গল্প পড়ার গল্প
গৌরকিশোর ঘোষের লেখায় ছিল সত্যকথন

২২ জুন ২০১৩, যশোর জেলার হাট গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন গৌরকিশোর ঘোষ, সর্বজন শ্রদ্ধেয় গৌরদা । প্রয়াত হয়েছেন ২০০১-এ। গৌরকিশোর সৃজনশীল লেখক, না সাংবাদিক, না সোস্যাল অ্যাক্টিভিস্ট তা ঠিক করা যায় না। এমারজেন্সির সময় তাঁকে জেলখানায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল রাষ্ট্র। যখন তাবৎ বিপ্লবী রাজনীতিকরা বাড়ি বসে আছেন বা বিদেশে কাটাচ্ছেন তখন গৌরকিশোর, বরুন সেনগুপ্ত জেলখানায়। ভাগলপুরে দাঙ্গা, গৌরকিশোর সেখানে; বন্দিদের চোখে অ্যাসিড ঢেলে অন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ, তিনি সেখানে। ১৯৭২-এ শাসকের মাস্তানিতে কলকাতা হয়ে গেছে অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন, তিনি লিখছেন, কলকাতা এক প্রমোদ তরণী হা হা হা, তলিয়ে যাওয়ার আগে, তলিয়ে যাওয়ার পর। তাঁকে আমরা চিনি ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’, ‘প্রেম নেই’ বা ‘প্রতিবেশ’ নামের সেই সব স্মরণীয় উপন্যাসের মাধ্যমে, যেখানে হিন্দু, মুসলমান দুই সম্প্রদায় পাশাপাশি রয়েছে তাঁর জীবন বীক্ষা নিয়ে। তিনি স্মরণীয় ‘ব্রজদার’ গুল্প সমগ্রে বা রাজনৈতিক লেখালেখিতে। দেশ পত্রিকায় লিখতেন গৌড়ানন্দ কবি ভনে নিয়মিত কলাম। রাজনৈতিক অনাচার ছিল তাঁর বিষয়। ডান বাম কেউ বাদ যেত না। আমি এই মহাত্মা লেখক ও সাংবাদিকের কাছে গিয়েছি বেশ কয়েকবার। তিনি ডেকেছেন, তাঁর কথা শুনতে গেছি। মনে হয়েছে এই সব মানুষ বিরল প্রজাতির। মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা কী, তা তাঁকে দেখে সামান্য শিখেছি। গৌরকিশোরের গল্পে ছিল ক্ষুরধার ব্যঙ্গ, বিপন্ন মানুষের জন্য হাহাকার আর বেদনা বোধ। রাজনীতির ভ্রষ্টাচার, সত্যকথন ছিল তাঁর লেখার সুর। উপরিল্লিখিত গল্প ব্যতীত ‘সাগিনা মাহাতো’র কথা মনে পড়ে পাঠক ? তপন সিংহ ‘সাগিনা মাহাতো’ নিয়ে স্মরণীয় ছবি করেছিলেন।
‘শরৎদা’ গল্পটির কথা বলি শুনুন। আমাদের দেশের তথাকথিত বাম রাজনীতি কত শুদ্ধ মানুষ, ত্যাগী মানুষের প্রতি বিষ্ঠা ছড়িয়েছে। এ অভিজ্ঞতা আমাদের বাল্যকালে অতুল্য ঘোষ আর প্রফুল্ল সেন নিয়ে হয়েছে।
