কদিন বাদেই জ্ঞানের তীর্থে প্রাণের মিলন
আমাদের চেতনা ও বোধ বিনির্মাণের অনন্য সূতিকাগার যদি থেকে থাকে, তার প্রাণভোমরাটি বইমেলার অন্তরেই গাঁথা। সারাবছর না হোক, তবু একটি মাস জ্ঞান অনুসন্ধানী মানুষেরা বিচিত্র পুস্তকের সাগর থেকে মননের মুক্তো খুঁজবে। এইটুকু অনন্যতা আমাদের পরিচয়ের আলাদা বৈশিষ্ট্য যোগ করে বৈকি। স্মার্ট সময়ে ঘরে ঘরে, জনে জনে বাহারি যন্ত্রানুষঙ্গের আস্ফালন সত্ত্বেও কাগুজে বইয়ের আবেদন এতটুকু কমেনি। প্রাণজাগানিয়া ওই আনন্দ আবেদনের বাতিঘর হলো আমাদের প্রাণের বইমেলা। বইমেলা বিশ্বজুড়েই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের মেলা ভিন্নতর ও অসাধারণ। পৃথিবীর ইতিহাসে নিজের মাতৃভাষা রক্ষায় প্রাণদানের ঘটনা বেশ বিরল। তেমন একটা দিন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষাকে সামনে রেখে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় প্রতিবছরের মতো এবারও ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে শুরু হতে যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। এইক্ষণে আমাদের সমস্বর উচ্চারণ হোক, জ্ঞানের তীর্থে জমুক তবে প্রাণের মিলন।
বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন আর বইমেলার বয়স সমান সমান। মহান মুক্তিযুদ্ধের অগণন ত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর ১৯৭২ সালে স্বল্প পরিসরে এই বইমেলা শুরু হলেও বাংলা একাডেমি আনুষ্ঠানিকভাবে এই মেলা শুরু করে তারও এক যুগ পরে, ১৯৮৪ সালে। যে মেলাটির বীজ রোপিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে। দিন দিন মেলার পরিসর ও বই বিক্রি বেড়েই চলেছে। পাল্লা দিয়ে মেলার পরিধিও বাংলা একাডেমি চত্বর ছাড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে গেছে। পাঠক, লেখক ও প্রকাশকের এই মিলনমেলা হয়তো আরো বিস্তৃত হবে। বইকে কেন্দ্র করে মানুষের যে সম্মিলন, তার পরিসর সম্প্রসারণ মানে দেশের সাংস্কৃতিক বিকাশেরই অনবদ্য স্মারক। এই মহাস্মারকীয় ইতিহাস সমৃদ্ধই হতে থাকুক।
বাঙালি আমুদে জাতি হিসেবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। দুজন মাত্র মানুষ একত্র হলেই সেখানে আড্ডার আনন্দ বাজিমাত করে। এমন বাস্তবতায় বইমেলার মতো অভূতপূর্ব সুন্দর মিলন তীর্থ তাই বাঙালির জাতীয় উৎসব। এখানে মানুষ বই কিনতে আসে, নতুন বইয়ের ঘ্রাণ শুঁকতে আসে, হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে ভাবনার জগৎকে শাণিত করতে আসে। বাংলা একাডেমি বরাবরের মতো এবারও বই ও লেখকদের নিয়ে পাঠ ও কথায় নানা আয়োজন সাজিয়েছে। নিত্যদিনের অনুষ্ঠানে থাকবে আলোচনা, কবিতাপাঠ, আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক উৎসব।
জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে আয়োজিত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাড়ম্বরে এবারের বইমেলাও উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলা ভাষার অন্যতম ক্ষুরধার কবি শঙ্খ ঘোষ এবং মিসরের অনুবাদক-সাংবাদিক মোহসেন আল-আরিশি।
