তারেক মাসুদের মৃত্যু স্বপ্নভঙ্গের সুর : অনুপম হায়াৎ
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন মারা যান। তাঁদের এই মৃত্যু চোখের জলে ভাসিয়েছে দেশের অসংখ্য মানুষকে। আজ গুণী পরিচালক তারেক মাসুদের মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করেছেন চলচ্চিত্র গবেষক ও লেখক অনুপম হায়াৎ। কর্মসূত্রে তারেক মাসুদের সঙ্গে অনুপম হায়াতের এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সেই স্মৃতিই অনুপম হায়াৎ শোনালেন এনটিভি অনলাইনকে।
তারেক মাসুদের সঙ্গে আমার পরিচয় সম্ভবত ১৯৭৬ সালে। আমি তার আগের বছর, ১৯৭৪ সালে ঢাকা ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে এক বছরের কোর্স শেষ করেছি। লেখালেখি করছিলাম ‘চিত্রালী’, ‘সিনেমা’, ‘বাংলার বাণী’, ‘জনপদ’, ‘মুক্তির বাণী’, ‘চাবুক’সহ অন্যান্য পত্রপত্রিকায়। এদিকে সাংবাদিকতায় এমএ-ও পাস করেছি। সিনেমার প্রতি গভীর আগ্রহ, অন্যদিকে লেখালেখি। তখন চিত্রালী পত্রিকার পাঠকদের একটা সংগঠন ছিল চিত্রালী পাঠকপাঠিকা চলচ্চিত্র সংসদ, চিপাচস। এই সংগঠনের এক অনুষ্ঠানে তারেক মাসুদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়।
তখন আমি শুনলাম, তারেক মাসুদ একটা চলচ্চিত্র সংসদ করছেন। আবার সেই সময় তিনি এস এম সুলতানের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন। আমি দেখলাম, তিনি আমার চেয়ে বয়সে ছোট। এ রকম এক তরুণ ছেলে এস এম সুলতানের মতো শিল্পীকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন। বিষয়টি আমাকে ভাবাল। তারপর থেকে সেখানেই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হতো, কথাবার্তা হতো। এদিকে তখন আমি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস নিয়ে কাজ করছিলাম। সেই সময় সাপ্তাহিক বিচিত্রাতেও খণ্ডকালীনভাবে কাজ করতাম। ফিল্ম আর্কাইভের সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম। এসব সূত্রে তারেক মাসুদসহ তাঁদের সঙ্গে উঠাবসা নিয়মিতভাবে হতে লাগল।
আমি তখন বিভিন্ন চলচ্চিত্র সংসদে সিনেমা দেখতাম। তারেক তখন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া চলচ্চিত্র নিয়ে যেসব জায়গায় সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হয়, সেখানেই তাঁকে দেখতাম। ১৯৮৭ সালের ২০ মার্চ মাসের দিকে একটা উদ্যোগ নেওয়া হলো, আমরা হীরালাল সেনের বাড়িতে যাব। চিপাচসের পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হলো। সাংবাদিক সালাম জুবায়ের, সাংবাদিক, অভিনেতা, চলচ্চিত্রনির্মাতা সদ্য প্রয়াত সাদেক খান একটা গাড়ির ব্যবস্থা করেন হীরালাল সেনের বাড়িতে যাওয়ার জন্য। গাড়িতে উঠলাম, দেখি সেখানে তারেক মাসুদ। তারপর হীরালাল সেনের বাড়িতে গেলাম, সেখানে তারেকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা আরো বাড়ল। সেখানে আমি বক্তৃতা করলাম, তারেকও করল হীরালাল সেনকে নিয়ে। পরে আমরা দুজন নানাভাবে একসঙ্গে কাজ করেছি। বিভিন্ন বক্তৃতা, সেমিনারে আমরা এক সঙ্গে অংশ নিয়েছি।
১৯৯৫ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ফুটেজ সংগ্রহ করে তারেক মুক্তির গান চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করল। এটি চলচ্চিত্রকে সাংবাদিক সমিতির বিচারক মণ্ডলী শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার দেয়। পরবর্তীকালে এই প্রেক্ষাপটে তারেক আরেকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেন-মুক্তির কথা। তারেক বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বিভিন্ন পোস্টার নিয়ে একটা কাজ করছিলেন। তিনি তখন আমার সহযোগিতা চাইলেন। তাঁর ডাকে একদিন তারেকের ফার্মগেটের বাসায় যাই। কথা বলি বিষয়টি নিয়ে।