শরৎদা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। গল্প কথক উত্তম পুরুষে লেখা গল্পে বলছেন, আদর্শবাদী শরৎদা তাঁদের স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, স্কুলের হেড স্যার রায়বাহাদুর খেতাবের জন্য শরৎদাকে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে তুলে দিতে দ্বিধা করেন না। শরৎদা স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিপ্লবী। প্রিয় শিক্ষক শরৎদাকে যখন লালমুখো সায়েব পুলিশ আর দেশি পুলিশ মিলে ইস্কুল থেকে গ্রেপ্তার করে হাতকড়া দিয়ে ভ্যানে তোলে, হেড স্যার তখন হাত কচলাচ্ছেন লালমুখো পুলিশ সুপারের সামনে। সব নিস্তব্ধ। ছেলেরা সব কাঁদছে। তখন উচু ক্লাসের ছাত্র দিন্দা পাঁচিলের উপর দাঁড়িয়ে শরৎদার জয়ধ্বনি দেয়। হেড স্যার আতঙ্কিত হয়ে তাকে নেমে আসতে বলেন পাঁচিলের উপর থেকে। তখন সে বন্দে মাতরম ধ্বনি তোলে। ইস্কুলের ছাত্ররা তাতে গলা মেলায়। শরতদা ছিলেন বিপ্লবী, স্বাধীনতার জন্য আত্ম-নিবেদিত মানুষ। স্বাধীনতা এলো। শরৎদা গরিবের পার্টিতে ( বোঝাই যায় কম্যুনিস্ট পার্টি ) নিবেদিত।
বিপ্লবী বা দরিদ্রের প্রতি আত্মনিবেদিত শরৎদার সঙ্গে দেখা হয় করবীর। সেও এসেছিল পার্টিতে। একটি মেয়ে পার্টি দ্বারা কী ভাবে ব্যবহৃত হয়, তা এই গল্পে আছে। আছে ক্ষমতার লোভ মানুষকে কতটা নির্মম আর হৃদয়হীন করে তোলে।
দিন্দা ছিল শরৎদার ছাত্র। দিন্দা পার্টিতে এসে ক্রমশ পার্টির ক্ষমতা নিজের কেন্দ্রে নিয়ে আসতে থাকে। শরৎদার ছাত্রী ছিল করবী। করবী পার্টিতে আসে হয়তো শরৎদার প্রতি তার মুগ্ধতায়। সে শরৎদার প্রেমে পড়েছিল। আদর্শবাদী শরৎদা তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, কেন না দেশের প্রতি আর মানুষের প্রতিই তাঁর দায়বদ্ধতা। আসলে পার্টি আর রাজনীতি মানুষকে ক্রমশ যে রোবটে পরিণত করে, তার চিহ্ন রয়েছে এখানে, শরৎদা বলছেন করবীকে, ‘এই মতলবে তুমি পার্টি করতে এসেছিলে! ছিঃ, ঘেন্না ধরিয়ে দিলে। দ্যাখ করবী, রাজনীতি করবে তো তাই কর, বিয়ে করে সংসার পাতবে তো তাই পাতো, কিন্তু দুটো এক সঙ্গে করতে যেও না। দুটো মুনিবকে একসঙ্গে সেবা করা যায় না।’
দিন্দা ফিল্ড ওয়ার্কার আর শরৎদা তাত্ত্বিক। দিন্দা লেখাপড়ার ধার কাছ দিয়ে যায় না, বলে অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে মার্কসবাদ উপলব্ধি করা যায়। শরৎদা এর বিপক্ষে। পার্টিতে ক্রমশ শরৎদার আধিপত্য কমিয়ে দিতে থাকে দিন্দা। প্রত্যাখ্যাতা করবীকে নিজের সমর্থনে নিয়ে আসে সে। করবী হয়ে ওঠে দিন্দার হাতের পুতুল। করবীকে ক্রমশ দখল করে নেয় দিন্দা। প্রেমে আঘাত করবীর ভিতরে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। পার্টি, রাজনীতি শেষ অবধি কিন্ত দিন্দার ক্ষমতা দখলের রাজনীতি হয়ে ওঠে। আর এই অভীপ্সা কোথায় কতদূর যেতে পারে তা শরৎদার পরিণতির ভিতর দিয়ে ধরা যায়। বন্যাত্রাণের জন্য তহবিল তোলা হয়েছিল। সেই কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন শরৎদা। কমিটিটা ছিল সব পার্টি মিলিয়ে। হিসেবে দেখা গেল দেড় হাজার টাকার কোনো খোঁজ নেই। রহস্যজনক ভাবে ওই টাকা উধাও। শরৎদা পাগলের মতো হয়ে গেলেন। টাকার হদিশ করতে পারলেন না। ফলে শরৎদা কেন, পার্টিরও বদনাম হতে লাগল। এর বলি হতে হল শরৎদাকে।
