প্রয়াণ দিবসের শ্রদ্ধা

মান্নান সৈয়দের আত্মার ইতিহাস

Looks like you've blocked notifications!

অবচেতনমনের ভাবনারাজি প্রকাশে মান্নান সৈয়দের ক্লান্তিহীন আনন্দ। এমন অনেক উপকরণ তিনি কবিতায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, যা সচরাচর দৃষ্টিগোচর হয় না। আবার এমনভাবে কবিতার পঙক্তিতে বিন্যস্ত করেছেন, যাকে চেতনমনের অতি-অভ্যস্ত পরিমাপক দিয়ে বিচার করলেও সহজে সবটা হৃদয়ঙ্গম হয় না। কোনো কোনো কবিতা তো এমনই—ধরা দেওয়ার জন্য সবটা জানালা সে খুলে দেবে না, কিংবা হৃদয়ের উষ্ণতা সঞ্চারণে সবটা সে মেলে ধরবে না। কিছুটা ইঙ্গিতে, কিছুটা ইশারায় কিংবা আভাসে যদি তার রহস্যের সামান্য আভা বেরিয়ে আসে, তাতেই কবিতা-কুহকের সার্থকতা। সদাকৌতূহলী হৃদয় কবিতা-রহস্যের সামান্য আভার পথ ধরেই কিছু না কিছু রসদ, কিছু মহার্ঘ খুঁজে পায়। এমন হৃদয়বাদীর জন্যই প্রকৃতপক্ষে মান্নান সৈয়দের কবিতা নিঃসীম আনন্দদানে অপেক্ষমাণ।

অবচেতনজাত উপকরণ বিন্যাসে যতই দুরূহতা থাকুক, মান্নান সৈয়দের কবিতার একটি নিউক্লিয়াস তাঁর সমগ্র কাব্যদর্শনে পূর্বাপর অঙ্গীভূত হয়ে আছে। সেটি তাঁর প্রতীকবাদের প্রতি আস্থা, সাংকেতিক রূপাবয়ব নির্মাণের প্রতি নিবেদিত প্রেম। আরেকটি বিচারও মান্নান সৈয়দের কাব্যস্বভাবে সুলক্ষ্য। বিন্যাস ও প্রকাশে তাঁর ব্যতিক্রম হওয়ার বাসনা। গদ্যের আকার দিয়ে জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছে আবির্ভূত হয়েছিলেন, পরে শুধু গদ্যের পথেই নিয়ন্ত্রিত হননি, পদ্যে, ছন্দে, প্রবহমান গদ্যে এবং নানা রকম আঙ্গিক-নিরীক্ষায় তাঁর কাব্যসাধনার পথ বিস্তৃত করেছেন। এই বিচারে মান্নান সৈয়দ অবশ্যই নিয়ত ভিন্নতার অনুসারী, বৈচিত্র্যের পূজারি।

কীভাবে কবিতা আসে কবির হৃদয়মন্দিরে তার, আত্মস্বীকারমূলক বিবরণ দিয়েছেন মান্নান সৈয়দ তাঁর নানা লেখায়, নানাভাবে। এ বিষয়ে তাঁর কল্পনা ও অবচেতনধ্যান কতটা নিমগ্ন তার একটি দৃষ্টান্ত :

কল্পনাময় আবেগকে মূল্য দিচ্ছি আমি। কিন্তু তারপরও আমি মনে করি, কবিকে জানতে হয় শব্দ-ছন্দ-রূপকল্পের প্রশাসন। জানতে হয় এবং জেনে ভুলে যেতে হয়। অর্থাৎ অবচেতনে পাঠিয়ে দিতে হয় ওইসব ব্যাকরণিক জ্ঞানকে। জেনে-ভুলে-যাওয়া ওই শব্দ-রূপকল্পের প্রশাসনই অবচেতন থেকে কবিতাকে রূপ দ্যায়। [‘কবির কথা’, কবিতার বই, আবদুল মান্নান সৈয়দ রচনাবলি, প্রথম খণ্ড, বাংলা একাডেমি  ২০১৫, পৃ. ৭০৯]

