সিনেমা এখন ফেরি করবার সময়

Looks like you've blocked notifications!

অন্ত আজাদকে ঢাকার শিল্পকলায় প্রথম দেখি, কথা হয় সিনেমা আহত ফুলের গল্প নিয়ে। তখনো সিনেমাটি সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পায়নি, এ নিয়ে চাপা হতাশা থাকলেও কণ্ঠে ছিল রুক্ষতা। কথা বলতে বলতেই টের পাই, মানুষটা অসম্ভব রকম একরোখা এবং জেদি, যা হওয়ার হবে, আমি তা করবই, এই টাইপ মানুষ। আর মানুষটা এমন বলেই সেলিব্রেটি এই শহরে সেলিব্রেটিহীন ‘আহত ফুলের গল্প’ দিয়ে মানুষের কণ্ঠস্বরে এতটা উচ্ছ্বাস তৈরি করতে পেরেছেন।

মুঠোফোনে অন্ত আজাদকে জানাই, আমরা টাউন হলের সামনে আছি। তিনি তার বাড়িতে বিশ্রামের প্রস্তাব দিয়ে বাড়ির সহজ পথ বাতলে দেন। দেবীগঞ্জ টাউন হল থেকে পাঁচ কিলোমিটার ভেতরে মৌমারীর পাশেই মাটিয়াপাড়ায়। এই ছোট্ট যাত্রাপথের আশেপাশে গাছ কিংবা মাটির দেয়ালে লেপ্টে থাকা ‘আহত ফুলের গল্প’র পোস্টারগুলো আমাকে উদ্দীপ্ত করে সহজেই, ভেতরে কেমন চাপা উত্তেজনা অনুভব করি। সেইসঙ্গে ইজি বাইকের মৌমাছির মতো ভোঁ ভোঁ শব্দ এক অদ্ভুত আবহসংগীত, মনে হচ্ছিল সিনেমার কোনো আশা-জাগানিয়া দৃশ্যের মধ্য দিয়ে আমরা দুজন স্বপ্নবাজ চলচ্চিত্র নির্মাতা করতোয়া নদীর নির্লিপ্ত স্রোতের মতো বয়ে চলছি।

অন্ত আজাদের বাড়ি পৌঁছালাম। পুরো পরিবারের সকলেই সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠা মানুষজন। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বাবা তৌহিদুল আলম প্রধান একসময় ছিলেন যাত্রার মঞ্চকাঁপানো অভিনয়শিল্পী, অভিনয় করেছেন ছেলের ‘আহত ফুলের গল্প’র প্রতাপশালী চেয়ারম্যান চরিত্রে। অন্যদিকে মা ‘আহত ফুলের গল্প’-এর ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে নিজের অভিনয় দক্ষতা দেখিয়েছেন।

অন্ত আজাদ ব্যস্ত ছিলেন, প্রথম শোর আগেই পুরো এলাকায় মাইকিং করে এক চক্কর দিতে চান। মাইকিংয়ের জন্য বিশেষ একজনকে নিযুক্ত করেছেন। কালাম মিয়া, জীবনের ত্রিশটা বছর বন্ধ হয়ে যাওয়া ‘আমার টকিজে’ মাইকিং করে কাটিয়েছেন। দেবীগঞ্জসহ আশেপাশের থানাগুলোতে তিনি নাকি ভীষণ জনপ্রিয়। তৎক্ষণাৎ সময় দিতে না পারায় সলজ্জ অন্ত আজাদ বারবার ক্ষমা চেয়ে নেন। আমাদের ঝিমিয়ে পড়া শরীর দুই ঘণ্টার বিশ্রাম পায়।

চলচ্চিত্র ইতিহাসের শুরুতে চলচ্চিত্র আদৌ শিল্প কি না এ নিয়ে বিতর্ক ছিল। এখনো কেউ কেউ নিজেকে এ বিতর্কে জড়িয়ে ভেতরে পাণ্ডিত্য অনুভব করেন। তাদের মতে, চলচ্চিত্র একক কোনো শিল্প নয়। গল্পকার, চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক, শিল্প নির্দেশক, সংগীতজ্ঞ তার পরে নির্মাতা এবং অন্যান্য কলাকুশলী মিলে তৈরি করেন একটি চলচ্চিত্র। সোজা কথায়, বিভিন্ন ক্ষেত্রের শিল্পের সমন্বয়ে চলচ্চিত্র তৈরি হয়। এ নিয়ে ‘বিষয় চলচ্চিত্র’ বইতে সত্যজিৎ রায়ের বক্তব্য আমার মনে ধরেছে এবং সেটা যারা চলচ্চিত্রকে শিল্প বলতে নারাজ, তাদের ধরাশায়ী করার জন্য যথেষ্ট মনে হয়েছে।

