মাহফুজুর রহমান স্মরণ

যাহা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না

Looks like you've blocked notifications!

দুইটা জিনিশ যাহাকে বলে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না—তাহার মধ্যে একটার নাম মৃত্যু। আজ পর্যন্ত এই দুনিয়ায় যত মানুষের পা পড়িয়াছে তাহাদের বেশির ভাগই মৃত্যুর অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছেন কিন্তু একজনও সেই অভিজ্ঞতার কাহিনী বলিয়া যাইতে পারেন নাই। মৃত্যুর অভিজ্ঞতা অকথ্য—তাহা কথায় প্রকাশ করা যায় না। মাত্র আরেক মানুষের—অপরের—মৃত্যুর মধ্য দিয়াই আমরা আপনাপন মৃত্যুর নিকটতম তুলনা কি তাহার আভাস পাইতে পারি।

সম্প্রতি আমার এমনই এক অভিজ্ঞতা হইয়াছে। বহুদিন হইল আমি এই ঢাকার শহরে বন্দী হইয়া আছি। একান্ত দায়ে না পড়িলে শহরের বাইরে যাই না। বিগত জুলাই মাসের বিশ তারিখ—সেদিন ছিল শুক্রবার—অগতির গতি মৌলভীবাজার গিয়াছিলাম। বলা বাহুল্য মৌলভীবাজার এখন একটি জেলার স্থানে উঠিয়াছে। এই জায়গাটি একদা সিলেট (দক্ষিণ) সদর বলিয়া অভিহিত হইত। সেখানে একদিনের কিছু বেশি সময় কাটাইয়া আমরা ঢাকা ফিরিয়াছি একুশে জুলাই।

প্রায় দশ বছর আগে আরও একবার মৌলভীবাজার গিয়াছিলাম। সেবারের অভিজ্ঞতার সহিত  এবারের বিদ্যার একটা প্রভেদ ঘটিয়াছে। সেবার গিয়াছিলাম নিজের উদ্যোগে এবং শহর হইতে দূরে—বলা যায় ঝর্ণায় আর জঙ্গলে। এবার গিয়াছিলাম শুদ্ধ একজন মানুষের টানে—এবং শহরে। মৌলভীবাজারের মাহফুজুর রহমানকে আমি প্রথম দিনের আলাপ হইতেই ‘মাহফুজ ভাই’ সম্বোধন করিয়া আসিতেছিলাম। তাঁহার সহিত প্রথম দেখার অনেক আগেই আমি তাঁহার লেখার সহিত পরিচিত ছিলাম।

মাহফুজ ভাইয়ের সহিত আমার প্রথম পরিচয় টেলিফোনযোগে। ঠিক কত তারিখে বা কোন ক্ষণে তাহা এতদিনে আর মনে নাই। প্রথম আলাপের কিছুদিনের মধ্যেই জানিতে পারিলাম আমার শিক্ষক আহমদ ছফার সহিত তাহার একপ্রকার আলাপ ও পরিচয় ছিল। জানিতে চাহিলাম আহমদ ছফার লেখা কোন চিঠিপত্র বা কোন অপ্রকাশিত লেখাজোকা তাহার মহাফেজখানায় আছে কিনা। জবাবে তিনি যাহা বলিলেন তাহাতে বড়ই শরমিন্দা হইলাম। তিনি জানাইলেন ইংরেজি ২০০৭ সাল নাগাদ তাঁহার লেখা একটি বহি ছাপা হইয়াছিল। বইয়ের নাম ‘নানা প্রসঙ্গ নানা ভাবনা’। সেই বইয়ে আহমদ ছফার একটি চিঠি বিলক্ষণ ছাপা আছে।