ওপরের দৃষ্টান্তে কল্পনাময় আবেগ, প্রচলিত রূপকল্প জানা-ও-ভুলে যাওয়া, চেতনমনের খবরদারি থেকে মুক্ত থাকা এবং অবচেতনমনের ধারাকে আমন্ত্রণ জানানোর ঘোষণা দিয়েছেন মান্নান সৈয়দ। এই শিল্পরুচি ও বিশ্বাসে বশীভূত হওয়ার কারণেই খুব স্বাভাবিকভাবে তিনি পরাবাস্তবের ভেতর শিল্পের অনুভূতির অকৃত্রিমতা ও আদিমতার প্রকাশ ঘটাতে গিয়েছেন। তাঁর শিল্পের বাস্তবতা পরাবাস্তবতারই বিস্তার ঘটিয়েছে বারেবারে। তিনি নিজেই বলেন, ‘সুররিয়ালিজম বোধহয় ছিল আমার রক্তের ভিতরে; কেননা জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ যখন লিখি, সেই আমার উনিশ-কুড়ি বছর বয়সে, তখন ও-সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না। উত্তরকালেও এই ধারা বোধহয় আমার কবিতার প্রতিটি অন্তঃস্রোত হিশাবে কাজ করেছে।’ [‘কবিতা প্রসঙ্গে’, পরাবাস্তব কবিতা, ঐ : পৃ. ৬৮৯]

মান্নান সৈয়দ তাঁর সমগ্র কাব্যদর্শনে সাংকেতিকতাকে খুব সুগঠিতভাবে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। কবিতায় সাংকেতিক পথরেখা বারবার এঁকে গিয়েছেন। প্রতীকে-চিত্রকল্পে তাঁর উত্তাল ঢেউসম অনুভবমালা ক্ষণে ক্ষণে নিত্যনতুন সাংকেতিকতারই মূর্তি নির্মাণ করেছে। জ্যোৎস্না, ভূত, মাংস, মাছ, আল্লাহ্, ঈশ্বর, দরোজা, চাঁদ, পাগোল, রাত্রি, নগ্নিকা, দয়িতা, কুয়াশা, গেলাশ, ট্রেন, ট্রেনগাড়ি, লণ্ঠন, ফেরেশতা, শবেবরাত, এরোপ্লেন, বারান্দা, বেশ্যা—এ রকম আরো অনেক প্রতীক দিয়ে তাঁর কাব্যরহস্যের আত্মা ও আধ্যাত্মিকতাকে সংকেতায়িত করেছেন। সমগ্র কাব্যোপকরণের দিকে দৃষ্টি দিলে অনায়াসে চোখে পড়বে তাঁর এই প্রতীকবাদী কাব্যপিপাসা।

তাঁর কবিতার সাংকেতিক রূপাবয়ব কিংবা প্রতীকবাদের পরিচয় সমগ্র কাব্যবোধেই দারুণভাবে সমাসীন। তা-সে অবচেতনজাত গদ্যের ধারাই হোক, প্রেমপদ্যই হোক, ছন্দের নৈকট্যই হোক কিংবা কাব্যনাট্যের আলেখ্যই হোক; তাঁর রহস্যঘন সমগ্র কাব্যদর্শনে প্রতীক-সংকেতের বর্ণবহুল আলোকরশ্মি ঠিকরে পড়বেই। এই দিকটি নির্ণয় করলে তাঁর কবিতায় অভূতপূর্ব অজস্র শিল্পনিদর্শন মিলবে। আমরা এই পরিসরে তাঁর সামান্য দু-একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপনের চেষ্টা করি। যেমন— ‘জ্যোৎস্না’ ও ‘ভূত’ মান্নান সৈয়দের আধুনিক কাব্যবোধের প্রিয়তম সাংকেতিক দুটি প্রতীক। জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ (১৯৬৭) থেকে অঘ্রানের নীল দিন (২০০৮) পর্যন্ত কিংবা ১৯৬৭ থেকে আমৃত্যু এই অন্যতম প্রিয় উপকরণ দুটি প্রয়োগ করে গেছেন।

‘মান্নান সৈয়দ পরাবাস্তবের কবি’-এমন অভিধায় তাঁকে নিয়ে অনেক গুণীজন অনেক কথা বলেছেন, আমরা এখানে সে-সবের প্রতিধ্বনি করব না। দেখতে চেষ্টা করব ধ্যানাশ্রয়ী অবচেতনমনের মোটিফ কীভাবে তাঁর কাব্যরহস্যের জাল উন্মোচন করেছে জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছের কয়েকটি প্রতীকময় সাংকেতিকতায় :  