বিগত কয়েক বছরে বইমেলার নিরাপত্তা ঘাটতির সুযোগে পেছনদিকে হাঁটা অন্ধকার গোষ্ঠীর অপঘাতে বিজ্ঞানমনস্ক ও মুক্তচিন্তক লেখকদের প্রাণহানির মতো ঘটনারও বাজে ইতিহাস রচিত হয়েছে। তেমন পরিস্থিতি বাংলাদেশে আর আসবে না বলেই আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ধুলোবালি, নিরাপদ খাবার ও নিরাপত্তা নিয়ে ফি বছরই পাঠক ও ক্রেতারা প্রশ্ন করে এসেছেন। এবার অবশ্য বাংলা একাডেমির নবনিযুক্ত মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী গণমাধ্যমে আগাম ঘোষণায় আশাবাদের কথা শুনিয়ে রেখেছেন। বইমেলা প্রসঙ্গে হাবীবুল্লাহ সিরাজী দৈনিক প্রথম আলোতে লিখেছেন, মেলার চলাচলের পরিসরের যেমন লাগবে স্বাচ্ছন্দ্যের হাওয়া, আবার তেমনি ক্লান্তি নিবারণে মিলবে ক্ষণিক বিশ্রামের উপকরণ। ‘শৌচাগারের অস্বস্তি যাতে সামান্যতম হলেও লাঘব হয়, তার জন্য নেওয়া হয়েছে যথাযথ ব্যবস্থা। পানীয় জল ও কফির পাশাপাশি নানা ধরনের খাদ্যসামগ্রী নিয়ে থাকবে সহনীয় মূল্যের রেস্তোরাঁ। নিরাপত্তা একটি অতীব জরুরি বিষয়, সঙ্গে আছে আগুন পানির দাপট। সার্বিকভাবে দেখভালের দায়িত্ব পালনে অবহেলার ছাড় নেই।’ আমরা বাংলা একাডেমি প্রধানের কথায় আশ্বস্ত হতে চাই। এবারের আয়োজন হয়তো বিগত দিনের জঞ্জাল দূর করবে। বই অনুরাগীরাও নিঃসংশয় ও নির্ভয়ে বইমেলার আনন্দ সরোবরে প্রাণভরে অবগাহন করতে পারবেন।
ডিজিটাল মাধ্যমের সহজলভ্যতায় বইয়ের কদর ফুরিয়ে যাবে, এমন ভাবনার ভাবুকদের জন্য বইমেলা একটা বড় শিক্ষা। এখনো মানুষ বই ভালোবাসেন। তবে এই ভালোবাসা ও আগ্রহটা যদি কেবল এক মাসের মেলাকেন্দ্রিক না হয়ে বছরজুড়েই চলত, তবে নিশ্চিতই আমাদের মেধা ও মননের জুতসই চর্চাটা হতো। বইমেলাকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশে লেখক ও প্রকাশকদের তাড়াহুড়ো করতে দেখা যায়। এতে মননশীল ও প্রভাব বিস্তারি বইয়ের তুলনায় যাচ্ছেতাই লেখ্যকর্মে স্টল ভরে যায়। এতে প্রকারান্তরে জ্ঞানের আলো ছড়ানোর পরিবর্তে পাঠকের ঠগবার সুযোগটাই বেশি সৃষ্টি হয়। তার ওপর ইদানীং অর্থের ঠাঁটবাটে প্রকাশক বাগিয়ে শখের লেখকদের লোকদেখানো বইপ্রীতিটা আরেক বিড়ম্বনার নাম। আগাছার মতো অগোছালো হাজার পুস্তিকার চেয়ে পরিশ্রম ও প্রজ্ঞায় নির্মিত জ্ঞানগর্ভমূলক একটা গ্রন্থই আমাদের পাঠককুলকে প্রশান্তি দিতে পারে। এমন স্বস্তিকর লেখক ও প্রকাশকের এখন বড়ই আকাল। দেশের অর্ধসহস্র প্রকাশককে ভাবতে হবে নামধারী লেখককুলের সেবা নয় কেবল, পাঠকের মন জয় করবার তরিকাটাও তাদের রপ্ত করা উচিত।
তবে আশার কথা হলো, অনেক প্রকাশক দেশব্যাপী ভ্রাম্যমাণ বইমেলার আয়োজন করে পাঠকের দোরগোড়ায় বই নিয়ে যাচ্ছেন। যে বই থেকে মানুষ দেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, মূল্যবোধ এবং বৈশ্বিক ভাবনা বিষয়ে জানতে পারছে। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এমন ভ্রাম্যমাণ বইমেলার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গেলে সত্যিকারের মানবমুক্তির মন্দির বিনির্মিত হতে পারে।
আমাদের বইমেলা হয়ে উঠুক আলোকপাঠের কেন্দ্রস্থল। সব দ্বন্দ্ববিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো, সেই ভালো আমাদের হোক। অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত হোক আলো। কুসংস্কার ও ঘৃণাবোধ রহিত হোক। মানুষের যুক্তিবোধ ও বিবেকের মুক্তির ঠিকানা হোক অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বইয়ের ভালোবাসায় রাবীন্দ্রিক সুরটাও অনুরণন তুলুক :
বিশ্বজনের পায়ের তলে ধূলিময় যে ভূমি
সেই তো স্বর্গভূমি।
সবায় নিয়ে সবার মাঝে লুকিয়ে আছ তুমি
সেই তো আমার তুমি।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।