তাঁর হাত ধরেই বদলে যায় বাংলাদেশের ক্রিকেট
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি... রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি? ফররুখ আহমদের কবিতার মতোই তখন বাংলাদেশের ক্রিকেটের অবস্থা। আকরাম খান, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, মোহাম্মদ রফিক, আশরাফুল, খালেদ মাসুদ সুজন, খালেদ মাহমুদ পাইলট, রাজিন সালেহসহ বেশ কিছু বিখ্যাত নাম তখন দেশের ক্রিকেটে। ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর প্রথম কয়েকটি ম্যাচে ভালোই খেলছিল বাংলাদেশ। এরপরই যেন পথ হারিয়ে বসে লাল-সবুজের দেশটি। বিচ্ছিন্নভাবে ভালো খেললেও ক্রিকেটের মূল ফরম্যাট, টেস্টে জয় আসছিল না কিছুতেই। এভাবেই কেটে যায় পাঁচটি বছর।
এরই মধ্যে ৩৫টি ম্যাচ খেলে ফেলেছে অথচ জয়ের স্বপ্ন তখনো অধরা। একের পর এক পরাজয়। টাইগারদের টেস্ট সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন মুখে মুখে, কেউ কেউ এমনও পরামর্শ দিচ্ছেন, কেড়ে নেওয়া হোক বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা। চারদিক থেকে ছুটে আসা সমালোচনার দমকা হাওয়া আরো ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে ক্রিকেটারদের মনে। আত্মবিশ্বাস একেবারে তলানিতে। এমন পরিস্থিতিতে দলপতি হাবিবুল বাশার জাগিয়ে তুললেন নাফিস ইকবাল, মোহাম্মাদ আশরাফুল, আফতাব আহমেদদের। চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়েকে ২২৬ রানে হারিয়ে বদলে দিলেন ইতিহাস। প্রথম টেস্ট জয়ের সঙ্গে প্রথম সিরিজও জিতল বাংলাদেশ। দুই ইনিংসে অর্ধশতক করে দলের জয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন বাশার। গোটা দেশকে ভাসালেন প্রথম টেস্টজয়ের উন্মাদনায়।
বাংলাদেশের প্রথম টেস্টজয়ের সারথির আজ (১৭ আগস্ট) ৪৫তম জন্মদিন। শুভ জন্মদিন পাঞ্জেরি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর কুষ্টিয়ার নাগাকান্দায় জন্ম কাজী হাবিবুল বাশার সুমনের। সরকারি চাকরিজীবী বাবা কখনোই চাননি ছেলে ক্রিকেটার হোক। চাইবেনই বা কেন? দেশের ক্রিকেট তখনো তেমন পেশাদার রূপ পায়নি। মেধাবী ছাত্র হলেও সুমনের প্রেম ব্যাট-বলে। অল্পদিনের মধ্যেই স্কুল এবং স্থানীয় ক্রিকেটের পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। ১৯৮৯ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দলে ডাক পান। ১৯৯৫ সালের এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক। ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর ১০ নভেম্বর ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ এবং বাশারের অভিষেক হয় একসঙ্গে। প্রথম টেস্টেই নিজের আগমনের ধ্বনি বাজিয়ে দেন বাশার। শ্রীনাথ-সুনিল যোশি-অজিত আগারকারদের বলের সামনে বুক চিতিয়ে করেন ৭১ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান (৩০) আসে তাঁরই ব্যাট থেকে। এরপর ক্যারিয়ারে আরো ৪৯টি টেস্ট খেলেন বাশার। ৩০.৮৭ গড়ে রান করেছেন তিন হাজার ২৬। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে টেস্টে তাঁর চেয়ে বেশি আছে কেবল তামিম ইকবাল (৩,৬৭৭), সাকিব আল হাসান (৩,৪৭৯) ও মুশফিকুর রহিমের (৩,২৬৫)। তিনটি শতকের পাশাপাশি করেছেন ২৪টি অর্ধশতক। টেস্টে এখনো পর্যন্ত তিনিই দেশের সবচেয়ে বেশি অর্ধশতকের মালিক। ২২টি অর্ধশতক করা তামিম আছেন এ তালিকার দুইয়ে। টেস্টের উভয় ইনিংসে বাশার ফিফটি করেছেন তিনবার। একটা সময় তিনি ব্যাটে নামলেই ধরে নেওয়া হতো অর্ধশতক না করে ফিরবেন না। যে কারণে তাঁকে ডাকা হতো ‘মি. ফিফটি’।
