আইসিসি এফটিপি : তিন মোড়ল তত্ত্বের নতুন সংস্করণ
ফিউচার ট্যুর প্রোগ্রাম বা এফটিপি নিয়ে ক্রিকেটবিশ্বে কয়েক দিন ধরে বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের এই ট্যুর প্রোগ্রামে ম্যাচ বেড়েছে বলে খুশিই হয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট অঙ্গন। আইসিসি ঘোষিত সূচি অনুযায়ী আগামী চার বছরে বাংলাদেশ খেলবে ৩৫টি টেস্ট। গত পাঁচ বছরের এফটিপির চেয়ে এবার অনেক বোশি ম্যাচ পেয়েছে বাংলাদেশ। এই কয়েক বছরে মোট ১২২টি ম্যাচ খেলবে টাইগাররা, যার মধ্যে রয়েছে ৪৫টি ওয়ানডে ও ৪২টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। বিষয়টি অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিদায়ক। তবে এফটিপিতে কি সব দেশের জন্য সমান সুযোগ রাখা হয়েছে? অন্য বড় দলগুলার মতো মাঝারি বা ছোট দলগুলোও কি সমান সংখ্যক ম্যাচ খেলবে?
আইপিএল ও বিগ ব্যাশের মতো টি-টোয়েন্টি লিগগুলোর প্রভাব পড়েছে টেস্ট ও ওয়ানডে ফরম্যাটে। আর এ কারণেই এই দুটি ফরম্যাটের আমূল পরিবর্তন করেছে আইসিসি। দুই বছরব্যাপী টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ও তিন বছরব্যাপী ওয়ানডে লিগ চালু করেছে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা।
২০১৯ সাল থেকে নয়টি দলের অংশগ্রহণে শুরু হবে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। যেখানে প্রতিটি দল তিনটি হোম ও সমসংখ্যক অ্যাওয়ে সিরিজ খেলবে। দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে চারটি দল খেলবে গ্রুপের অন্য দলগুলার বিপক্ষে। এ ছাড়া আরো দুটি দলের সঙ্গে একটি করে সিরিজ খেলতে পারবে দলগুলো। ২০২১ সালে ইংল্যান্ডে শীর্ষ দুই দল খেলবে ফাইনাল। র্যাংকিংয়ের সেরা আটটি দল অংশ নেবে এই চ্যাম্পিয়নশিপে। আট দলের বাইরে থাকায় এখানে জায়গা হয়নি আফগানিস্তান, আয়ারল্যান্ড ও জিম্বাবুয়ের। আর অপর গ্রুপে রয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শুভঙ্করের ফাঁকিটা এই জায়গাতেই।
এই গ্রুপ সিস্টেমটা করা হয়েছে ‘তিন মোড়ল তত্ত্বে’র ভিত্তিতে। গ্রুপ এ-তে রাখা হয়েছে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে। ২০১৪ সালে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতকে মূল ক্ষমতাধর করে আইসিসির সংবিধানে এক সংশোধনী আনা হয়েছিল। নির্বাহী এবং অর্থবাণিজ্য সংক্রান্ত দুটি কমিটিতে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ছিল এই তিনটি দেশ। সংস্থাটির গঠনতন্ত্রে এই তিন দেশের ছিল স্থায়ী সদস্যপদ, যাদের অপসারণের সুযোগ ছিল না। যা খুশি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ছিল এই দেশ তিনটির। ক্রিকেট দুনিয়ায় এটিই ‘বিগ থ্রি’ বা ‘তিন মোড়ল’ নামে পরিচিত। বাকি দেশগুলোর আপত্তির কারনে শেষ পর্যন্ত এই বিগ থ্রি মডেলটা টেকেনি। তবে এবারের এফটিপিতে আবার নতুন করে ফিরে এসেছে সেই পুরনো তত্ব। ভারত-অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের সঙ্গে এখন দক্ষিণ আফ্রিকার নামও আসছে। ফলে বিগ থ্রি থেকে এখন এটি বিগ ফোরে পরিণত হয়েছে। আইসিসি ঘোষিত এফটিপিতে বিগ থ্রি বা বিগ ফোরের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে।
