আল মাহমুদ: গ্রহণ-বর্জনের দোলাচল

Looks like you've blocked notifications!

তাঁর সাথে আমার মুখোমুখি সাক্ষাৎ এবং শেষ বিতর্ক ১৯৯৪ সালে। কবি আবিদ আজাদের ‘শিল্পতরু’ পত্রিকা ও প্রকাশনীর দপ্তরে। তিনি ‘কাবিলের বোন’ উপন্যাসের কথা তুলে বলছিলেন— এই উপন্যাস লিখে আমি শেখ মুজিবের প্রতি আমার ঋণ শোধ করেছি।

আমার বলা কথাগুলোর কথা ভাবলে পরবর্তীকালে আমি নিজেকে ধিক্কার দিয়েছি শতবার। তাঁর মতো একজন কবির মুখের ওপর এমন কথা বলার ধৃষ্টতা আমি কেমন করে দেখাতে পেরেছিলাম! বলেছিলাম— আপনার এখন হয় লেখা বন্ধ করে দেওয়া উচিত, অথবা মরে যাওয়া উচিত। এই বইটি কোনো উপন্যাসই নয়। যে আপনি ‘পানকৌড়ির রক্ত’, ‘জলবেশ্যা’ লিখেছেন, সেই একই লেখক আপনি কীভাবে এত দুর্বল লেখা প্রকাশ করেন? মনে হচ্ছে আপনি শেষ হয়ে যাচ্ছেন। তিনি খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিবাদে কিছু বলেননি। গম্ভীর মুখে সিগারেট ধরিয়ে অন্যদিকে মুখ করে বসেছিলেন অনেকটা সময়। তারপর বলেছিলেন, ‘জাকির মিয়া, রক্ত গরম তোমাগো, গরম গরম কথা তোমাগো মুখে খারাপ লাগে না। সেই জন্যই কিছু কইলাম না। সময় হইলে সব বুঝবা। এমন ধরনের কথা আমারে কইছ কইছ, আর কাউরে কইও না। পরে নিজেই নিজের কাছে অনুতপ্ত হইবা।’

আল মাহমুদের জিয়া-এরশাদ সংস্রব নিয়ে মাথা আমার সত্যিই গরম ছিল। এর আগের বছর তিনদিন তিনি আমাদের সাথে নিবিড় সময় কাটিয়েছিলেন। তখন নিজের সম্পর্কে, সতীর্থদের সম্পর্কে, বিশেষ করে শামসুর রাহমান এবং তাঁর গোষ্ঠী সম্পর্কে অনেক কথা বলেছিলেন। কথা বলতে বলতে কখনো কখনো রেগে উঠতেন, কখনো কাঁদো কাঁদো হয়ে যেতেন। কিন্তু আমাদের মনে তখন এরশাদ সম্পর্কে প্রচণ্ড ঘৃণা। এখনো। তাই তাঁকে প্রশ্নের পর প্রশ্নে জর্জরিত করতাম।

পরে তো তিনি জামায়াতে ইসলামীর সাথেই সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়লেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ‘নাস্তিক’ আবদুল মান্নান সৈয়দকেও দেখলাম জামায়াতের আধুনিক প্রেস থেকে ‘সকল প্রশংসা তাঁর’ নামে কবিতার বই বের করতে। শুনেছিলাম রয়্যালটির নামে ভালো অঙ্কের টাকা পেয়েছিলেন তিনিও। আমি এবং আমার মতো অনেকেই তারপর আর যোগাযোগ করিনি তাঁর সাথে। তবে খেয়াল করতাম তাঁর কথাবার্তা। বিরক্ত হতাম। আবার সেই চক্রের মধ্যেই হঠাৎ হঠাৎ ঝলসে উঠতেও দেখেছি আল মাহমুদের কবিসত্ত্বা। যেমন, জামায়াত-সংশ্লিষ্ট এক কবিতার অনুষ্ঠানে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, কবিতাকে আপনারা ইসলাম দিয়ে বিচার করতে চাইলে ভুল করবেন। কবিতাকে ধর্ম দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। শাস্ত্র চিরকাল নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় শিল্পের কাছে।

পত্রিকায় পড়েছিলাম এসব।

আল মাহমুদের লেখার সাথেও যোগাযোগ কমে আসছিল আমার। কারণ যেসব পত্রিকায় তিনি বেশি লিখতেন, যেমন ইনকিলাব, পূর্ণিমা— সেগুলো আমি পড়তাম না। তবে অন্য পত্রিকার বিশেষ সংখ্যাগুলোতে তাঁর কবিতা পড়েছি। অর্থাৎ দূরে থেকেছি, কিন্তু তাঁকে বাদ দেওয়া সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে।

