গারো বিদ্রোহ ২

ব্রিটিশ আমলে পাগলপন্থীদের আন্দোলন

Looks like you've blocked notifications!
ছবি : সালেক খোকন

ছপাতির গারো রাজ্য স্থাপনের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর সহায়তায় জমিদারগণের শোষণ-উৎপীড়ন চরম আকার ধারণ করতে থাকে। তারা খাজনা, আবোয়াব ও নানাবিধ ট্যাক্স চাপিয়ে দেয় গারোসহ অন্যান্য পার্বত্য অধিবাসীদের ওপর।

আবার ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে, ব্রহ্মযুদ্ধের সময় জমিদারগণ ইংরেজদের বিপুল অর্থ সাহায্য করে। এই অর্থ প্রজাদের কাছ থেকে উত্তোলনের লক্ষ্যে তারা কর বা খাজনার পরিমাণও বাড়িয়ে দেয়। ফলে আদিবাসীদের জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। এটির প্রমাণ পাওয়া যায় ময়মনসিংহ জেলার তৎকালীন গেজিটিয়ারে। সেখানে বলা হয়েছে—১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের পাগলপন্থী গারো-বিদ্রোহ জমিদারগণের ভয়ঙ্কর শোষণ-উৎপীড়নেরই অনিবার্য পরিণতি।

এ দিকে নতুন ধর্মমতে দীক্ষিত গারোগণ টিপু গারোর নেতৃত্বে জমিদারগোষ্ঠীর শোষণ-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলে। প্রথমে তারা দলবদ্ধ হয়ে জমিদারদের খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়।

গারোদের বিদ্রোহের কারণ ও কী ঘটেছিল তার উল্লেখ পাওয়া যায় কেদারনাথ মজুমদার রচিত ময়মনসিংহের ইতিহাসে গ্রন্থে। সেখানে বলা হয়েছে—১৮২০ খ্রিস্টাব্দে শেরপুরের জমিদারি বাটোয়ারা হয়ে গেলে, জমিদারগণ প্রজাদের কাছ থেকে বাটোয়ারার খরচ আদায় করতে বর্ধিত হারে খাজনা ধার্য করে। তারা প্রজাদের ওপর আবোয়া, খরচা, মাথট প্রভৃতি ট্যাক্স ধার্য করে উৎপীড়ন শুরু করে। এই উৎপীড়ন সহ্য করতে না পেরে বহু প্রজা জমিদারদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তারা কুড় (শেরপুর পরগনার ১ কুড় সমান ৩ বিঘা ১০ কাঠা) প্রতি চার আনার অধিক খাজনা দিতে পারবে না বলে ঘোষণা করে। ধর্মপ্রচারক টিপু গারো বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং শেরপুরে বিদ্রোহ গড়ে তোলেন।

এ সম্পর্কে তৎকালীন সরকারি গেজিটিয়ারে বলা হয়েছে— প্রজাসাধারণের ওপর জমিদারগণ কর্তৃক বেআইনি কর, অত্যধিক খরচা, মাথট ও আবোয়াব আদায়ই ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের গারো-বিদ্রোহের মূল কারণ।

জমিদারগণ বিদ্রোহী গারোদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের চেষ্টা করলে তারা জমিদারদের পাইক-বরকন্দাজদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। বিদ্রোহীদের সঙ্গে গড়দরিপায় এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয় তাদের। ওই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে জমিদারগণ সপরিবারে পালিয়ে কালীগঞ্জের জয়েন্ট-ম্যাজিস্ট্রেট ডেম্পিয়ার সাহেবের কাছারি বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

অন্যদিকে, সাতশ বিদ্রোহী গড়দরিপার যুদ্ধে জয়লাভ করে শেরপুর শহর দখল করে নেয়। তারা শেরপুর শহরকে কেন্দ্র করে এক নতুর গারোরাজ্য স্থাপন করে এবং শহরেই বিচার ও শাসন বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে। আর সুরক্ষিত গড়দরিপার অভ্যন্তরে আশ্রয় নিয়ে টিপু গারো এই বিদ্রোহী রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। তখন তাঁর অধীনে বিচারক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন বকসু আর ফৌজদার বা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দ্বীপচান নামক দুই ব্যক্তি।

