ছুটির দিনে
নিঝুম দ্বীপের, নিঝুম অরণ্যে
‘নিঝুম দ্বীপ’ আপনাকে এনে দেবে পূর্ণতা। যেখানে পাশে ও সঙ্গে থাকবে সীমাহীন জলরাশি, উড়ে যাওয়া গাংচিল, চিরসবুজ গ্রামের যাপিত জীবন, জেলেদের জলের আবাস। গোধূলির রঙিন আলো, আঁধার রাতের নীরবতা, নিজেকে, নিজের প্রশ্ন করার অবারিত অবসর আর ব্যস্ত জীবনের কিছু খণ্ডিত ক্ষণ।
শুধুই বসে থাকার আর দুচোখ ভরে উপভোগের সেই অধরা বিলাসিতা নিঝুম দ্বীপে। ঢাকা থেকে হাতিয়া ১৫ ঘণ্টার বিলাসবহুল লঞ্চ ভ্রমণের পর নিঝুম দ্বীপ পৌঁছে যতক্ষণ থাকবেন ব্যস্ততাহীন প্রকৃতির বিশাল ব্যঞ্জনা।
লঞ্চ থেকে নেমে বাইকে মোক্তারিয়া ঘাট, নদী পেরিয়ে আবারও বাইকে বা রিকশায় নিঝুম দ্বীপের নিঝুম অরণ্যের পথে। নিঝুম অরণ্যের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা এক ঢালাই করা সর্পিল নদ যেন। হ্যাঁ, নিঝুম দ্বীপের মোহময় রাস্তার কথা বলছি। দুই পাশে প্রায় পাতা ঝরে যাওয়া হালকা সবুজের আচ্ছাদন, ম্যানগ্রোভ জেগে থাকা শ্বাসমূল আর চিরন্তন জেগে থাকা অরণ্যে আপনাকে স্বাগত জানাবে। মাঝেমধ্যে এঁকেবেঁকে চলা সর্পিল খাল, পাখির কিচিরমিচির, ঝরা পাতার মর্মর ধ্বনি, ধেয়ে আসা ঠান্ডা বাতাস, যেন জলরং দিয়ে আঁকা প্রকৃতির ব্যঞ্জনা আপনাকে করবে বিমোহিত।
১০ মিনিটেই ১২ কিলো বাইক একদম অবকাশের আঙিনায়। সবাই উঠে যাবেন দোতালার সিঁড়ি বেঁয়ে, একতলায়। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসপ্রবণ এলাকাতে দোতালাই, প্রাকৃতিকভাবে একতালা হয়ে যায়। এটাই নিয়ম। স্বাভাবিক। আপনি আছেন দোতালায়, কিন্তু একতালায় বুঝতে হলে পরখ করতে হবে, গিয়ে-দেখে-থেকে-উপভোগ করে, সেও এক মজা, এক বিনোদন।
ব্যাগপত্র রেখে এবার আপনি বেরিয়ে পরুন। নাম না জানা বুনো ফুল, কাঁটা জড়ানো লতা, মাঝেমধ্যে নারকেলগাছের ছায়া, কাঁচা মাটির ধুলো ওড়া পথ, ইশ কত দিন... কত দিন পর যে পায়ে সত্যি কারের বিশুদ্ধ ধুলো মাখতে আপনি পারবেন। এটা দারুণ শিহরণ। সত্যিই শিহরণ। সবাই মিলে ধুলো মাখামাখির নির্মল কৈশোরে যেন ফিরে যাবেন আপনি। আরো কিছুদূর হেঁটে গিয়ে, এক ঝোপের আড়ালে, গাছের ছায়ায়, মিহি বাতাসে, শরীর জুড়ানো পরিবেশে শুয়ে-বসে-গড়িয়ে প্রকৃতির বিশুদ্ধ আবেশ পাবেন।
বিকেলে, সবাই নৌকায় উঠে বসুন। নৌকা চলতে শুরু করবে এঁকেবেঁকে, নির্জন অরণ্যের ভেতর দিয়ে আরো অমোঘ নির্জনতার গভীরে। শব্দহীন পথ চলা একেই বলে। কোনোই শব্দ নেই, নেই এমনকি পানিতে বৈঠার ওঠা-নামার শব্দও। শুধুই পাখিদের কলতান, বাতাসের শোঁ শোঁ, শেষ চৈত্রের ঝরেপড়া পাতার ক্ষীণ টুপটাপ, গাঙচিলের উড়ে যাওয়া, রাজহাঁসের ডানা ঝাপটানো আর দূর দিগন্ত জোড়া খোলা মাঠে মহিষ পালের ফিরে যাওয়ার মৃদু হাঁকডাক ছাড়া, যার পুরোটাই প্রাকৃতিক।
বাতাসে জলের খেলা, আকাশে পাখির মেলা, মাঠে মাঠে সবুজের, দিগন্তে মেঘ-সূর্যের, নদী-খালের মোহনার, জেলেদের জালের, মাঝিদের মাছের আর দূর অরণ্যে সদ্য গজানো পাতার সঙ্গে হরিণের খেলা দেখতে দেখতে চৌধুরী খালের মোহনায়। এবার নেমে হেঁটে চলা, পায়ের আওয়াজকে নিঃশব্দ করে। মুখের ভাষাকে বোবা করে, চোখের ইশারায় স্তব্ধ করে দিয়ে এই নিস্তব্ধতাকে।
তারপর নৌকা থেকে নেমে হেঁটে চলা
সত্যিকারের নিঝুম দ্বীপের, আরো সত্যিকারের নিঝুম অরণ্যের মাথার সিঁথির মতো ক্ষীণ পথ ধরে। খুবই ধীরে ধীরে, হরিণ দেখার বাসনায় হরিণীর সতর্কতা। সবাই হাঁটছে আর খুঁজে ফিরছে কাঙ্ক্ষিতজনকে। হিমেল বাতাস গায়ে মেখে আর ঝরে পড়া শুকনো পাতা মাড়িয়ে এগিয়ে চলা। কয়েক মুহূর্ত, মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য দূরে, বেশ দূরে দেখা মিলল, একঝাঁক হরিণের। কিসের ক্যামেরা? কিসের ছবি তুলবেন। দেখতেই ব্যাকুল হয়ে যাবে।
আবার এগিয়ে যাওয়ার পালা। সামনে একটি পুকুর আছে, ওইখানে নাকি আসে পানি খেতে। ঝাঁকে ঝাঁকে, দলবেঁধে। ঠিক আছে, তাহলে আর দেরি না করে ওখানেই যেতে পারেন, চুপচাপ কিন্তু দ্রুত। আবার এগিয়ে যাওয়া। হরিণের তৃষ্ণার মেটানোর তীর্থে। একটু যেতেই আবারও কয়েকটির মুখ ফিরিয়ে, মুখ লুকানো। যেন লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেল। একটু থেমেই পিছু ফিরে চায়। গাছের আড়াল আর পাতার ফাঁক দিয়ে, যেন সেই আমলের কনে দেখা।
নিঝুম দ্বীপে একা গিয়ে কোনো আনন্দ নেই। এখানে যেতে হবে দল বেঁধে। বা পরিবারের সবই মিলে তবেই পাবেন আসল আনন্দ। লঞ্চের কেবিন বা ডেকে করে হাতিয়া। হাতিয়া দিয়ে অটো বা বাইকে চড়ে ৩২ কিলোমিটার দূরের মোক্তারিয়া ঘাট, নদী পেরিয়ে রিকশা বা বাইকে করে ১২ কিলোমিটার পরে নিঝুম দ্বীপের নিঝুম অরণ্যে।