বই আলোচনা
কিশোর গল্পসংকলনে আবহমান বাংলার ছবি
মিনার মনসুর প্রধানত কবি। কিন্তু তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধু ও সাহিত্য গবেষণায় এবং সাংবাদিকতায়। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে নিজস্ব গদ্যশৈলি নির্মাণে তিনি সচেতন অনেক আগে থেকেই। গবেষণা গ্রন্থ রচনার গদ্য এবং কিশোর গল্পের ভাষাবিন্যাস যে আলাদা তা তিনি প্রমাণ করেছেন কিশোর গল্পসংকলন ‘জলপাই রঙের একটি হেলমেট আর একজোড়া বুট’ গ্রন্থে। ২০১৮ সালে ছয়টি কিশোর গল্প নিয়ে ‘জলপাই রঙের একটি হেলমেট আর একজোড়া বুট’ বর্ণিল প্রচ্ছদ ও সুন্দর অলঙ্করণে পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে। ‘মা ও ময়না’ ‘একটি শামুকের গল্প’, ‘সাপটার মুখে হাসি ফুটল’, ‘যদি রোজাটা ভেঙে যায়!’, ‘শিল্পী, যাস নে’ এবং ‘জলপাই রঙের একটি হেলমেট আর একজোড়া বুট’- এই গল্পগুলোর মধ্য দিয়ে মিনার মনসুর পাঠকের কাছে শিশু-কিশোর মনস্তত্ত্বের এক অভিনব উন্মোচন ঘটিয়েছেন।
গল্পগুলোর পটভূমিতে গ্রামীণ জীবন মুখ্য হয়ে উঠেছে। একদিকে কিশোর বেলার দুরন্তপনা, প্রকৃতিময়তা এবং সামাজিক দায়-দায়িত্ব থেকে দূরে অবস্থান করে পিতা-মাতার সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা কিংবা ভালো বন্ধুর সঙ্গে চপলতা অন্যদিকে আমাদের সহজ-সরল, মমতা মাখানো জীবনে বাংলার পশু-পাখির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক সবই আছে আলোচ্য গ্রন্থে। ময়না পাখি, কাঠবিড়ালি, ঘাসফড়িং, রূপকথার সাপ, আর পুকুরে মাছ ধরতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পরিসরে কিশোর জীবনের অনুপ্রবেশ বিশেষ মাত্রা যুক্ত করেছে মিনার মনসুরের কাহিনী বর্ণনে।
গ্রন্থটির ভূমিকায় মিনার মনসুর লিখেছেন, ‘আমার কিশোরবেলা আর এবেলার লেখা কিশোর গল্পের সংকলন এটি। মাঝখানে ব্যবধান প্রায় ৪০ বছরের। কিন্তু গল্পে যে-কিশোরদের কথা বলা হয়েছে তারা চিরসবুজই রয়ে গেছে। থাকবেও। গল্পগুলোতে মিলু, অনন্ত, শিল্পী, খোকন, মিনু, দীপু, অন্তু আর সবুজ নামের যে-কিশোরদের ছবি রয়েছে তা বিশেষ কোনো কিশোরের নয়। সেটি আসলে আবহমান বাংলার সব কিশোরদের অপরূপ কিশোরবেলার ছবি।’ তিনি আরো মনে করেন, ‘দুরন্ত কিশোর-হৃদয়কে বন্দি করে রাখার ক্ষমতা কারোরই নেই। চিরায়ত বাংলার রূপ ঠিকই তাকে ঘরছাড়া করবে।’ এজন্যই তাঁর গল্পে কিশোর মন কল্পনার ডানায় নির্ভর করে উড়ে বেরিয়েছে দিক-দিগন্তে। বাস্তবের পারিবারিক বেষ্টনী ভেঙে তার বেরিয়ে পড়া, অজানার প্রতি উৎসুক থাকা আর সঙ্গীর প্রতি দরদ অনুভব সবই তুলে ধরেছেন লেখক।
শিশু-কিশোরদের সঙ্গে পশু-পাখির সুন্দর সম্পর্ক নিয়ে আমরা অনেক গল্প পড়েছি। এমনকি বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত গল্পকারদের কাহিনীতে কখনও হাতি বা মহিষ, কখনও গরু কিংবা সাপের সঙ্গে মানুষের হার্দিক সম্পর্কের বর্ণনা পেয়েছি। শরৎচন্দ্রের ‘মহেশে’র কথা কে না জানেন। তবে কিশোর মিলুর সঙ্গে একটি পাখির সম্পর্কের যে বর্ণনা মিনার মনসুর দিয়েছেন তা ব্যতিক্রম। ‘মা ও ময়না’ গল্পে মাতৃহীন সাত বছরের মিলুর আপনজন হয়ে ওঠে একটি পাখি। পাখিটিকে সে পেয়েছে ঝড়-বৃষ্টিতে আছড়ে পড়া গাছের ভেতর। যে শিশুটি একা একা থেকে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল যার কাছে মা’র স্মৃতি সবসময় সতেজ, সেই মিলু পাখির ছানাটি পেয়ে আদর যত্ন দিয়ে সুস্থ করে তোলে। কেবল বাঁচিয়ে তোলা নয় নিজের কাছে রেখে বিড়ালের হাত থেকে তাকে রক্ষা করেছে সে। আর এভাবে আপনজন হয়ে ওঠে পাখিটি।
