শ্রদ্ধা

গালি কি শুধু ওদের দেই? নিজেকেও দেই : মুহম্মদ খসরু

Looks like you've blocked notifications!

খুব কম মানুষের বিয়োগ-ব্যথা আমাদের কর্মক্ষেত্রকে, আমাদের নিত্য পরিচিত সংসার-সমাজকে আচ্ছন্ন করে রাখে। সেইসব মানুষের শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য ও প্রধান বিস্ময় হলো প্রেম ও কাজ। ওমর খৈয়াম মুহম্মদ খসরু হচ্ছেন সেই রকম একজন মানুষ। চলচ্চিত্রাঙ্গনে তিনি পরিচিত মুহম্মদ খসরু নামে। ‘আজিজিয়ান’রা তাঁকে চেনে ‘গালি খসরু’ নামে। এই প্রসঙ্গে একদিন কথা হলে, তিনি বললেন, ‘গালিকে খুব খারাপ বলে মনে করো তুমি?’

আমার সমর্থনের তোয়াক্কা না করেই তিনি বললেন, ‘প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করাই আমার কাজ, কিন্তু এ জাতির মহান মানুষগুলার(?) চামড়া এত মোটা যে এদের কোনো ক্রিয়াই নাই। এইসব বিকৃত মানুষগুলা বড় মানুষ। এরই আমার নাম দিছে গালি খসরু। উপাধি দিতে বাঙালির কোনো কষ্ট নাই, যত কষ্ট কাজের বেলায়। মরে গেছে সব, পচে গেছে।’

এসব জানার পরও কেন প্রতিক্রিয়া দেখান, জানেনই যখন এতেও কোনো লাভ নেই?

উত্তরে খসরু ভাই বলেছিলেন, ‘কিছুই লোকসানে যায় না। গালি দিয়ে আমি বিরক্তমোচন করি।’ তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘অনাবশ্যকেরও কিছু আবশ্যকতা আছে। তুমি রবীন্দ্রনাথের ঐ কবিতাটা পড়েছ?’

কোনটা?

‘অনাবশ্যক।’

হ্যাঁ।

‘তাহলে তো তোমার বোঝার কথা আলো ছাড়া ঘরে অন্ধকার কখন গভীর হয়।’

কিন্তু অনাবশ্যকের যে আনন্দ, যে সৌন্দর্য তা তো সবখানেই ছড়িয়ে আছে। আপনি কেন তার বিরহে অন্ধকার ঘরখানিকে একলা বেছে নিলেন?

‘তোমার লক্ষ প্রদীপ জ্বলাও তো অকারণ, কিন্তু সেই প্রদীপ করধৃত মানুষ কই যে আমি সেই আলোয় স্নাত হবো?’ অভিমানে কণ্ঠস্বর নরম হয়ে ওঠে খসরু ভাইয়ের। ‘এ কারণেই আমি বিচ্ছিন্নতার বেদনা নিয়ে একাই থাকি, একাই বিরক্ত হই, একাই বিরক্তিমোচন করি, গালি দেই। গালি কি শুধু ওদের দেই? নিজেকেও দেই।'

পূর্ববঙ্গে, ১৯৬৩ সালে সর্বপ্রথম চলচ্চিত্র সংসদ গঠন করেন মুহম্মদ খসরু, আনোয়ারুল হক খান, মোশাররফ হোসেন, কলিম শরাফী, মনিরুল আলম, ওয়াহিদুল হক প্রমুখ। এরাই তখন চলচ্চিত্র আন্দোলনে নিযুক্ত হন এবং চলচ্চিত্র বিষয়ে গভীর চিন্তাশীল লেখা প্রকাশ করতে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৮ সালে মুহম্মদ খসরুর সম্পাদনায় বের হয় চলচ্চিত্র আন্দোলনের মুখপত্র 'ধ্রুপদী'।

দুর্দান্ত সব লেখায় ঠাসা পত্রিকা ধ্রুপদী। চলচ্চিত্র চর্চার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ফিল্ম স্টাডি সেন্টার। তার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র আন্দোলনের ফলে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ ও জাতীয় ফিল্ম আর্কাইভ। কিন্তু তা মুহম্মদ খসরু কিংবা তাঁর সহকর্মীদের প্রত্যাশাকে পূরণ করতে পারেনি। এই আর্কাইভের দৈন্যদশা দেখে দেখে রক্তাক্ত হয়েছেন তিনি। সরে এসেছেন মধ্যমাঠ থেকে। আর গালি দিয়ে গেছেন এই প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের। লাভ কিছু হয়নি। সকলে তাঁকে একলা করে দিয়েছেন, এড়িয়ে গেছেন। তবে সমীহ করেছেন সকলেই।

বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়লেও বয়সের কাছে হার মানেননি। একাই কেরানীগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসতেন। বসুন্ধরা কিংবা আজিজে ঘুরতেন। কাঁটাবনেও আসতেন। সব থেকে আজিজ মার্কেটই ছিল তাঁর প্রিয় জায়গা। তীব্র শ্বাসকষ্ট বা ব্রঙ্কাইটিস নিয়ে তিনি একাই চলতেন। দুকদম হাঁটার পর ইনহেল করতে হতো, তবু তিনি একাই বইপত্র কিনতেন। আতিক থাকতেন তার সঙ্গে। বয়সের কথা বললেই ধমকে উঠতেন। আমাকে একদিন বললেন, ‘বয়স ডাজন্ট ম্যাটার বায়িং বুক।’ মাথা ঝাকালাম হেসে। রাতে ঘুমান না। জেগে জেগে সিনেমা দেখতেন আর বই পড়তেন। নিজের সব সম্পত্তি তিনি ‘ফিল্ম ইনস্টিটিউট’-এর নামে ট্রাস্টি করে দিয়েছেন। তিনতলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। সম্পন্ন হয়েছে এক তলার কাজ। সেখানে গড়ে তুলেছেন লাইব্রেরি। চলচ্চিত্র বিষয়ক বইপত্রে ঠাসা শেলফ। একাই তিনি ডুবেছিলেন নিজের ভুবনে। চলচ্চিত্রের প্রেমে ও সৌন্দর্যে।

নিন্দুকেরা হয়তো বলবেন কী এমন কাজ আছে তার? যে প্রেমের কোনো বিকাশ নেই, প্রকাশ নেই তাতে লাভ কী?

আমি বলব বিচ্ছিন্নতার বেদনা নিয়ে তিনি যে জমিন তৈরি করে দিয়েছেন তাই বা কজন পারে? মুহম্মদ খসরু হলেন এমন একটি দীপ যে অকারণে একাই জ্বলে, এই অকারণ জ্বলার উদ্দেশ্যেই ছিল লক্ষ প্রাণের সম্মিলনে জ্বলা। তার সেই মহত্তম উদ্দেশ্য অন্তিম সময়েও নির্বাপিত হয়নি। বরং আমরা অনাবশ্যক অন্ধকার তৈরি করে তাঁকে ঠেলে দিয়েছি সেই গহ্বরে।

‘ধ্রুপদী’ সংখ্যাগুলো নিয়ে বই প্রকাশের আকাঙ্ক্ষা ছিল তার। বড় একটা প্রকাশনীতে কথাও হয়েছিল এ বিষয়ে। স্ক্রিপ্টও জমা দিয়েছিলেন। চার বছর যায় তবু ‘ধ্রুপদী’ বই আকারে বের হলো না! একদিন জানালেন, ‘ওরা আমার মৃত্যুর অপেক্ষা করছে।’ আমি ভাবতে পারলাম না এ কোন দেশে বাস করছি আমরা। আমাকে তিনি প্রমাণও দিলেন লোক ডেকে। বলতে বলতে ফ্যাকাশে হয়ে হয়ে উঠছিল তার মুখমণ্ডল। আমি তাঁর হাতের ওপর হাত রেখে বললাম, আপনি তো ফলবতী বৃক্ষ, আপনার ভয় কী? এ লজ্জা আমাদের। এরপর আমি যখন তাঁর কাজের প্রশংসা করে যাচ্ছিলাম তিনি রেগে গেলেন। বললেন, ‘থামো। তুমি না গবেষণা করো। পড়াশোনাও তো কম নয়। তুমি কি জানো না সিনিয়রদের প্রশংসা করতে নেই?’

আমি হাসলাম। এটা কেমন থিওরি খসরু ভাই?

‘সিনিয়ররা প্রশংসা করবেন জুনিয়রদের কাজের। এতে জুনিয়রা উৎসাহ পাবে, আরো ভালো কাজ করবে। কিন্তু জুনিয়ররা যখন সিনিয়রদের প্রশংসা করে মনে হয় যেন স্তাবকতা করছে। এ দেশ এভাবেই চলছে। তোষামোদ করে সিনিয়রদের নেকনজর পাওয়ার চেষ্টা। আমি আবার এই সব পছন্দ করি না। এ দেশের বুদ্ধিজীবীরা দেদার স্তাবক জন্ম দিচ্ছে। দেশে আজ আর মেরুদণ্ডী প্রাণী নাই। বুঝতে পারছ? এ দেশে কোনো ভালো সমালোচক নাই, সমাজবিজ্ঞানী নাই, মনোবিজ্ঞানী নাই, সম্পাদক নাই। তার মানে এ দেশে মানুষ জন্মায় না, জন্মায় মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান আর বৌদ্ধ।’ খসরু ভাইকে নিয়ে আলোচনা শেষ করা মুশকিল, কারণ তিনি কেবল চলচ্চিত্র নয়, দর্শনেরও একনিষ্ঠ সাধক ছিলেন। খুব ব্যক্তিগত এক প্রশ্ন করেছিলাম তাঁকে। আচ্ছা বিয়ে করলেন না কেন? প্রেমে ব্যর্থ হয়েছিলেন?

চকচকে এক হাসি উপহার দিয়েছিলেন সেদিন এবং বললেন, ‘আমি বোহেমিয়ান লোক, কোনো মেয়েই আমাকে বিয়ে করত না।’

বিয়ে আর প্রেম এক জিনিস নয়। আপনি কাউকে ভালোবাসতেন?

তিনি স্পষ্টভাবে বললেন, ‘আমার নায়িকা একান্ত আমার। তাকে নিয়ে কোনো রসাত্মক আলোচনা করে তাকে ছোট করতে পারি না।’

এই হলেন খসরু ভাই।

লেখক : গবেষক