আমার অনুরোধে মাহফুজ ভাই তাঁহার বইয়ের প্রয়োজনীয় পাতাগুলি আমাকে গোটা দুইবার ফটোকপি করিয়া পাঠাইয়াছিলেন। সঙ্গে দিয়াছিলেন—তোহফাস্বরূপ—আহমদ ছফা লিখিত মূল চিঠিটির প্রতিচিত্রও। এই চিঠির ভূমিকাচ্ছলে তিনি নিজের জবানে আহমদ ছফা সম্পর্কে আর দুই কথাও লিখিয়াছিলেন। সেই দুই কথার মধ্যে আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কথিত নীরব মহাসিন্ধুর কল্লোল শুনিতে পাইয়াছিলাম। সংক্ষেপে—অতি সংক্ষেপে—মাত্র একটি অনুচ্ছেদের মধ্যে মাহফুজুর রহমান আহমদ ছফার ঐতিহাসিক মূল্য সত্য সত্যই নিরূপই করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। এই এক অনুচ্ছেদ পড়িয়াই আমি আবিষ্কার করিয়াছিলাম এমন একজন মানুষকে যাহাকে আহমদ ছফার যোগ্য উত্তরাধিকারী বলা যায়। এক্ষণে সেই অনুচ্ছেদটি উদ্ধার করিতেছি। আহমদ ছফার চিঠিটির ভূমিকার পরিবর্তে মাহফুজুর রহমান লিখিয়াছিলেন, ‘কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আলোকিত মনীষী আহমদ ছফা ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এক সব্যসাচী লেখক। চট্টগ্রামের গাছবাড়িয়ার আহমদ ছফা নিজের সমাজ-সংস্কৃতির ঘাত-প্রতিঘাত ভাঙ্গাগড়ার মধ্য দিয়েই একদিন আদর্শ সমাজের স্বপ্ন নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির আঙ্গিনায়। উচ্চতর মানব চৈতন্যের অধিকারী আহমদ ছফার সৃষ্টিকর্ম আমাদের ইতিহাসের এক মহৎ পর্ব—যা আমাদের আত্মপরিচয়ের ঠিকানার সন্ধানে অনস্বীকার্য।’

মাহফুজুর রহমানের কাছে লেখা—সম্ভবত একমাত্র—এই চিঠিতে আহমদ ছফা আশা প্রকাশ করিয়াছিলেন, তিনি একবার মৌলভীবাজার যাইবেন, শুদ্ধ কবে তাহা স্থির করিয়া লইতে হইবে। এই চিঠির দোহাই দিয়া মাহফুজুর রহমান শুদ্ধমাত্র লিখিয়াছিলেন, ‘তাঁর ইচ্ছে ছিল সিলেট ও মৌলভীবাজার ভ্রমণের। সিলেটের কথা এলে দুজনের কথা বলতেন। এঁদের একজন ষাটের দশকের কবি মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের অধ্যাপক শাহজাহান হাফিজ অন্যজন কবি দিলওয়ার। মৃত্যুর আকস্মিকতার কারণে তাঁর সিলেট অঞ্চল ভ্রমণের ইচ্ছা পূর্ণ হল না।’

মাহফুজুর রহমান

আমার সহিত যখনই টেলিফোনে কথা হইত তখনই মাহফুজ ভাই এই প্রসঙ্গটি মনে করাইয়া দিতেন। আক্ষেপ করিতেন আহমদ ছফার মৌলভীবাজার আসার ইচ্ছাটা অপূরণীয় হইয়া গেল। গত প্রায় এক বছর ধরিয়া তিনি আমাকে বলিতেছিলেন আমি যেন একবার মৌলভীবাজার আসিয়া আমার অকালমৃত শিক্ষকের অপূর্ণ ইচ্ছাটা স্পর্শ করিয়া যাই। অনেকটা এই যুক্তিতেই আমার অনিচ্ছাটা পরাজিত হইয়াছিল। মাহফুজ ভাই নিজেই আমাদের স্বাগত জানাইতে শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনে আসিয়াছিলেন। তাঁহার সঙ্গে আসিয়াছিলেন একজন তরুণ রাজনীতিবিদ, বৃত্তি হিশাবে যিনি আইন ব্যবসায়ের পাণিগ্রহণ করিয়াছেন। পরের দিন আমাদের বিদায় জানাইতেও তিনিই আসিয়াছিলেন। সঙ্গে আসিয়াছিলেন আরেকজন যিনি ব্যবসায়ে চিকিৎসাশাস্ত্রী কিন্তু প্রাণের তাগিদে কবি ও চিত্রশিল্পী। কে জানিত ট্রেনের জানালা হইতে পড়ন্ত বিকালের ঐ দেখাটাই হইবে আমাদের শেষ দেখা। এই বেদনা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

