জনকের গল্প
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কিংবা তাঁকে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে অসংখ্য গ্রন্থ। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, গান, নাটক, তথ্যচিত্র, পোর্ট্রেট কী হয়নি তাঁকে নিয়ে? বাংলা সাহিত্যের সেরা লেখকরা লিখেছেন গভীর মমতা আর দরদ দিয়ে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে নিয়ে লেখা গান, কবিতা, গল্প আজও মানুষের মুখে মুখে। একটা অন্ধকার সময় এসেছিল, যখন জনকের নাম নিতেও আপত্তি ছিল শাসকগোষ্ঠীর। কিন্তু সে সময় খুব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। আর হবেই বা কেন? যাঁর নামে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে সেই দেশে তাঁর নাম বলা যাবে না বুক উঁচিয়ে, মুখ উঁচিয়ে, সেটা তো মেনে নিতে পারে না সাধারণ মানুষ।
পঁচাত্তরের পর মুজিব আবার ফিরে এসেছেন আরো বিপুল শক্তি নিয়ে। স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন সাধারণের মনে। এরই একটি অন্যতম প্রমাণ আখতার হুসেন সম্পাদিত ‘জনকের মুখ’ বইটি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা ছোটগল্পের সংকলন এটি। বইটির শুরুতেই সম্পাদক তাঁর ভূমিকায় পৃথিবীতে কে, কখন, কোথায়, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কী লিখেছেন, তার এক সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন।
সম্পাদক লিখেছেন- ‘বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুরতম হত্যা-পরবর্তী বাঙালি জাতির বিবেকের জাগরণের সবেমাত্র শুরু, অন্তত আমার কাছে তাই মনে হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বিবেকের এই জাগরণই স্মরণ করাবে তাঁকে। তাঁর মহিমা ও বীরত্বব্যঞ্জক কীর্তি পরম্পরাকে। ভারতীয় উপমহাদেশ তো বটেই, বিশ্বের আর কোনো নেতাকে নিয়ে তাঁর জীবদ্দশায় কী মৃত্যুর পরও সময় পরিসরগত বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই, বলা চলে এত কবিতা ও গান কিংবা গল্প রচিত হয়েছে বলে মনে হয় না। এও ধারণা করি, একদিন নিশ্চিতই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত হবে মহাকাব্য।’
দুই সঙ্গী গল্পে শওকত ওসমান একটি সত্য ঘটনার বর্ণনা করেন। আওয়ামী লীগের গোপালগঞ্জ শাখার প্রতিষ্ঠাতা কাজী আলতাফ হোসেনের সঙ্গে শেখ মুজিবের নৌযাত্রার বর্ণনা দিয়ে তৈরি হয় গল্পটি। গল্পে একপর্যায়ে দেখা যায় জলদস্যুর দল শেখ মুজিবের নৌকার পিছু নেয় এবং নৌকার কাছে পৌঁছে ডাকাতি করতে উদ্যত হয়। মাঝির কাছ থেকে যখন জানতে পারে, যে নৌকাতে শেখ মুজিব আছেন তখন জলদস্যু রেগে গিয়ে মাঝির গালে থাপ্পড় মেরে ডাকাতি না করে চলে যায়। আর যাওয়ার সময় বলে যায়, শুয়োরের বাচ্চা, খামাখা দেড় ঘণ্টা মেহনতি করাইলি- হারামজাদা।
বইতে ২৫ মার্চ এবং হিন্দু-মুসলমানের গল্প শিরোনামে ছাপা গল্পটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাস থেকে নেওয়া হয়। সেলিনা হোসেনের ‘আগস্টের একরাত’ উপন্যাস থেকে নেওয়া হয় আগস্টের একরাত গল্পটি। একইভাবে ‘আমি মাথা নিচু করি না’ গল্পটি আনিসুল হকের ‘যারা ভোর এনেছিল’ উপন্যাস থেকে নেওয়া হয়েছে। এই গল্পে আমরা দেখতে পাই দৃঢ়চেতা এক মহান নেতাকে।
