐন্দ্রিলা

Looks like you've blocked notifications!

রাত ১০টা বাজলেই ঐন্দ্রিলার মনটা যেন ঘরে টেকে না, বাইরের বাতাসের গন্ধটা মাখতে বড্ড ইচ্ছে হয়। মা যতই নিষেধ করুক, বাইরে নারীদেহের অপেক্ষায় থাকা হায়েনাদের ভয় দেখাক, ইনিয়ে বিনিয়ে অনুরোধ উপযোগ করে ঠিকই সে বেরিয়ে যায় বাসার সামনে বড় ব্যস্ত রাস্তাটায় হাঁটতে। কখনো চুপিসারে, আলগোছে, কাউকে না বলে  একজোড়া চপ্পল পায়ে গলিয়ে টুপ করে বেরিয়ে দূষণ কম আসা বাতাস গায়ে মাখে সে। ইদানীং সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মীরা রাতে রাস্তাসাফে বের হয়, ঐন্দ্রিলার স্বস্তির সময়ে এটা এক অস্বস্তির জন্ম দেয়, এমনিতে সে সর্দি হাঁচির জন্মরোগী। আজও সে তেমনি কাউকে না বলে বেরিয়ে গেল। বাসার সামনে চার লেনের ডিভাইডার যুক্ত রোডটা বেশ সুন্দর, বাংলাদেশের বাস্তবতায় একটু ব্যতিক্রমই বলতে হবে।

মাঝের ডিভাইডারে নেই কোনো ইউক্যালিপটাস গাছ, বরং বনজ ও মৌসুমি ফুলের গাছই বেশি।

মেয়ে হওয়ার কিছু অসুবিধা আর অস্বস্তি ঐন্দ্রিলাকে টের পেতেই হয়, যেমন ওই যে টঙের দোকানে চা খেতে তার বড্ড ইচ্ছে করছে।

কিন্তু একাকী চায়ের অর্ডার দিলে অজস্র চোখ তার সামনে পেছনে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়বে।

অল্প কিছু দূরত্বে রাস্তার আবছা অন্ধকারে এক প্রৌঢ় নির্বিকারচিত্তে জলবিয়োগে ব্যস্ত। ঐন্দ্রিলার অস্বস্তি হয় না, বরং হাসি পায়। আচ্ছা, ঠিক এ কাজটাই যদি কোনো মেয়ে করত, ধরা যাক সে সত্তর বছরের বৃদ্ধা, তবে কি হতো?  ঐন্দ্রিলা অকারণে হেসে উঠে, আশপাশের চোখগুলো তার দিকে ফিরতে শুরু করেছে। নাহ, আর থাকা যাবে না এই জায়গায়।

মোড়ের ফুলের দোকানগুলোতে আজ অনেক ব্যস্ততা। কাল নতুন বছরের প্রথম দিন বলে কথা, রংবেরঙের ফুলের সৌন্দর্যে যেন দৃষ্টিবিভ্রম হওয়ার দশা। রিকশায়, ঠেলাগাড়িতে নানা জায়গা হতে ফুল আসছে। দোকানের কিছু কর্মচারী ফুলের মালা, কেউ কেউ চাকতি বানাতে ব্যস্ত, ইদানীং এই চাকতিগুলো কিশোরী, তরুণী এমনকি বৃদ্ধাদের মাঝেও বেশ জনপ্রিয়। ঐন্দ্রিলা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার আশপাশে অনেক রেস্টুরেন্ট, কোনোটা খুব সাধারণ, আবার চাইনিজ, ফাস্টফুড, কন্টিনেন্টাল ফুডের রেস্টুরেন্ট আছে অনেক। সবগুলোতে বেশ ধোয়ামোছার কাছ চলছে, কিছু কিছুতে কালকের পান্তা ইলিশের ব্যানার চলে গেছে, কিছুতে স্পেশাল বা সেট মেন্যুর। দিন হলো ঐতিহ্যের, কিন্তু সে ঐতিহ্যই এখন ব্যবসার বড় পুঁজি।