১. জ্যোৎস্না ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে দরোজায়, সব দরোজায়, আমার চারিদিকে যতগুলি দরোজা আছে সময়ের নীলিমার পাতালের; [‘অশোককানন’, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ : পৃ. ৩]

২. কাঁচা মাংসের ভূতে লুকোনো একটি আলপিন জ্যোৎস্নার মতো বিঁধে ফেলল আমাকে, আর আমি নারীর নর্দমা থেকে কুমারের মতো জেগে উঠে বানাতে বসলাম নিজেকে সারল্য আর ভালোবাসা আর আমার আল্লাহর বিন্যাসে। [‘অভাব’, ঐ : পৃ. ৯]

১-সংখ্যক পঙক্তিতে দেখলাম সময়, নীলিমা ও পাতাল ঘিরে কবির সবদিকের দরোজায় একটি চরিত্র— ‘জ্যোৎস্না’ ভূত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ২-সংখ্যক পঙক্তির ভেতর দেখা যাচ্ছে কাঁচা মাংসের ভেতর ভূত হয়ে একটি আলপিন বিঁধে আছে— তা প্রকৃতপক্ষে জ্যোৎস্নার সম্মোহনী শক্তিতে। এই বিচারে জ্যোৎস্না যে কবিকে নির্দ্বন্দ্ব সম্মোহিত করে চলেছে তাতে কোনো সন্দেহ থাকে না। মান্নান সৈয়দ কবিতায় শিল্পের স্বাধীনতাকেই হয়তো প্রশ্রয় দিয়েছেন বেশি মাত্রায়। নিজেও মাঝে মাঝে এসব প্রসঙ্গে নিরঙ্কুশ খোলা মত রেখে গেছেন, ‘আমার কবিতা সব সময়ই বস্তুভেদী, সব সময় সমকালভেদী। আমার কবিতা আমার আত্মার ইতিহাস। কিন্তু তার অন্তর্যাত্রা সম্পর্কে আমি নিজেও সব সময় সচেতন নই। আমার নিজেরও খবরদারি সে সব সময় সহ্য করে না। এখানেও সে তার স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়েছে।’ [‘প্রবেশক’, মাছ সিরিজ, ঐ : পৃ. ৬৯৮]। ‘স্বাধীনতার পতাকা’ বলতে চেতনমনের খবরদারি নয়, শিল্পের অধীনতার কথাই বলেছেন। আলোচ্য অন্যতম উপকরণ ‘জ্যোৎস্না’ ও ‘ভূত’ এমনই এক অধীনতার উপকরণ।

জ্যোৎস্না-রৌদ্রের চিকিৎসায় এই আবহ আরো সঘন এবং নবমাত্রা সঞ্চারী :

বাতাবি-লেবুর পাটকিলে ফুটবল নিয়ে এক

দণ্ডিত ছেলের দল নেমে গেছে জ্যোৎস্নায়, মাঠে;

ছিঁড়ে গেছে ব্যাকরণ; সময়ের জেলখানা ভেঙে

বেরিয়ে পড়েছে ওরা; জ্যোতি ফ্যালে লম্বা গাছগুলি—

দুমড়োনো শিক যেন সরু, প্রাকৃতিক বারান্দায়;

প্রত্যেক বাড়ির ভিতরজানালা থেকে যাচ্ছে উড়ে

একেক আরশি, আকাশের সুনীলায় হয়ে যায়

[‘দুপুরবেলার প্রকল্পনা’, ঐ : পৃ. ২৮]