ট্যুর প্ল্যান অনুযায়ী, ভারত আগামী বছরগুলোতে খেলবে ৩৭টি টেস্ট, যার মধ্যে ২৪টি টেস্টই অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলবে। অস্ট্রেলিয়ার ৪০টি টেস্টের ২৪টি, ইংল্যান্ডের ৪৬ টেস্টের ২৭টি ও দক্ষিণ আফ্রিকার ৩২ টেস্টের ১৯টিই এই তিনটি দেশের সঙ্গে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে কোনো টেস্ট নেই ভারতের। এমনকি ট্যুর প্ল্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের সঙ্গেও ভারতের টেস্ট নেই। তবে ২০২০ সালে এফটিপির বাইরে গিয়ে ভারতের বিপক্ষে সিরিজ খেলবে বাংলাদেশ।
বিগ ফোরের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রাধান্য পেলেও অবজ্ঞা করা হয়েছে বেশ কিছু দেশকে। বাংলাদেশ ৩৫টি টেস্ট খেলার সুযোগ পেলেও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টো। মাত্র ২৮টি স্টে খেলবে এশিয়ার দেশটি। ভারতের বিপক্ষে পূর্বনির্ধারিত সিরিজ বাদ দিলে আরো কমবে তাদের টেস্ট ম্যাচের সংখ্যা। ২০২০-২১ সালে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের টেস্ট সিরিজ হওয়ার কথা। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ এর আগে পাকিস্তান সফর বাতিল করেছে। বদলা নিতে পাকিস্তানও বাতিল করে বাংলাদেশ সফর। ২০২১ সালের সেই সফর হবে না কি না, সেটা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান বাংলাদেশে না এলে তাদের ম্যাচ সংখ্যা আরো কমবে।
ওয়ানডে ম্যাচের সংখ্যাও কমেছে পাকিস্তানের। আফগানিস্তান, আয়ারল্যান্ড, এমনকি জিম্বাবুয়েও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি ম্যাচ খেলবে!
১৩ দলকে নিয়ে ঘোষিত ওয়ানডে লিগে একটি দল খেলবে মোট আটটি সিরিজ। ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এই লিগই ঠিক করে দেবে ২০২৩ সালে বিশ্বকাপের আট দল। এই লিগে ভারত-বাংলাদেশ, ভারত-পাকিস্তান, ভারত-জিম্বাবুয়ে, অস্ট্রেলিয়া-শ্রীলঙ্কা, ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া-জিম্বাবুয়ের মধ্যকার সিরিজ নেই। বোঝাই যাচ্ছে, ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণেই এই সিরিজগুলো নেই ট্যুর প্রোগ্রামে।
এই ট্যুর প্রোগ্রামে সব দলেরই ওয়ানডে ম্যাচের সংখ্যা কমিয়ে টি-টোয়েন্টি ম্যাচের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এখানে শ্রীলঙ্কা দলের সঙ্গে এক প্রকার অন্যায়ই করা হয়েছে। গত পাঁচ বছরে লঙ্কানরা যেখানে ১০৩টি ওয়ানডে খেলেছে, সেখানে আগামী চার বছরে তারা খেলবে মাত্র ৪৮টি ম্যাচ। পাকিস্তান খেলবে মাত্র ৩৪টি ওয়ানডে। এ সময়ে ভারত খেলবে ৬১টি ওয়ানডে ম্যাচ। কিসের ওপর ভিত্তি করে এই ট্যুর করা হয়েছে, সেটা বুঝতে তো আর বাকি থাকার কথা নয়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, আইসসির এই ট্যুর প্রোগ্রামটা বড় দলগুলোকে অনেক বেশি সুযোগ দিচ্ছে আর দুর্বল দলগুলোর জন্য সেটি একটা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়।