শেখ মুজিব তাঁর দুর্বল শরীর নিয়ে বের হচ্ছেন কারাগার থেকে সামনে লোহার গেট।
দুজন প্রহরী সেটা পাহারা দিচ্ছে।
একজন জেলকর্তা তাঁকে একজন জমাদারের প্রহরায় বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন।
বড় গেটটা বন্ধ।
বড় গেটের ভেতর একটা ছোট গেট।
কারাগার কর্তা সেই ছোট গেটটা দিয়ে মাথা নিচু করে বের হয়ে গিয়ে ঘুরে মুজিবের দিকে তাকিয়ে বললেন ‘আসেন।’
মুজিব তাঁর রোগা দেহ থেকে বাঘের গর্জন বের করে বললেন- ‘বড় গেটটা খোলেন।’
কর্তা বললেন, বড় গেটের চাবি তো এখন আমার কাছে নাই।
মুজিব বললেন, ‘যার কাছে আছে তার কাছ থেকে আনেন। শেখ মুজিবুর রহমান কোনো দিনও মাথা নিচু করে কারাগার থেকে বের হয় নাই। আমার নাম শেখ মুজিবুর রহমান, আমি মাথা নিচু করি না।’
তাঁর কণ্ঠস্বরে একটা অমোঘতা ছিল। মন্ত্রতাড়িতের মতো কারা কর্মকর্তা ছুটে গেলেন বড় গেটের চাবি আনতে। মুজিব ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন অসুস্থ শরীর নিয়ে।’
ঘড় ঘড় করে বড় দরজার পাল্লা খুলে গেল। শেখ মুজিবুর রহমান কারা প্রাচীরের অন্তরাল থেকে বের হয়ে এলেন মাথা উঁচু করে।
এভাবে একেকটি গল্প পাঠে চোখের সামনে ভেসে উঠবে জনকের মুখ। আর জানা যাবে অন্য এক শেখ মুজিবকে। শুধু তাই নয়, এই বইটিকে মহান মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য এক ইতিহাসও বলা চলে। যাঁরা মহান নেতা শেখ মুজিবকে নিয়ে লিখেছেন, তাঁদের তালিকাও দীর্ঘ।
বইটির লেখক তালিকায় রয়েছেন আবুল ফজল, শওকত ওসমান, আবু ইসহাক, ফজলুল হক, কাজী ফজলুর রহমান, আবদুল হাফিজ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ শামসুল হক, রাহাত খান, আনোয়ারা সৈয়দ হক, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, রশীদ হায়দার, রেজাউর রহমান, আখতার হুসেন, সুব্রত বড়ুয়া, জুলফিকার মতিন, সেলিনা হোসেন, শেখর দত্ত, হুমায়ুন আজাদ, হারুন উর রশীদ, অসীম সাহা, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, দিলারা মেসবাহ, মাহবুব আলম, শিহাব সরকার, শরীফ খান, সৈয়দ ইকবাল, সাহিদা বেগম, ইমদাদুল হক মিলন, রফিকুর রশীদ, শেখ লুৎফর, দিলওয়ারা হাসান, আফরোজা পারভীন, সুজন বড়ুয়া, ঝর্ণা রহমান, মোসাদ্দেক আহমেদ, গোলাম শফিক, বিলু কবীর, বকুল আশরাফ, স ম শামসুল আলম, আহ্সান ওয়াহিদ, আহমাদ মাযহার, আনিস রহমান, অমল সাহা, জাকির তালুকদার, রাশেদ রহমান, আনিসুল হক, ইকবাল খোরশেদ, রাজীব নূর, মনি হায়দার, মাহবুব রেজা, আহমেদ রিয়াজ, সমীর আহমেদ, সোলায়মান সুমন, মোজাম্মেল হক নিয়োগী।
চমৎকার এই বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে। ৪৫৬ পৃষ্ঠার গল্পগ্রন্থটিতে মোট গল্প রয়েছে ৫৫টি। বইটির সুন্দর একটি নামকরণের জন্য কবি, প্রাবন্ধিক সৈকত হাবিব অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক আখতার হুসেন অত্যন্ত যত্নসহকারে ছোটগল্পের এই সংকলনটি সম্পাদনা করেছেন। সঙ্গত কারণেই কষ্টসাধ্য এই কাজটির জন্য তাঁকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই।
জনকের মুখ
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা ছোটগল্প
সম্পাদনা- আখতার হুসেন
প্রকাশক- জসিম উদ্দিন, কথা প্রকাশ।
মূল্য- ৮০০.০০ টাকা
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৫
প্রচ্ছদ- সব্যসাচী হাজরা