ঘুরে এলাম টাঙ্গুয়ার হাওর, নীলাদ্রি
ভ্রমণ করতে কার না ভালো লাগে। সময় ও সুযোগ পেলে সবাই কমবেশি ভ্রমণ করতে চায়। একসময় ঘোরাঘুরিকে নিতান্তই বিলাসিতা ভাবা হতো। এখন আর সেদিন নেই, আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ এখন সুবিধামতো সময়ে দেশ ও বিদেশে বেড়াতে যাচ্ছে। এ ছাড়া তথ্য প্রবাহের ব্যাপক সুবিধা থাকায় দেশের কোথায়, কোন অঞ্চল আকর্ষণীয় তা কমবেশি অনেকের জানা। আর সুনামগঞ্জ শহর তো সিলেটের বেশ নিকটে, যদিও এ শহরে নানা সময়ে অনেক কাজে যাওয়া হয়েছে তবে রাত্রিযাপন করা হয়নি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে বেকার জীবনের প্রারম্ভে ১৯৯৪ সালে সুনামগঞ্জে প্রথম যাওয়া হয়। বেকারত্ব দূর করতে কি যে সাধনা, তাই সুযোগ পেয়ে তখন ধান চালের ব্যবসা শুরু করি। এজন্য মূলত প্রথমবার সুনামগঞ্জ যাই। এরপরও বেশ কয়েকবার নানা প্রয়োজনে সুনামগঞ্জ যাওয়া হয়েছে কিন্তু থাকা হয়নি।
এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্গাপূজার ছুটি হলে ভাবছিলাম কোথায় যাওয়া যায়। একবার ভেবেছি কুমিল্লা যাব। অবশেষে আমি ও চুনী সুনামগঞ্জ যাওয়াকেই প্রাধান্য দিলাম। অবশ্য সুনামগঞ্জ ঘুরে এসে মনে হলো আরো আগেই বেড়ানোর জন্য এ শহরে আসা উচিত ছিল। এখন তো আর উচিত অনুচিত ভেবে লাভ নেই।
সুনামগঞ্জ বেড়াতে এসে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের সন্ধান না করে বেড়ানোর সময়টাকে উপভোগ করি। সেই ভাবনা থেকে একটি গেস্ট হাউজে থাকাকে প্রাধান্য দিলাম। কারণ ভেবেছিলাম, গেস্ট হাউজে বাড়তি অনেক সুবিধা আছে যা অনেকটা রিসোর্টের মতো। ২০১৬ সালে কোরবানির ঈদের ছুটিতে ছোট ভাই ফজলে রাব্বী, মান্নীসহ আমি ও চুনী মৌলভীবাজার জেলার দোসাই রিসোর্টে থাকার জন্য ঘুরতে যাই। দোসাইয়ের সুইমিং পুলটি বেশ চমৎকার। দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটক দোসাই রিসোর্টে বেড়াতে আসে। আমাদেরও তা পছন্দ হয়।
এ জন্য ভাবলাম, সুনামগঞ্জ গিয়ে গেস্ট হাউজে থাকলে রিসোর্টের সুবিধা কিছুটা পাব। কিন্তু বাস্ততে তা পাওয়া যায়নি। তবে আর্থিক বিষয়টি বিবেচনায় আনলে তা বেশ ভালো। গেস্ট হাউজটির রুম ভাড়া তুলনামূলকভাবে রিসোর্টের চেয়ে অনেক কম। ২৯ সেপ্টেম্বর গেস্ট হাউজে ওঠে একটু ফ্রেশ হওয়ার পর টাঙ্গুয়ার হাওর ও নীলাদ্রি দেখার জন্য বের হয়ে পড়ি। আসলে পর্যটনের দিক দিয়ে সুনামগঞ্জ শহর এখন বেশ এগিয়ে আছে। সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার পথে দলবেঁধে অনেককে বেড়াতে দেখলাম। তরুণ-তরুণীদের ঘোরাঘুরি দেখে তাদের সীমাহীন আনন্দ আড্ডার বিষয়টি ফুটে ওঠে।
আমরা প্রথমে গাড়ি দিয়ে তাহিরপুর নৌকা ঘাটে যাই। ঘাট থেকে সুবিধাজনক ভাড়াতেই বড় নৌকা পেয়ে গেলাম। মানিব্যাগ হাল্কা হয়ে যাবে তাই স্পিডবোট ভাড়া নেওয়ার কথা চিন্তা করলাম না। তবে টাঙ্গুয়ার হাওরে স্ডিডবোট চলার মনোমুগ্ধকর নানা দৃশ্য দেখতে পেলাম। দ্রুত গতিতে স্ডিডবোট চলার দৃশ্য সত্যি অন্যরকম। আমাদের বড় নৌকা ভালোই চলছিল। নীলাদ্রি যেতেও আমাদের কোনো সমস্যা হলো না। আর টেকেরহাট যাওয়ার পথে চারদিকের দৃশ্য খুবই সুন্দর। তাই সময় কোনদিকে দ্রুত চলে গেল, আমরা বুঝতে পারলাম না। আমরা টেকেরহাট ঘাটে এসে নীলাদ্রি দেখার জন্য নেমে পড়ি। এখানে এসে আমাদের আনন্দের মাত্রা আরো বেড়ে গেল। একদিকে ঝমঝম বৃষ্টি আর অন্যদিকে তরুণ-তরুণীদের আনন্দ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে আমরাও মিশে গেলাম।