এখন সিনেমা দিনকে দিন একক ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে। একজন নির্মাতাই গল্প লিখে চিত্রনাট্য তৈরি করে ক্যামেরা হাতে নেমে পড়ছেন চলচ্চিত্র নির্মাণে। শুটিং শেষে নিজেই শুরু করে দেন কাটাকাটি। কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেন না, প্রডিউসার, বড় বড় তারকা, ডিস্ট্রিবিউশন। এরাই স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা। এদিক থেকে প্রখ্যাত কিম কি দুকের ‘আড়িরাঙ’ ও ‘আমেন’ চলচ্চিত্র দুটির নাম উচ্চারণ করাই যায়। বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে এমন বহু স্বপ্নবাজ নির্মাতা রয়েছেন, যাঁরা কোনো কিছুর অপেক্ষায় না থেকে নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়েন নিজের স্বপ্ন নির্মাণে।

আমাদের দেশের তারেক মাসুদ এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি নিজেই নিজের সিনেমা নিয়ে ফেরি করে বেরিয়েছেন সারা দেশে। তাঁর কাজ হয়তো অসমাপ্ত ছিল, কিন্তু স্বপ্ন রেখে গেছেন হাজারো তরুণের মাঝে। অন্ত আজাদ সেই তরুণদের একজন। তাই স্বভাবতই আমার অবাধ্য নিউরণগুলো ঝিমিয়ে পড়বার আগে তারেক মাসুদের কথা মনে করছিল। যে স্বপ্নের বীজ উনি বুনে দিয়ে গেছেন, এখন ধীরে ধীরে তা সবুজ বৃক্ষে পরিণত হচ্ছে।

বিশ্রাম শেষে দেবীগঞ্জ টাউন হলের উদ্দেশে বের হতেই কালাম মিয়ার মাইকিং কানে আসে। এমন চমকপ্রদ আর আকর্ষণীয় সিনেমার প্রচারণা আমি এর আগে শুনিনি। ‘মাটিয়াপাড়ার চ্যাংড়া বন্ধু পাগল করিলো। দেখেন কি ঘটনা, মাইয়া কবুল কয় না, বাপে কবুল কইলো। আজকে আমাদের মুয়াজ্জিন সাহেবের বিয়া।’ কালাম মিয়ার বলার ভঙ্গি সাধারণ দর্শকদের সিনেমাটি নিয়ে খুব সহজেই আগ্রহ তৈরি করেছে, বোঝা যায়। মানুষের মিটিমিটি হাসিমাখা চাহনি আর উৎসবমুখর চলেফেরায় তা সহজেই স্পষ্ট। চলচ্চিত্র নিয়ে মানুষের এই উৎসাহ দেখে আপনার একটিবারের জন্যেও মনে হবে না, বাংলা চলচ্চিত্রের দুর্দিন চলছে।

দুপুর ১২টার শো দেখতে আমরা দেবীগঞ্জে টাউন হলে উপস্থিত হই। উৎসুক দর্শকের কেউ কেউ টিকেট কেটে সিনেমাটি দেখবার জন্য আনাগোনা করছে। আবার অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে টিকেট কাটবার অপেক্ষায়। দুপুরের শোতে শাকিব খান ঘরানার সিনেমাতেও সচরাচর আমি এত দর্শক দেখিনি। আমি নিয়মিত টঙ্গীর চম্পাকলি সিনেমার হলের দর্শক, যদিও মাঝেমধ্যে তা পকেটে টাকা থাকবার ওপর নির্ভর করে। টিকেট কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যেতেই আমি বেশ কিছুক্ষণ সময়ের জন্য থ হয়ে থাকি, সিনেমার নির্মাতা নিজেই নিজের সিনেমার টিকেট বিক্রি করছে। আনন্দে লাফাতে ইচ্ছে হলো, অন্তত এই দৃশ্য দেখবার জন্য হলেও দেবীগঞ্জ টাউন হলে আসা উচিত।