গারোদের এই বিদ্রোহী রাজ্য দুই বৎসর কাল স্থায়ী হয়েছিল। ওই সময়ের মধ্যে বিদ্রোহীদের সঙ্গে ইংরেজ বাহিনীর কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধও হয়। অবশেষে ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দের শেষ ভাগে রংপুর হতে ইংরেজদের একটি শক্তিশালী সৈন্যদল এসে জামালপুরে স্থায়ীভাবে ঘাঁটি স্থাপন করে। এই সৈন্যদলের সাথে যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়ে বিদ্রোহীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে ১০ জন বরকন্দাজসহ একজন দারোগা গড়দরিপার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সুকৌশলে টিপুকে বন্দি করে। অতঃপর ময়মনসিংহের সেসন জজের বিচারে টিপুর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কারাবাস কালেই টিপু গারোর মৃত্যু ঘটে, ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে।

টিপুর নেতৃত্বে প্রথম গারো-বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এর প্রচণ্ড আঘাতে ইংরেজ শাসকগণ আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। ফলে ইংরেজশাসকগণ গারোদের অসন্তোষ দূর করে ওই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে রেভিনিউ বোর্ড কালেক্টরকে নির্দেশ দেয়। কালেক্টর বাধ্য হয়ে গারোসহ অন্যান্য আদিবাসীর ওপর হতে করের বোঝার কিছু অংশ লাঘবের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এর পরিমাণ এতই সামান্য ছিল যে গারোদের পুঞ্জীভূত অসন্তোষ দূর হয় না। অন্যদিকে জমিদারগণের উৎপীড়ন ও করের হারও আগের মতোই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে বাধ্য হয়ে পাগলপন্থী গারোগণ পুনরায় বিদ্রোহের পথ খুঁজতে থাকে।

সে সময় টিপুর সহকর্মী গুমানু সরকার গারোদের দলপতির দায়িত্ব নিয়ে বিদ্রোহীদের ঐক্যবদ্ধ করতে থাকেন। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে জমিদারগোষ্ঠী ও ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে তারা সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। উজির সরকার নামক জনৈক গারো-সর্দার এ সময় গুমানুর সহযোদ্ধা ছিলেন। গুমানু ও উজির এই দুজন মিলে তখন গারোদের সংঘবদ্ধ করতে থাকেন।

এ খবর ছড়িয়ে পড়লে শেরপুরের জয়েন্ট-ম্যাজিস্ট্রেট ডানবার গুমানু সরকারকে গ্রেপ্তার করেন। কিন্তু ওই গ্রেপ্তার আরো একটি গারো-বিদ্রোহের ইন্ধন জোগাবে মনে করে ঢাকার তৎকালীন কমিশনার কিছুদিন পরই গুমানুকে মুক্তি দেয়। তবুও গারোদের মনে জন্ম নেওয়া ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শেষ হয় না।

১৮৩২ খ্রিস্টাব্দের শেষ ভাগের কথা। বিদ্রোহী গারোগণ বিভিন্ন স্থানে জমিদারদের কাছারি আক্রমণ ও লুট করে। তারা জমিদারের বরকন্দাজ, সরকারি পিয়ন ও পুলিশের ওপরও আক্রমণ চালাতে থাকে। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথমভাগে দুজন গারো সর্দার বিদ্রোহীদের নেতৃত্বে আসেন। তাদের নাম ছিল জান্কু পাথর ও দোবরাজ পাথর। প্রথমে তারা বিদ্রোহী গারোদের দুই ভাগে ভাগ করে। জান্কু এক ভাগ নিয়ে শেরপুরের পশ্চিম কোণে কড়ৈবাড়ী আর এক ভাগ নিয়ে দোবরাজ নালিতাবাড়ীতে ঘাঁটি স্থাপন করে আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নেয়।

এপ্রিল মাসে তারা একযোগে শেরপুর আক্রমণ চালিয়ে জমিদারদের ঘর ও কাছারিবাড়ি লুট করে নেয়। অতঃপর বিদ্রোহীরা শেরপুরের থানা আক্রমণ করে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ খবর পেয়ে জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট ডানবার জয়েন্ট-ম্যাজিস্ট্রেট গেরেটকে শেরপুরে পাঠান। কিন্তু তিনি শেরপুর পৌঁছামাত্র বিদ্রোহীরা তার বাংলো আক্রমণ করে। গেরেট তখন পালিয়ে নিজের প্রাণরক্ষা করেন। অতঃপর জমিদারদের বরকন্দাজ ও পুলিশদলকে একত্র করে বিদ্রোহ দমনের জন্য এগিয়ে যায়।

