ওভাল বিতর্ক ও একজন ড্যারেল হেয়ার
টানা বল করে চলেছেন মুত্তিয়া মুরালিধরন। আর খানিকসময় বাদেই ‘নো’ বল ডাকছেন আম্পায়ার। সেদিন এক এক শ্রীলঙ্কান স্পিনার মুত্তিয়া মুরালিধরনের বলে সাতবার নো বল ডাকেন তিনি। আম্পয়ারের এমন আচরণ নিয়ে বেশ সোরগোল পড়ে গিয়েছিল সেবার। ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান ডন ব্র্যাডম্যানও আম্পয়ারের সমালোচনায় সরব হয়ে বলেছিলেন, ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে আম্পায়ারিং দেখলাম। ক্রিকেটের সবচেয়ে বিতর্কিত আম্পায়ারদের একজন ড্যারেল হেয়ার। তাঁকে নিয়ে আলোচনার কারণ ২০০৮ সালের আজকের দিনেই আম্পয়ারিং থেকে অবসরের ঘোষণা দেন তিনি।
ড্যারেল হেয়ারের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনার একটি ২০০৬ সালের ওভাল টেস্ট। সেই টেস্টের চতুর্থ দিনের ঘটনা। ম্যাচের লাগাম সফরকারী পাকিস্তানের হাতে। চা বিরতির পর দিনের শেষ সেশনের জন্য মাঠে নেমেছেন আম্পায়াররা। পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা তখনো ফেরেনি। তাঁদের দেরি দেখে নেমে পড়েন ইংল্যান্ডের দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যান পল কলিংউড এবং ইয়ান বেল। নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত ১৫ মিনিট চলে গেল। আম্পায়ার এবং ব্যাটসম্যানরা বার বার ফিরে তাকাচ্ছেন পাকিস্তানের ড্রেসিং রুমের দিকে। আসলে গোটা কিংস্টন ওভালের দৃষ্টিই পাক ড্রেসিংরুম। টিভি ক্যামেরায় অধিনায়ক ইনজামাম-উল-হককে দু'য়েকবার দেখা গেল কিছুটা ক্ষুব্ধ চেহারায়।
এরই মধ্যে মাঠে চলে আসেন টিভি আম্পায়ার এবং রিজার্ভ আম্পায়ারও। আরো দুই মিনিট চলে গেল কিন্তু ফিল্ডারদের দেখা নেই। শেষ পর্যন্ত উইকেটের বেল ফেলে দিয়ে ম্যাচটি সমাপ্ত ঘোষণা করেন আম্পায়াররা। পাকিস্তান ম্যাচে না ফেরায় নিয়ম অনুযায়ী বিজয়ী ঘোষণা করা হয় ইংল্যান্ডকে।
আসলে পাকিস্তানের মাঠে না ফেরার পেছনের কারণটি ঘটে মূলত চা বিরতির আগে। বলা-কওয়া ছাড়াই হঠাৎ বল পরিবর্তন করেন আম্পায়ার বিলি ডকট্রোভ এবং ড্যারেল হেয়ার। সঙ্গে পাঁচ রান পেনাল্টি দেওয়া হয় সফরকারীদের। অভিযোগ, পাকিস্তান বল টেম্পারিং করেছে। আম্পায়ের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিরতির পর দল নিয়ে মাঠে নামতে অস্বীকৃতি জানান অধিনায়ক ইনজামাম। অবশ্য পৌনে এক ঘণ্টা পর পাকিস্তান মাঠে ফেরে। কিন্তু আম্পায়াররা ম্যাচ পরিচালনা করতে আর রাজি হননি।