দেবীগঞ্জ টাউন হল মূলত একটি সিনেমা হল ছিল, নাম ‘আমার টকিজ’। দর্শকশূন্যতার অভিযোগে সিনেমা হলটি আরো পনেরো বছর আগে বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে একশ ছুঁই ছুঁই মানুষের মতো অবস্থা, শুধু কঙ্কাল দেহটিকে জীর্ণ চামড়া আবৃত করে আছে। অন্ত আজাদ পুরো হলটিকে নিজ উদ্যোগে যতটুকু সম্ভব সংস্কার করেছে, ছারপোকাবিহীন প্লাস্টিকের চেয়ার ভাড়া করে বসিয়ে দিয়েছেন হলের ফ্লোরে। কিছুক্ষণ পরপর এয়ারফ্রেশনার মারছেন দুর্গন্ধ দূর করতে। ভ্যাপসা গরমে যেন দর্শকের কষ্ট না হয়, সে জন্য ব্যবস্থা করেছেন বাড়তি ফ্যানের। প্রোজেকশন ব্যবস্থাও যথেষ্ট উন্নত, অন্তত ঢাকা থেকে বহু দূরের এই মানুষগুলোকে কোনো সিনেমা হল এই প্রোজেকশন ও পরিবেশের নিশ্চয়তা দেয়নি। কথা প্রসঙ্গে জামান ভাই বললেন, ‘দেখ আমরা মূলত ব্যবসায়ী জাতি নই, নইলে তুমি যা দিয়ে ব্যবসা করছ, তার যত্ন নিবে না? আমরা কয়টা মফস্বল হলে দর্শকদের এমন নিশ্চয়তা দিতে পেরেছি?’

একে একে সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অভিযোগ দর্শক নেই, ভালো সিনেমা হচ্ছে না। কিন্তু আমরা সিনেমা নিয়ে দর্শকদের কতটা কাছাকাছি গিয়েছি? কয়জন দর্শকের সঙ্গে সিনেমা নিয়ে কথা বলেছি? অথবা সিনেমা হলের পরিবেশ কতটা সুন্দর করবার নিশ্চয়তা দিয়েছি? ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আমি নিজেই আমার ছোট বোনকে নিয়ে মফস্বল হলগুলোতে যেতে পারিনি কখনো। হলের ভেতরে পতিতা আর খদ্দরের অশ্লীল শব্দ, পাশাপাশি আনুষঙ্গিক যন্ত্রণা তো আছেই।

যখন শুনলাম, এবারের ঈদুল আজহায় ‘ক্যাপ্টেন খান’, ‘জান্নাত’, ‘মনে রেখো’ ও ‘বেপরোয়া’র সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আহত ফুলের গল্প মুক্তি দিচ্ছে অন্ত আজাদ, আমি ধরে নিয়েছিলাম ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কোনো হল পাবে না। আমার ধারণা সত্য, কোনো হল পাননি, তবে অন্ত আজাদের সিদ্ধান্ত সঠিক। তিনি কোনো ডিস্ট্রিবিউশনের ধার ধারেননি। নিজেই দর্শকের কাছে তার সিনেমা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। দর্শকের সঙ্গে নিজের সিনেমা নিয়ে কথা বলছেন, টিকেট বিক্রি করবার সময় করছেন দরকষাকষি। সিনেমার জন্য এর চেয়ে অপূর্ব দৃশ্য আর কী হতে পারে?

সিনেমা শুরু হয়েছে পনেরো-বিশ মিনিট হলো, মনোযোগী দর্শক সিনেমা দেখছেন। সিনেমা দেখতে দেখতেই কালাম মিয়ার মাইকিংয়ে ব্যবহৃত কথাগুলোর রহস্য উন্মোচিত হচ্ছে দর্শকদের মাঝে। তখনো দেবীগঞ্জ টাউন হলে দর্শকের আনাগোনা ছিল, থাকাটাই স্বাভাবিক। সকাল হবে আর আলো আসবে না?