পৃথিবীর ইতিহাসে বড় বড় লেখক-কবির আদর্শচ্যুতির ঘটনা কম নয়। কেউ কেউ চিন্তাজগতের পরিবর্তনের কারণে আগের আদর্শ থেকে সরে গেছেন। কেউ কেউ অর্থ-বিত্ত-পুরস্কার-পদের মোহে আত্মসমর্পণ করেছেন। আল মাহমুদ সম্পর্কে শেষের অভিযোগটি বেশি শোনা গেছে। আট সন্তানের বিশাল পরিবারের ভরণ-পোষণ করতে হয়েছে তাঁকে। সেই সাথে আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিতির জন্য সরকারি সহযোগিতা না নিয়ে উপায় ছিল না তাঁর— এসব কথাও শুনেছি। কিন্তু তেমন গভীরভাবে ভাবিনি।

সুভাষ মুখোপাধ্যায় লাল ঝাণ্ডা ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দিলে এবং এরশাদের এশীয় কবিতা উৎসবে এলে তাঁকে নিয়েও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে এই দেশে। ভূপেন হাজারিকা বিজেপি থেকে ভোটে দাঁড়িয়েছেন শুনে তাঁর সমস্ত ক্যাসেট আমি ড্রেনে ফেলে দিয়েছিলাম এবং নির্বাচনে তিনি পরাজিত হলে খুব খুশি হয়েছিলাম। ভূপেন হাজারিকা পরে অবশ্য ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছিলেন। আমরাও তাড়াতাড়ি মন থেকে ক্ষমা করে নিজেরা ভারমুক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু আল মাহমুদের ক্ষেত্রে এমনটি হয়নি। তিনি ফিরে আসেননি। অথবা বলো চলে, ফিরে আসার পথ তাঁর জন্য রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল হয়তো। তাঁর সাথে যোগাযোগ হয়নি আমার। তবে মনে হতো তিনি মানসিকভাবে ঠিক স্বস্তিতে নেই। অন্তত থাকার কথা নয়। আমরা যেমন বুঝেছি, তিনিও নিশ্চয়ই বুঝতে পারতেন, প্রগতিশীল চিন্তা ধারণ করার সময় যেসব লেখা তিনি লিখেছেন, পরবর্তীকালের লেখাগুলো সেভাবে ঋদ্ধ পাঠকের কাছে গৃহীত হচ্ছে না। এই ভাষাতে সাম্যবাদ নিয়ে অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক গল্প-উপন্যাস-কবিতা লিখেছেন। কিন্তু কেউ-ই আল মাহমুদের মতো শিল্পোত্তীর্ণ ভাষায় বলতে পারেননি— ‘আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন’।

প্রেমের কবিতা প্রসব হয়েছে অসংখ্য। কিন্তু ‘সোনালী কাবিন’কে ছাপিয়ে যেতে পারেননি কেউ।

সেই আল মাহমুদকে এভাবে বিতর্কিত জীবন কাটাতে হলো শেষ দুই দশক।

২.

কবিতা বা কবিতার পঙক্তি মানুষের ঠোঁটে উঠে আসে তখনই যখন তা ঢুকে পড়তে পারে বুকের মধ্যে। বুকে বা হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়ার মতো কবিতা রচিত হয়েছে আমাদের দেশে পঞ্চাশের দশকে আহসান হাবিব, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান, সিকান্দার আবু জাফর, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কলমে। ষাটের রফিক আজাদ, আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ, মোহাম্মদ রফিক লিখেছেন তেমন কিছু কবিতা। শেষ ষাটে হেলাল হাফিজ, আর সত্তরে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পর্যন্ত এসেই এই তালিকা শেষ। এর পরে বা আগেও অন্য যারা লিখেছেন তাদের কবিতা খুঁটিয়ে পড়ে বের করতে হয় ভালো বা মন্দ লাগার অনুভূতি। তারা অনেকেই ভালো কবিতা লিখেছেন বটে, কিন্তু এমন কোনো কবিতা বা পঙক্তি রচনা করতে পারেননি যা কোনো কবিতাপ্রেমী নিজের অজ্ঞাতেই উচ্চারণ করে উঠবে একাকী মুহূর্তে অথবা বন্ধুসঙ্গ উপভোগ করার সময়।

আল মাহমুদ সেই দুর্গম জায়গাতে পৌঁছে গেছেন। চেতনে-অবচেতনে তিনি উচ্চারিত হন মানুষের ঠোঁটে ঠোঁটে। তাঁকে কি আর বর্জন করার কোনো অবকাশ থাকে!