বাতাবি-লেবুর পাটকিলে ফুটবল, ছিঁড়ে যাওয়া ব্যাকরণ, জ্যোতি ফ্যালা লম্বা গাছগুলি, সরু দুমড়োনো শিক, প্রাকৃতিক বারান্দা, বাড়ির ভিতরজানালায় উড়ে যাওয়া আরশি, আকাশের সুনীলা—ইত্যাকার সঘন পরিবেশের ভেতর দণ্ডিত ছেলের দল নেমেছে জ্যোৎস্নার মাঠে। অদ্ভুত সুন্দর দীর্ঘ এক ক্যানভাসে কবি এই চিত্রকল্পের বাণী এঁকে দিয়েছেন। যাঁরা এই রকম কাব্যসৌন্দর্যে আকণ্ঠ নিমগ্ন কবি তাঁদের দণ্ডিত ছেলের দলে ফেলেছেন, তিনি নিজেও তাঁর অংশীদার। এখানেই জ্যোৎস্না নতুন সাংকেতিকতা নিয়ে বহুবাচনিকতার রূপকল্প প্রকাশের দায় নেয়।

‘চতুর্দশপদী’তে কবি নিয়েছেন এবার সহজিয়া বাতাবরণ। সূর্য, চাঁদ, রাত্রির প্রতীকে কবি আরো এক গল্পময় সহজ বিবরণী দিচ্ছেন জ্যোৎস্নার :

জ্যোৎস্না, তুমি এসেছ কোত্থেকে?

— সূর্য থেকে নেমে এসে চাঁদের ফিল্টারে!

রাত্রি তুমি এসেছ কোত্থেকে?

—পালিয়ে এসেছি দীপ্র সূর্যের প্রচণ্ড অত্যাচারে!

তাহলে জ্যোৎস্না তুমি নেমে এসো আমার খাতায়।

রাত্রি নামো কালো-কালো অজস্র অক্ষরে।

রাত্রি আর জ্যোৎস্না নামো হৃদয়ে ও চোখের পাতায়।

রাত্রি আর জ্যোৎস্না জ্বলো কবিতার রক্তে, কণ্ঠস্বরে।

না—আমি নই দিনের উজ্জ্বল আলো।

[‘আমার কবিতা’, শ্রেষ্ঠ কবিতা, ঐ : পৃ. ২৫৬]

এখানে কবি সুস্পষ্টই জানিয়ে দিলেন জ্যোৎস্না তাঁর কবিতার খাতায় কীভাবে কালো অক্ষরের অস্তিত্ব হয়ে নেমে আসে। জ্যোৎস্নার উৎস তাহলে কবির কাছে সূর্য-চন্দ্র-রাত্রির এক কুহকমণ্ডিত আধ্যাত্মিকতারই প্রকাশ করে আসছে এই কবিতায়। প্রেমের কবিতায় এই জ্যোৎস্নার আরেক রূপ-সমগ্র পরিবেশে সমগ্র সত্তায় বৃষ্টির মতন তার ধারাবর্ষণ লেগে থাকে :

দেখি : জ্যোৎস্না ঝরে যাচ্ছে

অবিরল বৃষ্টির মতন—

রাস্তায়, ফুটপাতে, ঘাসে,

            স্বপ্নে, রক্তে, শরীরে, হৃদয়ে।

[‘ফেরার সময়’, ঐ : পৃ. ৪৫০]

মান্নান সৈয়দ ষাটের শুরুতেই সারলিক বর্ণনায় প্রেমের কবিতা লেখার চিন্তাকে পরিহার করেছেন, স্পষ্ট বোঝা যায়। প্রেম নয়, তিনি অপ্রেম পান করার আহ্বান জানিয়েছেন এবং ব্যতিক্রম হওয়ার চিন্তা তখন থেকেই তাঁর মাথায় ঘুরপাক খেয়েছিল : ‘এসো, পান করো অপ্রেম, হায় আত্মতাড়িতেরা, পতিতার মতো অতিরঞ্জিত সত্যের মুখমণ্ডল রাখো প্লেটের উপর অভুক্ত, এসো তোমরা, আস্তিন ভিজিয়ে ব্যতিক্রম খাও, [‘বাঙালি কবিতা’, জন্মান্ধ. কবিতাগুচ্ছ, ঐ : পৃ. ১০] ‘বাঙালি কবিতা’টির প্রথম নাম দিয়েছিলেন ‘সত্যের মতো বদমাশ’; প্রথমে ছাপা হয়েছিল ‘পূর্বমেঘ’ পত্রিকাতে। পরে ‘সত্যের মতো বদমাশ’ই নাম ধারণ করে জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছের ‘বাঙালি কবিতা’ নামে [ঐ : পৃ. ৬৭৯]। অন্যদিকে পরের বছরই [১৯৬৮] মান্নান সৈয়দের ব্যতিক্রমী ছোটগল্পের বই বের হয় ‘সত্যের মতো বদমাশ’ নামে। বিতর্ক, আলোচনা ও সুখ্যাতি কুড়োতে সময় লাগেনি এই বইয়ের।