স্কুলে যাওয়া এবং ফিরে আসা মিলুর একমাত্র বন্ধু এই ময়না। তাকে দূরে ছেড়ে দিয়ে দেখেছে ঠিকই পাখিটি তার বন্ধুর কাছে ফিরে এসেছে পথ চিনে। পাখিরা যে মানুষের আপন হয়ে উঠতে পারে এ ধরনের ঘটনা আমাদের গ্রামীণ জীবনে অহরহ দেখা যায়। অতি পরিচিত একটি বিষয়কে মুন্সিয়ানায় উপস্থাপন করেছেন গল্পকার। বিশেষত সমাপ্তিতে দেখা যায় অন্য আরেকটি ঝড়ের রাতে মাতৃহীন মিলু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে প্রলাপ বকার সময় তার মাথায়, চোখে-মুখে আদুরে স্পর্শ দিয়ে ময়না পাখিটি চেতনা ফিরিয়ে আনে। মা ও ময়না একাকার হয়ে গেছে এই পরিণতিতে। অন্যদিকে এই গল্পে দুটি ঝড়ের ঘটনা উপস্থাপনায় ভিন্ন মাত্রা কিন্তু প্রসঙ্গ একই প্রান্তে সমীভূত।
‘জলপাই রঙের একটি হেলমেট আর একজোড়া বুট’ গ্রন্থের গল্পগুলোতে কেবল মিলুর মতো পাখির প্রতি মমত্ব লালনকারী কিশোর নয় বরং দুরন্ত, চপল কিংবা নিরন্তর উৎসুক মনের বালকদের দেখা পেয়েছি আমরা। ‘যদি রোজাটা ভেঙে যায়’ গল্প পড়ে কারো মনে হবে না যে মিনার মনসুর শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষা দিতে বসেছেন। বরং এটিতে গ্রাম বাংলার দুটি বালকের প্রথম রোজা রাখা নিয়ে কৌতূহল, চাঞ্চল্য ও নানা ধারণার দ্বারা বিচলিত হওয়ার দৃশ্য মনোহর হয়ে উঠতে দেখা যায়। যেখানে অভিভাবকরা নিজের সন্তানকে বাধ্য করেননি রোজা রাখার জন্য এই দৃশ্যও অনন্য। ‘সাপটার মুখে হাসি ফুটল’ বর্ণনায় রূপকথার জগতে বিচরণ করেছেন গল্পকার। গ্রীষ্মের ছুটিতে গ্রামে ঘরের বাইরে বের হতে না পারলেও ঘুমের মধ্যে ভিন্ন জগতে পদচারণা ঘটেছে কিশোর মনের। কিশোরদের কল্প জগতের পরিবেশ সৃজনে লেখক বেছে নিয়েছেন ভয়ঙ্কর সরীসৃপকে। যে আবার কথা বলতে পারে। তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় উত্তমপুরুষের বয়ানে বিবৃতকারী গল্পকারের। এই গল্পে মুক্তিযুদ্ধের সময় শিল্পী নামক চরিত্রের চলে যাওয়ার কথা এসেছে কথকের মুখে। এই গল্পের শিল্পীর প্রসঙ্গ খোলসা হয়েছে পরবর্তী ‘শিল্পী, যাস নে’ গল্পে। দীপু আর শিল্পীর কাহিনী আছে, আছে গ্রামে খেজুর রস চুরি করার ঘটনা। একসঙ্গে বেড়ে ওঠা দীপুর কাছের বন্ধু শিল্পী গ্রাম ছেড়ে সপরিবারে চলে যায়। কারণ শিল্পীর ভাইয়ের ঢাকায় চাকরি হয়েছে। তার স্মৃতি দীপুকে বিমর্ষ করে তোলে। নিজের কষ্ট হলেও বলতে চেয়ে বলতে পারেনি ‘শিল্পী, যাস নে’। গল্পটিতে গ্রামীণ প্রকৃতির অসাধারণ বর্ণনা আছে। ‘একটি শামুকের গল্প’ গল্পকারের ব্যক্তিগত অনুভূতির অসাধারণ প্রকাশ। লেখাপড়া বাদ দিয়ে দরিদ্র শিশুর ‘মিনতি’ হিসেবে কাজ করা আর তাকে কেন্দ্র করে কথকের মনোজগতের যন্ত্রণা করুণ হয়ে উঠেছে এই গল্পে। কথকের ভেতরের যন্ত্রণা বর্ণনায় এসেছে পেলবতা তথা কাব্যিক ব্যঞ্জনা। যেমন, ‘শামুকের মতো গুটিয়ে থাকতাম সারাক্ষণ। বুঝলি, বন্ধুহীন মানুষ তো আসলে একটা শামুকই। কিন্তু বাইরে থেকে কিচ্ছু বোঝা যায় না।’(পৃ ১৭)