নীলাদ্রি ঘুরে দেখার একপর্যায়ে একটু সামনে আগাতে গিয়ে ভারতের সীমান্ত দেখতে পাই। সীমান্ত পাহাড়া দিচ্ছে দুই দেশের সীমান্ত প্রহরী বর্ডার গার্ড ও বিএসএফ। সীমান্ত এলাকায় ঘুরতে মন চাইল। কিন্তু নিরাপত্তার কথা ভেবে আর অগ্রসর হলাম না। নীলাদ্রির চারদিকের রূপ সৌন্দর্য দেখে ফিরে আসার সময় পরিচিত অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। এবার টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরে দেখার পালা। নৌকাতে আবার উঠলাম। মাঝি নৌকা ছাড়ল। প্রবল বৃষ্টি শুরু হলো। মাঝি থেকে ছাতা নিলাম। কিন্তু মনের আনন্দে বৃষ্টিতে না ভিজে থাকতে পারলাম না। হাওর ছিল শান্ত, তবে কখনো তা প্রবল ঝড় আসলে তরুণ-তরুণীদের মতো উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত ওঠে।
এক সময় বৃষ্টি বেগ বেড়ে গেলে নৌকার ভেতরে গেলাম। ভেতরে বিশ্রাম নেওয়ার মতো সুন্দর ব্যবস্থা আছে। মাঝি এই সুন্দর ব্যবস্থা নিয়ে মজার গল্প করল। বলল যে, এখানে অনেকে এসে হাওরের মুগ্ধতায় ডুবে গিয়ে রাত্রিযাপন করে, তাই বিছানা বালিশের সুন্দর ব্যবস্থা রাখতে হয়। আমরাও বিছুক্ষণের জন্য এই সুন্দর ব্যবস্থার সুযোগ কাজে লাগাই। একটু বিশ্রাম নিয়ে নেই। স্বল্প সময়ের মাঝে বৃষ্টি থেমে গেলে হাওরের প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার জন্য নৌকার ভেতর থেকে আবার বের হয়ে আসি। সৌন্দর্যের মুগ্ধতায় সময় দ্রুত চলে যায়। এক সময় তাহিরপুর ফিরে এসে রেস্টুরেন্টে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নিই। এখন আবার সুনামগঞ্জ শহরের দিকে যাত্রা, গন্তব্য গেস্ট হউজ।
রাস্তায় কোনো ঝামেলা না থাকায় শহরে আসতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না। তবে আসার পথে ড্রাইভার নির্মলের মোবাইলে ফোন এলো। সে কথা বলা শুরু করে দিল, আমি গাড়ি চালানো অবস্থায় কথা বলতে নিষেধ করি। সে বলে, স্যার বউয়ের ফোন, আমি তখন কথা শেষ করার অনুমতি দেই। কারণ বউয়ের জন্য সব কিছু হজম করা যায় ।কিন্তু তার বউ শিল্পীর কথা তো আর শেষ হয় না। আসলে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার গল্প শেষ হওয়ার নয়। তবে গাড়ি চালানো অবস্থায় দীর্ঘ প্রেম আলাপ না হলেই ভালো হয়।
একপর্যায়ে কথা শেষ হলে মনের আনন্দে নির্মল গাড়ি চালাতে শুরু করে। তার আনন্দ দেখে আমাদেরও ভালো লাগে। রাস্তায় কোনো ঝামেলা না হওয়ায় ঘণ্টা দেড়েক পর গেস্ট হাউজে ফিরে আসি। একটু সময় বিশ্রাম ও ফ্রেশ হওয়ার পর এবার শহর ঘুরে দেখার উদ্দেশে বের হই।
টমটমে শহর ঘুরে দেখতে বেশ মজা, ভাড়াও তুলনামূলক কম। রিভার ভিউ, কুটুমবাড়ি, শহীদ স্মৃতিকেন্দ্র ও পাঠাগার ঘুরে দেখি। রাতের খাবারও রেস্টুরেন্টেই খাই।
রাতের খাবারের পর জগৎজ্যোতি পাঠাগারে চৈতন্য প্রকাশনীর রাজিব চৌধুরীর উদ্যোগে আয়োজিত প্রকাশনা উৎসবেও যোগ দেই। এখানে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাবিরুল ইসলামসহ অনেক বিশিষ্টজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। সুন্দর প্রোগ্রাম উপভোগ করে গেস্ট হাউজে রাত্রিযাপন করি। সকালে ঘুম থেকে ওঠে নাস্তা করে হাসন রাজার বাড়ি দেখতে যাই। হাসন রাজার প্রপৌত্র সামারীন দেওয়ানের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁর কাছ থেকে হাসন রাজা সম্পর্কে অনেক বিষয় জানতে পারি। কথার বলার একপর্যায়ে তিনি আমাকে কিছু দুঃখের কথা শেয়ার করেন। তিনি বলেন, ইদানীং একজন নাট্যকার হাসন রাজাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনের প্রয়াস চালাচ্ছেন। আমি তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া কিছু বলতে পারিনি।
সব মিলে এবারের সুনামগঞ্জ ভ্রমণ আনন্দদায়ক হয়েছে। ঘুরাঘুরি শেষে ৩০ সেপ্টেম্বর সিলেটে ফিরে আসি। বর্তমানে দেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশ হচ্ছে। যার জন্য প্রতি বছর ৮০ লাখ মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশের বিভিন্ন পর্যটন এলাকায়। এতে বিশাল অঙ্কের টাকা হাতবদল হয়। আর পর্যটন শিল্পের বিকাশে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, নীলাদ্রি ও হাসন রাজার বাড়িসহ নানা স্পটের ভূমিকা রয়েছে। জল জ্যোৎস্নার এ শহরের মানুষ, প্রকৃতি ও সৌন্দর্যের কথা ভুলা যাবে না।