এই মিলিত বাহিনী নালিতাবাড়ীর দিকে অগ্রসর হলে দোবরাজ পাথর তার ঘাঁটি ছেড়ে পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। ফলে সরকারি বাহিনী বিনা যুদ্ধে নালিতাবাড়ী দখল করে নেয়। বিজয় ভেবে তারা জমিদারের কর্মচারীদের সঙ্গে ওই দিন আনন্দ করছিল। ওইদিন রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে দোবরাজ পাথর তার দলবল নিয়ে তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে সরকারি বাহিনীর বহু সেনা নিহত ও আহত হয়। অতঃপর দোবরাজের দল একজন পুলিশ, জমিদার, একজন বরকন্দাজ, একজন মোহার ও একজন পিয়নকে ধরে নিয়ে যায়। 

ময়মনসিংহ জেলার তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট ডানবার জামালপুরে অবস্থিত সরকারি সৈন্যবাহিনীর অধ্যক্ষ মেজর মন্টিথের কাছে একটি সরকারি পত্র লিখেন। যা থেকে সে সময়কার বিদ্রোহে বিদ্রোহীদের শক্তি ও ব্যাপকতা এবং শাসনগণের মনোভাবের স্পষ্ট প্রমাণ মিলে। ২৭ মে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ তারিখে লেখা পত্রে ডানবার লিখেন—

আমি অতীব দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, এই জেলার শান্তি এমন গুরুতররূপে বিঘ্নিত হয়েছে যে নিয়মিত সৈন্যবাহিনী ব্যতীত বিদ্রোহ দমন ও পুনরায় শান্তি  স্থাপনের কোনো সম্ভাবনা নেই। বিদ্রোহীরা তাদের স্বাধীনতালাভের পরিকল্পনানুযায়ী বহু আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। আপাতত তারা শেরপুর ও গারো পাহাড়ের মধ্যবর্তী অঞ্চল সম্পূর্ণ দখল করে নিয়েছে। সব প্রজার কাছ থেকে তারা কর আদায় এবং শেরপুর আক্রমণের জন্য লোকবল বৃদ্ধি করছে। এই অবস্থায় বিনীতভাবে অনুরোধ করছি যে, আপনি অবিলম্বে প্রয়োজনীয় সামরিক শক্তি প্রেরণ করে আমাকে সাহায্য করুন। পাগলপন্থী বিদ্রোহীগণ পরগনার বিভিন্ন স্থানে ৪০০ হতে ৫০০ করে লোক সমাবেশ করেছে। তাদের মূলবাহিনীর লোকসংখ্যা সম্ভবত চার হতে পাঁচ হাজারের মধ্যে। তাদের পরিচালনা করছে জান্কু পাথর নামক এক ব্যক্তি। বিদ্রোহীগণ বল্লম, তরবারি এবং বিষাক্ত তীর-ধনুকের দ্বারা সুসজ্জিত। এ ছাড়া তারা কিছু বন্দুকও সংগ্রহ করেছে।

ডানবারের পত্রের পরিপ্রেক্ষিতে জামালপুর হতে ক্যাপ্টেন সিলের অধীনে দেড়শত ইংরেজ সৈন্য শেরপুরে আসে। সিল সৈন্যদলকে দুই ভাগে বিভক্ত করে। একভাগ তার নিজের অধীনে এবং অপর ভাগ লেফ্টেনেন্ট ইয়ংহাজাব্যান্ডের অধীনে রেখে বিদ্রোহীদের ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। জান্কু পাথরের ঘাঁটি জলঙ্গীতে আক্রমণের দায়িত্ব নেয় ক্যাপ্টেন সিল নিজেই।

এ খবর পেয়ে জান্কু তীর-ধনুকধারী প্রায় চার হাজার বিদ্রোহী নিয়ে ইংরেজ বাহিনীর গতিরোধ করার প্রস্তুতি নেয়। খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন সিল তখন দুইভাগ সৈন্যদলকেই একত্রিত করে আক্রমণ করে।