বার্লিনে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রবিরোধী সম্মেলন
বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবনের কোলঘেঁষে বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদে জার্মানির বার্লিনে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
গত শনি ও রোববার বার্লিন শহরের গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার কেন্দ্রে আয়োজিত দুদিনব্যাপী এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন ও বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন।
আজ সোমবার তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
সম্মেলনের শেষ দিন গতকাল রোববার রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করে সুন্দরবন বাঁচাতে বার্লিন ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়। ঘোষণাপত্রের সঙ্গে পরিবেশ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যবিষয়ক সংগঠন গ্রিনপিস, ফেন্ডস অব দি আর্থ. ৩৫০.অর্গ, ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড ফাউন্ডেশন, উইমেন এনগেজ ফর দ্য কমন ফিউচার, ব্যাংকট্রাকসহ সারা বিশ্বের প্রায় একশ সংগঠন সংহতি প্রকাশ করে।
সম্মেলনে বাংলাদেশে রামপাল প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব ও বাংলাদেশে বিকল্প জ্বালানির সম্ভ্যবতা নিয়ে চারটি অধিবেশনে মোট আটটি প্রবন্ধ পাঠ করেন আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী জার্মানিসহ ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, হল্যান্ড, নরওয়ে ও জার্মানিতে বসবাসরত ছাত্রছাত্রী, গবেষক ও পেশাজীবীরা এ বিষয়ে তাঁদের মতামত প্রকাশ করেন।
রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন বাঁচানোর দাবি ও বিকল্প জ্বালানিবিষয়ক সম্ভাব্য নীতি খুঁজে দেখার দাবি করেছেন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ইউরোপীয় নেটওয়ার্ক।
বার্লিন ঘোষণাপত্রে সুন্দরবনের অনতিদূরে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের কারণে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভে সম্ভাব্য ক্ষতি, ভারত ও চীন বা এশিয়া ও ইউরোপের অন্যান্য দেশের উদাহরণ গ্রহণ করে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণসহ বাংলাদেশের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক প্রকল্পগুলো বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে।
সম্মেলনের শুরুতে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ইউরোপীয় নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে সৈয়দ বাবুল ও মোস্তফা ফারুক শুভেচ্ছা বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশে চলমান রামপাল ও বিকল্প জ্বালানি বিষয় নিয়ে যে আলোচনা ও আন্দোলন চলেছে, তার ব্যাপকতা ছড়িয়ে দিতে এবং সংহতি প্রকাশের লক্ষ্যেই এ ইউরোপীয় সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে।
সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে ‘রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সুন্দরবনে পরিবেশগত প্রভাব’ শীর্ষক আলোচনায় প্রবন্ধ পাঠ করেন গ্রিনপিসের মিসেস কেসটিন ডোরেনব্রুক, বার্লিন বয়েথ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা গুডরুন কামাস এবং পরিবেশবিষয়ক সাংবাদিক ক্যাথারিনা ফিঙ্কে। এই অধিবেশনটি পরিচালনা করেন পটসডাম জার্মান জিওসায়েন্স গবেষণাকেন্দ্রের গবেষক ড. অনিমেষ গাইন।
সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে ‘কয়লানির্ভর জ্বালানি নীতি, জলবায়ুতে তার প্রভাব এবং সবুজ জ্বালানি নীতিতে রূপান্তর’ বিষয়ক অধিবেশনে বক্তব্য দেন বার্লিন হুমবল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভিলফ্রেড এন্ডলিশার, কোলন প্রযুক্তি কলা ও বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হার্টমুট বেরভোল্ফ, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ও জার্মান পরিবেশ ফোরামের এলিজাবেথ স্টাউড। অধিবেশনটি পরিচালনা করেন বার্লিন হুমবল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞানবিষয়ক গবেষক ওয়াহেদ চৌধুরী।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘বাংলাদেশর জন্য সবুজ জ্বালানির সম্ভাবনা ও সম্ভ্যবতা’ শীর্ষক তৃতীয় অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন হ্যানোভারের লাইবনিজ ফলিত ভূ-পদার্থবিদ্যা ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. মোহম্মদ আজিজুর রহমান ও বাংলাদেশে বিকল্প জ্বালানিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাহবুব সুমন। এই পর্বের অধিবেশনটি পরিচালনা করেন বার্লিন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক তানজিয়া ইসলাম।
সম্মেলনের চতুর্থ অধিবেশনে সুন্দরবন অঞ্চলে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল ও বাংলাদেশে বিকল্প জ্বালানির সম্ভ্যবতা নিয়ে আন্দোলন ও সংহতি প্রকাশের লক্ষ্যে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অ্যাক্টিভিস্টদর মধ্য মতবিনিময় হয়। পর্বটি পরিচালনা করেন ড্রেসডেন হেল্মহোলজ গবেষণাকেন্দ্রের গবেষক দেবাশীষ সরকার।
এসব অধিবেশনে বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য এক অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। সিডর-আইলার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণের উপকূলীয় অঞ্চলের একমাত্র রক্ষাকবচ এবং সেইসঙ্গে লাখো বনজীবী মানুষের জীবিকার উৎস হিসেবে ভূমিকা রাখে। রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ফলে সুন্দরবনের পাশাপাশি মানুষের জীবন-জীবিকা সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে।
সুন্দরবনকে শুধু বাংলাদেশের নয়, তা বিশ্ব জলবৈচিত্র্যের সম্পদ বলে অভিহিত করেন এবং তা রক্ষা করতে সবাইকে সোচ্চার হবার আহ্বান জানান বক্তারা।
আন্তর্জাতিক এই সম্মেলন চলাকালীন সুন্দরবনের আলোকচিত্রের প্রদর্শনী করেন ফটোসাংবাদিক ডেভিড ওয়েন। এ ছাড়া সুন্দরবন ও তার পরিবেশবিষয়ক ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।