স্যার ডনের ঐতিহাসিক ‘ডাক’
এই কিছুদিন আগেই লন্ডনে হয়ে গেল বিশ্ব অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়নশিপ। যাকে উসাইন বোল্টের বিদায়ী মঞ্চ বললেও ভুল বলা হবে না। কিন্তু আফসোস! বিদায় বেলায় আলো ছড়াতে পারলেন না ‘সর্বকালের সেরা’ এ দৌড়বিদ। নিজের ফেভারিট ১০০ মিটারে রুপাও জুটল না, পেলেন ব্রোঞ্জ। আর ৪০০ মিটার রিলেতে তো চূড়ান্ত রেখাটি অতিক্রমই করতে পারলেন না রেকর্ড আটটি অলিম্পিক স্বর্ণপদকজয়ী এই অ্যাথলেট। মোহাম্মদ ফারাহর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা প্রায় একই রকম। দেশের মাটির শক্তিও কোনো কাজে আসল না। পাঁচ হাজার মিটারে রুপা গলায় জড়িয়েই বিদায় নিতে হলো এ ব্রিটিশ কিংবদন্তিকে। সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদ মোহাম্মাদ আলী ক্লেও তাঁর ক্যারিয়ার শেষ করেছিলেন হার দিয়ে। কিংবদন্তিদের বিদায়টা সব সময়ই কষ্টের। বেদনাটাকে আরো ভারি করে তোলে এমন এক একটি ট্র্যাজেডি। যা যুগ যুগ ধরে আফসোস হয়ে গেঁথে থাকে ক্রীড়াপ্রেমীদের হৃদয়ে। এমনই এক আফসোসের বিদায় ছিল অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি ক্রিকেটার স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের।
১৯৪৮ সালের ১৪ আগস্ট। অ্যাশেজের শেষ টেস্ট, যেটি ব্র্যাডম্যানেরও ফেয়ারওয়েল ম্যাচ। লন্ডনের ওভালে টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে রে লিন্ডওয়ের বোলিং তাণ্ডবে মাত্র ৫২ রানেই গুটিয়ে যায় ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংস। তবে সব ছাপিয়ে সামনে চলে আসে ব্র্যাডম্যানের বিদয়। দলীয় ১১৭ রানে আউট হন সফরকারী ওপেনার সিডনি বার্নস। কানায় কানায় পূর্ণ ওভালের গ্যালারি তখন মুহুর্মুহু করতালিতে মুখরিত। না, এটি বার্নসের আউটের উদযাপন নয়, ড্রেসিং রুমের সিঁড়ি বেয়ে শেষবারের মতো মাঠে নামছেন ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যান। মাঠে ঢুকেতেই একযোগে স্লোগান তুলে এ মহারথীকে সম্মান জানান প্রতিপক্ষের ফিল্ডাররা। ব্যাট দিয়ে ঠুকিয়ে পিচ ঠিক করে প্রস্তুত হলেন ব্র্যাডম্যান। ইংলিশ লেগস্পিনার এরিক হোলিসের প্রথম বলেটা ব্যাকফুটে গিয়ে ডিফেন্স করলেন। দ্বিতীয় বলটি খেললেন ফ্রন্টফুটে গিয়ে। তবে হোলিসের গুগলিটি ব্যাট এবং প্যাডের ফাঁক খুঁজে নিলো। পেছনে ফিরে নিজের বেল পড়া উইকেটগুলো দেখলেন ব্র্যাডম্যান। ওভালে তখন নাটকীয় নিস্তব্ধতা। প্রতিপক্ষের সেরা ব্যাটসম্যানকে আউট করেও স্বাগতিক ফিল্ডারদের মধ্যে নেই কোন উল্লাস। স্বভাবসুলভ দ্রুতপদে মাঠ ছাড়লেন ‘সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার’।
শেষ হলো ক্রিকেটের একটি অধ্যায়ের। রেখে গেল মাত্র ৪ রানের আফসোস। সুযোগটা অবশ্য তখনো ছিল। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার ৩৮৯ রানের বিপক্ষে ইংলিশদের ইনিংস ব্যবধানে হারটা দ্বিতীয়বারের মতো ব্যাটে নামার সুযোগটাও দিল না ব্র্যাডম্যানকে। অথচ শেষ টেস্টে নামার আগে আগে ব্র্যাডম্যানের ব্যাটিং গড় ছিল ১০১.৩৯। মাত্র চারটি রান করতে পারলেই তার গড় দাঁড়াত ১০০। কিন্তু তা আর হলো কই? ৯৯.৯৪ গড়ে শেষ হলো কিংবদন্তির ক্যারিয়ার। অথচ এই ওভালেই তার সর্বশেষ ইনিংসগুলো ছিল ২৩২, ২৪৪ এবং ৭৭।
১৯২৮ সালে অভিষেকের পর ৫৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে ৯৯৬৪ রান করেন। এখানেও মাত্র ৪ রানের জন্য ৮ হাজারি ক্লাবে ঢুকতে পারলেন না। টেস্টে তাঁর সর্বোচ্চ ইনিংস ৩৩৪। নার্ভাস নাইনটিজ বিষয়টি ব্র্যাডম্যানের ডিকশনারিতেই নেই। টেস্টে ৪২ বার ৫০ পেরিয়ে ২৯ বারই করেছেন সেঞ্চুরি। তাই অর্ধশতক মাত্র ১৩টি। নব্বইয়ের ঘরে আউট হননি কখনো। টেস্টে সর্বোচ্চ ১২টি ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ডটি ব্র্যাডম্যানের। ব্যাটিং গড়ের মতো এটিও কেউ ভাঙতে পারবেন কি না সন্দেহ আছে। এ তালিকায় তাঁর নিচে থাকা ব্রায়ান লারা অবসরে গেছেন ৯টি ডাবল সেঞ্চুরি নিয়ে। সর্বকালের সেরা এ ব্যাটসম্যান লেগ স্পিনে দুটি উইকেটও নিয়েছেন। প্রথম শ্রেণিতে ২৩৪ ম্যাচে ৯৫.১৪ গড়ে করেছেন ২৮ হাজার ৬৭ রান। সর্বোচ্চ ৪৫২*। ৬৯ অর্ধশতকের পাশাপাশি করেছেন ১১৭টি শতক।
ডন ব্র্যাডম্যানই ইতিহাসে প্রথম ব্যাটসম্যান, যিনি একক কোনো দেশের বিরুদ্ধে কমপক্ষে পাঁচ হাজার রান করেছেন। এক সিরিজে সবচেয়ে বেশি ডাবল সেঞ্চুরি করার রেকর্ডটিও তাঁর। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এক সিরিজে তিনটি ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। এ ছাড়া ক্রিকেট ইতিহাসে এক সিরিজে সর্বোচ্চ রানের মালিকও এই অসি ক্রিকেটার। ৯৭৪ রান। ১৯৩০ সালে অ্যাশেজের সাত ইনিংসে এই রান করেন ব্র্যাডম্যান। শেষ ম্যাচের নাটকীয়তা একরাশ আফসোসের জন্ম দিলেও এতটুকু টলেনি তাঁর অর্জনের পর্বত। এমন আফসোস কিংবদন্তিদের ক্যারিয়ারের সৌন্দর্য বরং বাড়িয়েই দেয়।