একবার আমি প্রথম আলো মেরিল পুরস্কারের জুরি বোর্ডের সদস্য হলাম, সঙ্গে তারেক মাসুদ, কবরী, আরো অনেকেই ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে ঐকমত্যের ভিত্তিতে যোগ্য, ভালো, সৃজনশীল চলচ্চিত্রগুলোকে নির্বাচন করতে হতো। এরজন্য সেখানে চলত নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। আমি যে মতামত দিতাম, তারেক বলতেন, ‘হ্যাঁ হায়াৎ ভাই ঠিকই আছে।’ একবার তো তারেক নিজেই এই পুরস্কারের জন্য চলচ্চিত্র জমা দেন। ওই সময় তারেকের রানওয়ে আর আবু সাঈদের চলচ্চিত্রের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। পরে তারেক মাসুদের রানওয়ে পুরস্কার পায়।
তারপর থেকে তারেকের সঙ্গে দেখা হতো, কথা হতো নানাভাবে। একই সঙ্গে লেখালেখি নিয়ে কথা হতো। ১৯৮৩ সালে আমার ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস’ বইটি প্রকাশের পর তারেক আমাকে জানান, ‘কভারে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের ছবি দিলে ভালো হতো।’ তখন আমি বললাম, ‘দেখ তারেক, আমারও খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু দিতে পারলাম না।’ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে আসলে সেটা পারিনি।
তারেক মাসুদ চলচ্চিত্র মাধ্যমটিকে একটা শিল্প হিসেবে নিয়েছিলেন। এর মাধ্যমে কীভাবে একটা জাগরণ সৃষ্টি করা যায়, সেই চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। বাংলার নিজস্ব সাহিত্য, সংস্কৃতি, জীবনবোধ সম্পর্কে সজাগ ছিলেন তিনি। এসব কিছু মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় চলচ্চিত্র মাধ্যমে, সে চেষ্টা অব্যাহত রাখেন তারেক। তিনি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, জীবন, সমাজ-এই সবকিছু জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। আর সেজন্য তারেক নিজ উদ্যোগে প্রজেক্টরও বোধহয় কিনেছিলেন।
আমরা যদি আফ্রিকান চলচ্চিত্রের দিকে লক্ষ্য করি, সেখানে উসমান সেমবেন যেমন আফ্রিকানিজম তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। আফ্রিকার জীবন-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, ঠিক তেমনি তারেক মাসুদ চেয়েছিলেন বাংলার সংস্কৃতি, জীবনবোধকে তুলে ধরতে। তাঁর ফ্রেমের মধ্যে ঢুকে গেছে মুক্তির গান, নৌকা বাইচ। নৌকা বাইচ, নৌকা বাইচের মতো করেই ফ্রেমে ধরেছিলেন তারেক। ক্যামেরাকে তিনি ওইভাবেই ব্যবহার করেছিলেন। মিউজিকটা তিনি তেমন করেই ব্যবহার করেছেন, দোতারাটা তেমন করেই ব্যবহার করেছেন। জারিগান, কাবাডি, মুক্তিযুদ্ধ সর্বোপরি বাংলার জীবন ছিল তারেকের উপজীব্য। তারেকের এই বিষয় আমার খুব ভালো লাগত।
তরুণদের সঙ্গে আমার সবসময় আত্মার সম্পর্ক। ওই সময়ের তরুণ চলচ্চিত্রকারদের সঙ্গে আমার পরিবারের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তারেক মাসুদ, মীশুক মুনিরসহ অন্যরা যখন দুর্ঘটনার শিকার হন, তখন আমি এক সংবাদপত্র অফিসে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি সেখান থেকে বাসার উদ্দেশে রওনা দেই। বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই আমার ছোট্ট নাতির মুখে এই নির্মম বাস্তবতার কথাটা শুনতে হয়। আমার নাতি খুব ছোট ছিল তখন। মাত্র কথা বলতে শিখছে। সে ভাঙা ভাঙা শব্দে এই কথা আমাকে বলল, ‘নানা ভাই, তারেক মাসুদ নানা মারা গেছে অ্যাক্সিডেন্টে।’ এ কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই।
মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল, তারেক মাসুদ, মুস্তফা কামাল, মানজারে হাসিন মুরাদ-এদের মতো নির্মাতাদের নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখতাম। ভালো চলচ্চিত্র, জীবনমুখী চলচ্চিত্র হচ্ছিল। সামনেও হবে। তবে তারেকের মৃত্যু সেখানে স্বপ্ন ভঙ্গের সুর বাজিয়ে দেয়।
অনুলিখন : প্রদীপ দাস