যত সময় পার হয়েছে তত মান্নান সৈয়দ পরিণত হয়েছেন তাঁর অবচেতনাজাত আচ্ছন্নতার প্রকাশে। বিরত হননি জ্যোৎস্নার প্রভাব থেকে। জ্যোৎস্না যেহেতু তাঁর কবিসত্তার আধ্যাত্মিকতাকে নির্মাণ করেছে, প্রতিষ্ঠা দিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন রূপে, তাকে সব সময় সাদরে সানন্দে নিজের করে নিয়েছেন। মৃত্যুর দু বছর আগে প্রকাশ করেন কবি অঘ্রানের নীল দিন। এখানেও কবি জ্যোৎস্নার সংকেতে তাঁর অতলজলে ডুবে যাওয়া কাব্যানুভূতির বিবরণ দেন। কবি পরিণত বয়সে হয়েছেন অনেক বেশি ন্যারেটিভ, কিন্তু শিল্পগুণের সামান্যতম ঘাটতি চোখে পড়ে না তাঁর কবিতায়। ঠিক যেন ফরাসি কবিতার মতো নিজেকে চরিত্রের এক কেন্দ্রে রেখে গল্প বলে গেছেন। সেই গল্পের আবেশে মাঝে মাঝেই এঁকে দিয়েছেন অপূর্ব সব চিত্রকল্প (যেমন, জ্যোৎস্নায় লাগল কি পাখার আঘাত রাতের পাখির গায়ে?) :

কেঁদে উঠলাম কেন ঘুমের ভিতরে?

ঘুম ভেঙে দেখি : আরে, এ তো মাঝরাত!

জ্যোৎস্নায় লাগল কি পাখার আঘাত

রাতের পাখির গায়ে? তারই কণ্ঠস্বরে

ঘুমের ভিতরে ভয়ে কেঁদে উঠেছিলাম?

নাকি কোনো স্বপ্ন দেখে? মনে তো পড়ে না।

আস্তে উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম।

রাত্রিবেলা, মনে হলো, সমস্ত অচেনা।

গায়ে এসে লাগছে মৃদু রাত্রির বাতাস।

উপরে তারায় ভরা ফিরোজা আকাশ।

থেকে থেকে জেগে উঠছে একটি নারীমুখ।

সেই মুখই তাহলে কি আমার অসুখ?

লেখালেখি, যশোলিপ্সা—মিটে গেছে সব।

বেদনায় হতে পারি এবার নীরব ওও

[‘কেদে উঠলাম কেন’, অঘ্রানের নীল দিন, ঐ : পৃ. ৪৭৩]

অবচেতনের অতলে ডুব দিয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দ তুলে এনেছিলেন অভূতপূর্ব চেতনার বাণী। শব্দের শয্যায়, নতুন নতুন প্রতীক ও উপমানচিত্রের উন্মোচনে এবং চিত্রকল্পের বিন্যাসে একেকটি কবিতার বইয়ে একেক ধরনের তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ থেকে অঘ্রানের নীল দিন পর্যন্ত নতুন দ্বীপের সীমানায় দাঁড়িয়ে আমরা অবলোকন করি অনন্যসাধারণ শব্দদীপাবলির আলো, যে আলোর প্রতিফলন মেলে ধরেছে বাংলা কবিতার সবুজ বিস্তীর্ণ প্রান্তর। তাকালেই দেখতে পাই কেবল নতুনের সাক্ষাৎ-শয্যা। প্রবল আবেগে মোড়ানো অক্ষরগুলিই দিয়েই মান্নান সৈয়দ তাঁর আবেগের শয্যা রচনা করেছিলেন। তাঁর আত্মার ইতিহাস তাঁর আবেগেরই শয্যা। আর শয্যাকে সংকেতময় করেছেন দিনরাত্রির সীমা না মেনে গহিন নদীতে জাল ফেলে। এমন জালে নতুন নতুন উপাদান ধরা না পড়ে পারে!