ঘড়িতে রাত ১১টা বাজে প্রায়। না, আর থাকা যাবে না, মা অনেক টেনশন করবে। ঘাড় ঘুরাতে দেয়ালে সাঁটা পোস্টার চোখে পড়ল –বিজাতীয়, হিন্দুয়ানী উৎসব পরিহার  করুন, মঙ্গল শোভাযাত্রার নামে বেল্লেলেপনায় অংশগ্রহণ হারাম। ঐন্দ্রিলা ভেবে পায় না পহেলা বৈশাখ কবে হতে বিজাতীয় হলো, এই উৎসবই যদি বিজাতীয় হয়, তবে নিজস্ব কী? চৌদ্দ শতকেরও বেশি পুরনো বাংলা নববর্ষ, তা শুধু হিন্দুরই কীভাবে হয়? দিনকে দিন গোঁড়া আর সংকীর্ণ হতে হতে নিজেদের দেয়ালের দিকে। চাপা দিতে নিয়ে যাচ্ছি। পাশে ফুচকার দোকানে বেশ উচ্চস্বরে হাসির শব্দ তিনটা ছেলের জটলা থেকে। এক ছেলে আরেক ছেলেকে বলছে- তোর গার্লফ্রেন্ডকে বলে দিস কাল পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবস না। এর আগে টিভির ইন্টাভিউয়ে তে একুশে ফেব্রুয়ারি বলে কী ধরাটাই না খেল। আরেক ছেলে কিছুটা তারস্বরে বলে উঠল –সালটাও বলে দে, পহেলা বৈশাখ বলতে পারলেও সালটা নিশ্চিত মিস করে যাবে। যাকে উদ্দেশ্য করে এত কথা বলা, সে এবার ঠোট নাড়িয়ে উঠল –ওসব বাদ দে তো। শোন মামা, কালকের জন্য ও সেই রকম একটা শাড়ি নিছে, সাথে হাতকাটা ব্লাউজ, আমি তো কল্পনা করতেই পুরা মাথা খারাপ অবস্থা। চারদিকে এত ভিড় থাকবে যে কাল ঠিকমতো আদরও করতে পারব না। বাকি দুজন উচ্চস্বরে হেসে উঠে। ঐন্দ্রিলা আর দাঁড়াতে পারে না, হাঁটতে শুরু করে। ছেলেগুলোর কথা ও আওয়াজ আস্তে আস্তে কমে আসতে লাগল, নিশ্চিতভাবে কথাগুলো আদিম রসের দিকে যাত্রা করেছে।

বাসার লিফটের কাছে পৌছাতেই পাঁচতলার আন্টি আর তার ছোটমেয়ে সুবাহর সাথে দেখা। অন্য মহিলারা যেমন রাত ১১টার পরে কোনো মেয়েকে ঘরে ঢুকতে দেখলে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে থাকে এ মহিলা তেমনটি নন, বেশ হাসিখুশি। তবুও আজ মামেয়েকে কেমন যেন মনমরা লাগছে। কুশল বিনিময় করতে করতে লিফটে উঠে ঐন্দ্রিলা প্রশ্ন করল –আন্টি, সুবাহর কি মন খারাপ? মেয়েটার চোখগুলো যেন ঐন্দ্রিলার প্রশ্নের সমর্থনে আরো করুণ হয়ে উঠল। এবার আন্টি বকে উঠল –দেখ না মা, দুপুর থেকে জ্বালিয়ে মারছে কাল নাকি ওর ফ্রেন্ডদের সাথে বের হবে। বল, দেশের এই অবস্থায় কি এভাবে একটা মেয়ে বের হতে পারে? ঐন্দ্রিলা একটু অবাক হয়, বলে –কেন? কী হয়েছে? আন্টির যেন ঠোঁট ঝুলে পরে –কেন মআআনে? পত্রিকা পড় না? নিউজ দেখ না? দেশটা কি মেয়েদের জন্য আর সেইফ আছে? ঐন্দ্রিলার মুখটা একটু কালো হয়ে যায়, লিফট ও পাঁচতলায় এসে থামে। কি যেন ভেবে ঐন্দ্রিলা আন্টিদের সাথেই লিফট থেকে নেমে যায়, পাশ ফিরে ভদ্রমহিলা তাকে দেখে বেশ অবাকও হয়। ঐন্দ্রিলা এবার বলে উঠে –আন্টি, বলেন তো কখন মেয়েদের উপর এমন অত্যাচার বন্ধ ছিল? এই দেখেন না আন্টি, দেশ বিভাগ, স্বাধীনতা যুদ্ধ সবসময়ই তো আমরাই বড় ভিকটিম ছিলাম, তাই বলে থেমে থাকব, বলেন? ধরেন আজ জঙ্গি হামলা, বোমা হামলা, নারীর ওপর হামলা এসব কারণে বের হলাম না। কী হবে তাতে? কিচ্ছু হবে না। ঘুরে দাঁড়াতে হবে। সুবাহকে যেতে দেন। উপরওয়ালা আছেন। এরপরও যদি কিছু হয় পুরো দেশকে একসাথে বিক্ষোভে ফাটিয়ে দেব, সবচেয়ে কম সময়ে বিচার করতে বাধ্য করব। কিন্তু আর পেছনে যেতে বলবেন না।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ঐন্দ্রিলা লিফট ছেড়ে সিঁড়ি ভেঙেই উঠতে শুরু করল। পেছন থেকে আন্টির হাঁ করা মুখ তাই সে দেখতে পায়নি। আটতলার তার ফ্ল্যাটের সামনে এসে ঐন্দ্রিলা দাঁড়াল, নিঃশ্বাস তার অনেক দ্রুত, কপালে হালকা ঘাম। তিন বছর আগের স্মৃতি তার নিউরনে এখনো ভেসে বেড়ায়। অনেকগুলো হাত, কোনোটা তার বুকে, কোনোটা পাছায়। পেছনে গলার কাছে ঠোঁটের স্পর্শ পাচ্ছিল সে। এখন সে ভাবে- একটু যদি সাহস করতে পারতাম, অন্তত পায়ের একপাটি জুতা হাত পর্যন্ত আনতে পারতাম, বা গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিতে পারতাম! অন্তত তাদের একজনকেও যদি গায়ের সব জোড় দিয়ে আটকে রাখতে পারতাম দুঃস্বপ্নগুলো এখনো তাড়িয়ে বেড়াত না।