ম্যাচের পরে সাংবাদিকদের কাছে মাঠে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন ইনজামাম, ‘তাঁরা বল পরিবর্তন করছিলেন, অথচ আমাকে জানানোর প্রয়োজনও মনে করেননি। আমি নিজে থেকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কেন বল পরিবর্তন করছেন? তাঁরা আমাকে বলেছিলেন, বলে সমস্যা আছে, এটাকে টেম্পারিং করা হয়েছে। আমি বললাম, বল আমাকে দেখান। প্রথমে তাঁরা আমাকে বলটি দেখাতে চাইলেন না। আমি বললাম, বল দেখাটা আমার অধিকার। তাঁরা আমাকে বল দেখালেন না, সেখানে আমি কিছুই দেখলাম না, কোনো পরিবর্তন হয়নি, বল ঠিকই আছে। তবুও তাঁরা বল পরিবর্তন করলেন। পাঁচ রান পেনাল্টি দিলেন। কেন? এখানে স্কাই স্পোর্টসের ২৬টি ক্যামেরা ছিল। বল টেম্পারিংয়ের কোনো প্রমাণ কেউ দেখাক।'
এ ঘটনায় হুলুস্থূল বেঁধে যায় ক্রিকেট বিশ্বে। চলে তর্ক-বিতর্ক। সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার মাইকেল আর্থার খেলা চালিয়ে না যাওয়ার জন্য আম্পায়ার হেয়ারের সমালোচনা করেন। আর নাসের হুসেইন বলেছিলেন, 'ইনজামাম যা করেছে তার জায়গায় আমি হলেও ঠিক তাই করতাম।' ইমরান খান তো এক ধাপ এগিয়ে হেয়ারকে 'মৌলবাদি আম্পায়ার' বলেছিলেন। তবে স্টিভ ওয়াহ আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে পক্ষাবলম্বন করে বলেন, 'খেলার চেয়ে কেউ বড় নয়। আইন বলে একটা বিষয় আছে।’ কিংবদন্তি জিওফ্রে বয়কট বলেছিলেন, 'আপনি যখন খেলার সময় তখন খেললেন না। পরে বললেন যে খেলবেন, এটা তো আসলে হয় না। নিয়ম আছে, আইন আছে। আমি বুঝতে পারছি পাকিস্তানের অবস্থা। আপনি প্রতারক নন, তবুও আপনাকে বলা হচ্ছে প্রতারণা করেছেন। এটা আসলেই মেনে নেওয়া যায় না।'
প্রায় এক মাসের বিতর্ক আর গুঞ্জনের পর আইসিসি পাকিস্তানকে বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগ থেকে রেহাই দেয়। সঙ্গে বিরতির পর খেলায় ফিরে না আসায় ইনজামামকে চারটি ওয়ানডে ম্যাচের জন্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। অস্ট্রেলিয়ান আম্পায়ার হেয়ারকেও অফিশিয়াল ম্যাচ পরিচালনায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। প্রায় দুই বছর পর পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাচটি ড্র ঘোষণা করে আইসিসি। তবে তার পরের বছরই এমসিসির সুপারিশে ইউটার্ন নেয় এবং আগের ফলাফল অর্থাৎ ইংল্যান্ডকেই বিজয়ী ঘোষণা করে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা।
ক্রিকেটে বল টেম্পারিংয়ের ঘটনা এটাই প্রথম বা শেষ নয়। আগে পরে বহুবার এমন অভিযোগ উঠেছে বহু ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে। অনেক অভিযোগ প্রমাণিতও হয়েছে, শাস্তি ভোগ করেছেন অনেকেই। তবে ক্রিকেটের প্রায় দেড়শ বছরের ইতিহাসে আর কোনো ম্যাচের পরিণতি এমনটি হয়নি। আর এই ঘটনার অন্যতম খলনায়ক এই ড্যারেল হেয়ার। কাকতালীয়ভাবে সেই টেস্টের শেষ দিনটাও ছিল ২১ আগস্ট। ২০০৮ সালে কানাডা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচ দিয়েই আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচে মাঠে নামেন অস্ট্রেলীয় আম্পায়ার।