মিনার মনসুরের কৈশোরে দেখা মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার একটি অনন্য চিত্র অঙ্কিত হয়েছে আলোচ্য গ্রন্থের ‘জলপাই রঙের একটি হেলমেট আর একজোড়া বুট’ নামক নামগল্পে। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ দিয়ে কৌতূহল উদ্দীপক বর্ণনায় ব্যঞ্জিত এটি। যে কোনো পাঠককে গল্পটির নামকরণ সেনাসদস্য ও যুদ্ধের আবহকে স্মরণ করিয়ে দেবে। গ্রামের পূর্বপাড়া ও পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দাদের সন্তানরা পুকুরে বড়শি দিয়ে মাছ ধরার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। আর সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনপুরুষ ধরে টানটান উত্তেজনা চলছে। লেখকের মুখ্য উদ্দেশ্য যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাকে উন্মোচন করা সেজন্য পুকুরটি মূল চরিত্র হয়ে উঠেছে এখানে। মাছ ধরার উৎসব আয়োজনের মধ্যে অন্তু, সবুজ, বল্টুদের সম্পৃক্ততায় কিশোরদের নিজস্ব জগৎ তৈরি করেছেন তিনি। মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে তাদের উৎসাহী হয়ে ওঠার দৃশ্যগুলো সত্যিই সুন্দরভাবে সাজিয়েছেন লেখক। গল্পের পরিণতি ত্বরান্বিত হয়েছে সবুজের বড়শিতে ভারী কিছু আটকে যাওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে। প্রথমে বড় মাছ ভাবা হলেও পরে দেখা গেল একটি বস্তা আটকে আছে বড়শিতে। যেখানে পলিথিনে মোড়া একটি সামরিক পোশাক, একটি ভারী অস্ত্র, জলপাই রঙের একটি হেলমেট আর এক জোড়া বুট।
এই উপকরণগুলো মুক্তিযুদ্ধে সেই গ্রামে চলা হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও বাঙালির প্রতিরোধ যুদ্ধকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সকলের চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে। তবে গ্রামের কিশোর-যুবক যারা এখন প্রবীণ তারা যে প্রতিশোধ নিয়েছিল পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে তারই প্রতীকী উপস্থাপন রয়েছে গল্প শেষে জলপাই রাঙা সামরিক পোশাক, অস্ত্র, হেলমেট ও বুটের প্রসঙ্গ উপস্থাপনের মাধ্যমে। ‘তাদের চোখের সামনেই সংঘটিত হয়েছিল সেই বর্বরতা। তবে তারা ঠিকই তার প্রতিশোধ নিয়েছিল। কঠিন প্রতিশোধ। তারই একটি নিদর্শন গোপনে তারা পানির নীচে রেখে দিয়েছিল হয়তো-বা সবুজ আর বল্টুদের কথা ভেবে।’(পৃ ৩৬)
অবশ্য ‘জলপাই রঙের একটি হেলমেট আর একজোড়া বুট’ গ্রন্থের ছয়টি গল্পের কোনো একটিতে লেখক শহুরে কিশোর জীবনকে অঙ্কন করেননি। যারা শহরে বেড়ে উঠেছে তারা বর্তমান জীবনের প্রাত্যহিকতায় যন্ত্রণাকাতর। এজন্য মিনার মনসুরের গল্পগুলো সেই সব শিশু-কিশোরকে কিছু রিলিফ দেবে; প্রশান্তির জগতে নিয়ে যাবে; বাংলার প্রকৃতিকে চিনতে, জানতে সাহায্য করবে। কিশোররা রূপকথা থেকে শুরু করে দেশের অহংকারের কথা জানতে পারবে গল্পের ভেতর দিয়ে। গ্রামে থাকা কিশোরদের জীবন নিয়ে কাতর হবে শহুরের সন্তানরা। আবার বড়দের জন্য গল্পগুলো স্মরণ করিয়ে দেবে ৩০/৪০ বছর আগের গ্রামীণ জীবনের কথা। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে পাকসেনাদের গণহত্যা এবং বাঙালি যোদ্ধাদের প্রতিশোধের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে লেখক নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছেন গল্পের বয়ানে। গ্রন্থটি সুখপাঠ্য, ভাষা সহজ, সরল, সাবলীল। এটির বহুল প্রচার কাম্য।
(জলপাই রঙের একটি হেলমেট আর একজোড়া বুট, লেখক : মিনার মনসুর, প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : কাজল চৌধুরী, প্রকাশক : পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি. মূল্য : ২০০ টাকা।)