১১১ আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে ২১.৬৮ গড়ে করেছেন দুই হাজার ১৬৪ রান। তিন অঙ্কের ইনিংসে পৌঁছাতে না পারলেও করেছেন ১৪টি অর্ধশতক। ২০০৪ সালে জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব পান। কোচ ডেভ হোয়াটমোর এবং বাশারের হাত ধরেই আসতে থাকে একের পর এক সাফল্য। প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ের পাশাপাশি জিম্বাবুয়ের সেবারের সফরেই প্রথম ওয়ানডে সিরিজ জেতে বাংলাদেশ। তাঁর নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে পা রাখে বাংলাদেশ। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতকে হারিয়ে চমকে দেয় গোটা বিশ্বকে। সেবার সুপার এইটে শক্তিশালী দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেও জয় পায় বাংলাদেশ। পরবর্তীকালে বাশারের নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কা এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও প্রথম জয় পায় টাইগাররা। ১৮টি টেস্টে জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ৬৯ ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়ে ২৯টিতে জিতিয়েছেন দেশের অন্যতম সফল এ অধিনায়ক।
২০০৭ বিশ্বকাপে দল ভালো করলেও ব্যাটসম্যান বাশারের পারফরম্যান্স ছিল একেবারেই দৃষ্টিকটু। গড় মাত্র ১৩.১২, সর্বোচ্চ ইনিংসটি ছিল ৩২। এরপর ভারতের বিপক্ষে ১-০ তে টেস্ট সিরিজ হারের পর রঙিন পোশাকের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। কিন্তু ওয়ানডে খেলে যাওয়ার পাশাপাশি টেস্ট অধিনায়কত্ব ধরে রাখতে চাইছিলেন। সে বছর জুনে তার জায়গায় দুই ফরম্যাটেই নেতৃত্ব দেওয়া হয় মোহাম্মদ আশরাফুলকে। বোর্ডের ‘অবজ্ঞা আর অবহেলায়’ ক্ষুব্ধ বাশার কয়েকজন তরুণ, পুরাতন ক্রিকেটার নিয়ে পাড়ি জমান ভারতের বিদ্রোহী ক্রিকেট লিগ আইসিএলে। ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন। সে বছর ১৪ সেপ্টেম্বর ঘোষণা দেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়ার। যদিও পরবর্তী সময়ে বাশারসহ আইসিএলে যোগ দেওয়া ক্রিকেটারদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। আইসিএলে যোগ দেওয়ার সব দায় নিজের কাঁধে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনও করেন। তারপরও জাতীয় দলে কখনো ডাকা হয়নি। পরে এ নিয়ে আর কোনো আফসোসও করেননি বাশার।
প্যাড-গ্লাভস তুলে রাখলেও ব্যাট-বল থেকে দূরে যাননি কখনো। অবসরের পরেও আছেন ক্রিকেট নিয়েই। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হওয়া এ পথপ্রদর্শক বর্তমানে মুশফিক, মাশরাফিদের নির্বাচক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দেশের মানুষকে ক্রিকেট নিয়ে আশাবাদী করে তোলার পেছনে যাঁরা ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে বাশারের নাম থাকবে সামনের দিকেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের এবড়ো-খেবড়ো পথে তিনিই দিয়েছেন আলোর দিশা। মাশরাফি, মুশফিক, সাকিবদের শিখিয়েছেন ‘আমরাও পারি’ তত্ত্ব। আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান বাংলাদেশ আজ বিশ্বক্রিকেটের অন্যতম শক্তি। বাশারের রোপণ করা সে আত্মবিশ্বাসের বীজ ধীরে ধীরে প্রকাণ্ড বৃক্ষের অবয়ব নিচ্ছে। সে বৃক্ষের ছায়ায় বসে তৃপ্তির হাসি হাসতেই পারেন দেশের ক্রিকেটের এ কাণ্ডারি।