এই গল্প এক হাহাকারের গল্প। একটি আদ্যন্ত সৎ মানুষের ঘাড়ে সমস্ত দোষ চাপিয়ে পার্টি হাত ধুয়ে ফেলল। সব পার্টির মিটিং ছিল সেইটি। তহবিল তছরূপের সভা। সেই সভায়, পেট্রোম্যাক্সের আলোর নিচে শরৎদাকে সবাই চোর বলে অভিহিত করতে লাগল। করবী আর দিন্দা চুপ। তাদের পার্টি শুদ্ধ থাকুক, শরৎদার যা হয় হোক। পার্টির জন্য আত্ম-নিবেদিত শরৎদা, স্বাধীনতা সংগ্রামী শরৎদা, নির্লোভ আর সৎ মানুষটিকে চোর সাজিয়ে দিল পার্টি। অত লোকের সভায় করবীর মুখ দিয়ে দিন্দা বলিয়ে দিল, শরৎবাবু যদি টাকা চুরি করে থাকেন তো তার যাবতীয় ঝক্কি তিনিই সামলাবেন, তাদের পার্টি তার মধ্যে জড়াবে কেন? পার্টি মিটিঙে শরৎবাবু হিসেব দাখিল করতে পারেন নি, সন্তোষজনক হিসেব দেখাতে পারেন নি, তাই তাঁর সভ্যপদ বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।
বজ্রাহত হলেন শরৎদা। তিনি বলতে চেয়েছিলেন, করবী কি বলছে, তিনি টাকা চুরি করেছেন? সকলে তাঁকে চোর চোর বলে বসিয়ে দিয়েছিল। এরপর করবী আর দিন্দা তাকে ফেলে চলে যায়, আর সেই জনতা, বন্যাত্রাণ কমিটির লোক মাথা কামিয়ে শহর ঘোরায় তাঁকে। গল্প কথক ছিল তাঁর সঙ্গে। সে দেখেছিল আদর্শবাদী মানুষটির অসম্মান। ফিরে গেলেন শরৎদা তাঁদের সেই ফেলে আসা জমিদার বাড়িতে। একটি কুটুরিতে নিলেন আশ্রয়। আর বেরোতেন না। তাঁর একটা বিয়ে দিয়েছিল আত্মীয়স্বজন, কিন্তু সেই বউ সন্তান প্রসবের সময় মারা যায়। সন্তানটিকে নিয়ে তিনি যে ঘরে থাকতেন তার জানালা দরজা সব বন্ধ। শরৎদা মনে করতেন ঘরের বাইরের বাতাস খুব বিষিয়ে গেছে, বাইরে খুব নোংরা। তাঁর ঘরে গল্প কথক একবার ঢুকেছিল, শরৎদা বলেছিলেন, বাইরে লাইজল আছে, হাত ধুয়ে ঢুকতে। শরৎদার মেয়েটি চার বছরের বেশি বাঁচে নি ওই অন্ধ কুঠুরিতে। করবী পার্টি ছেড়ে সংসার পেতেছে ভালো। দিন্দা পার্টি নিয়ে আছে। হ্যাঁ, সেই উধাও হওয়া দেড় হাজার টাকার সন্ধান মেলেনি, কিন্তু পার্টি এরপর এমন অনেক খরচ করে যার টাকা এসেছিল কোথা থেকে সেই প্রশ্ন মনে জাগলেও, বলেনি কোনোদিন কথক। এই গল্প আমাদের রাজনীতি আর ক্ষমতার এক ভয়ানক রূপ দেখিয়ে দেয়। শরৎদার জন্য চোখের কোণে একটু অশ্রুবিন্দু ছিল যে তা জানতে পারা যায় না আগে।