মাহফুজ ভাইয়ের সহিত আমাদের বিদায় জানাইতে যিনি শ্রীমঙ্গল আসিয়াছিলেন তিনি—কবি ও বৈজ্ঞানিক নজমুদ্দিন মহসীন—মাত্র একমাসের মাথায়—মোতাবেক তেইশে আগস্ট সন্ধ্যাবেলা—আমাকে প্রথম খবর দিলেন মাহফুজ ভাই সম্ভবত আর নাই। আমরা যতক্ষণ মৌলভীবাজার ছিলাম ততক্ষণই—কেবল  বিশ আর একুশ জুলাই তারিখের মাঝখানের রাতটা ছাড়া—মাহফুজ ভাই আমাদের সঙ্গে ছিলেন। মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয় আমাদের দাওয়াত দিয়াছিলেন। সেখানে মাহফুজ ভাইয়ের আলাদা মর্যাদাটা আমাদের চোখে না পড়িয়া যায় নাই। আমরা গিয়াছিলাম উদীচীর ছোট্ট কার্যালয়ে। সেখানে মির ইউসূফ ও তাঁহার সঙ্গীদের গান আমাদের মুক্ত করিয়াছিল। মাহফুজ ভাইকে এখানে সকলেই বলেন গবেষক। আমার মনে হইয়াছিল তিনি আসলেই কবি। বাংলাদেশের ইতিহাস সম্বন্ধে তাঁহার যে বোধ তাহা একমাত্র কবির পক্ষেই মানায়।

আগেই বলিয়াছি আমার মৌলভীবাজার যাত্রার আসল লক্ষ্য ছিল মাহফুজ ভাইয়ের সহিত দেখা করা। তিনি ছিলেন আমাদের মৌলভীবাজার যাত্রার রথ। আমার সে আশা পূর্ণ হইয়াছিল। কিন্তু আমরা এক কাঁদি কলাও বেচিতে পারিয়াছিলাম। ঘটনাচক্রে মহাত্মা কার্ল মার্কসের জন্মের দুইশত বছর পূর্ণ হইতেছে এই ইংরেজি ২০১৮ সালেই। এই উপলক্ষে শহরের টাউন হলে একটি ছোট্ট সমাবেশের আয়োজন করা হইয়াছিল। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির তরুণ নেতা অধ্যাপক অভিনু কিবরিয়া এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের প্রবীণ নেতা কমরেড রাজেকুজ্জামান রতনের সহিত সেই সমাবেশে আমিও উপস্থিত হইয়াছিলাম। আশা করিয়াছিলাম, ঐ সমাবেশে মাহফুজ ভাইও কিছু বলিবেন। কিন্তু তিনি কেন জানি নীরব থাকার মধ্যেই কার্ল মার্কসের শিক্ষা খুঁজিয়া পাইয়াছিলেন। এহেন বিনয় এ যুগে বড় বেশি দেখা যায় না।

একুশে জুলাই সকাল বেলা মাহফুজ ভাইয়ের ঘরে গেলাম। তাঁহার স্ত্রী এবং একমাত্র পুত্রের সহিত পরিচয় হইল। মাহফুজ ভাইয়ের লেখা আট-দশটি বইয়ের সহিত দেখাও হইল। তাঁহার কাছে লেখা আহমদ ছফার চিঠিতে পড়িয়াছিলাম এই কথাগুলি: ‘আপনার লেখা বিপিনচন্দ্র পালের জীবনীটা বেশ ভাল হয়েছে। আরো একটু বিস্তারিত লিখতে পারতেন। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিপিন পালের মতবিরোধের বিষয়টি স্পর্শ করলে গ্রন্থটি অধিকতর তথ্যবহুল হতে পারত। তবে বাংলা একাডেমী প্রকাশিত এই ধরনের গ্রন্থে খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো তুলে ধরার বিশেষ অবকাশ নেই। আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনি বইটি লিখে আমাদের সবাইকে অপরাধবোধ থেকে মুক্ত করেছেন।’

বিপিনচন্দ্র পাল—বলা নিষ্প্রয়োজন—জন্মিয়াছিলেন হবিগঞ্জে। যেমন জন্মিয়াছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাসও। মাহফুজ ভাই হেমাঙ্গ বিশ্বাসের একটা জীবনীও লিখিয়াছেন। তিনি আক্ষেপ করিয়াছিলেন বইটা প্রকাশ করিতে বাংলা একাডেমি দেরি করিতেছে। আমি অনুরোধ করিয়াছিলাম তিনি যেন একটু হালকা বোধ করিতেই আমাদের কাছে পাণ্ডুলিপিটা পাঠাইয়া দেন। একাডেমি না করিলে আমরা কোন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে বইটা ছাপাইতে বলিব। আমাদের সেই ইচ্ছাটা আর পূরণ হইল না।

৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