১৬ ঘণ্টার ব্যাটিং কাব্য
১৯৫৮ সালের ২৩ জানুয়ারি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্রিজটাউনে চলছে পাকিস্তান-ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম টেস্ট। ব্যাট হাতে ক্রিজে আছেন হানিফ মোহাম্মদ। স্টেডিয়ামের পাশেই গাছে ওঠে খেলা দেখছে একটি ছেলে। দীর্ঘ সময় খেলা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে চোখ লেগে এলো তার, গাছের ডালেই যেন ঘুমিয়ে পড়ল ছেলেটি। এরপর ঘটে গেল একটি দুর্ঘটনা। অচেতন অবস্থায় গাছ থেকে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল সে। দ্রুত নেওয়া হলো হাসপাতালে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর জ্ঞান ফিরল ছেলেটির। আর প্রথমেই তার প্রশ্ন, ‘হানিফ মোহাম্মদ কি এখনো ব্যাট করছেন?'
হ্যাঁ, গল্পটা কাল্পনিক হলেও ইতিহাসটা কিন্তু সত্য।১৯৫৭-৫৮ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হানিফ মোহাম্মদের ঐতিহাসিক টানা ১৬ ঘণ্টার সেই ইনিংসটি আজও অমর হয়ে আছে ক্রিকেট ইতিহাসের পাতায়। টসে জিতে ব্যাট হাতে মাঠে নামে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। স্যার এভার্টন উইকস ও স্যার কনরাড হান্টের সেঞ্চুরিতে ৫৭৯ রানের পাহাড় সমান সংগ্রহ তাদের। জবাবে ব্যাট হাতে পুরোপুরি ব্যর্থ পাকিস্তান। ১০৬ রানেই অল আউট। টেস্টের তৃতীয় দিন বিকেলে ৪৭৩ রানে পিছিয়ে থেকে ফলোঅনে পড়া পাকিস্তান দলের হাল ধরেন হানিফ মোহাম্মদ। টানা ১৬ ঘণ্টা ক্রিজে থেকে ৩৩৭ রানের গড়লেন এক অনবদ্য ইতিহাস আর ড্র হলো ব্রিজটাউন টেস্ট। যদিও তার ঠিক এক মাস পরই ক্যারিবীয় কিংবদন্তি গ্যারি সোবার্সের ব্যাট থেকে আসে ৩৬৫ রানের ইনিংস। তবে সময়ের হিসাবে কিন্তু হানিফের ইনিংসটি এখনো টেস্ট ইতিহাসের দীর্ঘতম ইনিংস।
হানিফ মোহাম্মদের জন্ম ১৯৩৪ সালের ২১ ডিসেম্বর ভারতের জুনগরে। ভারত বিভাগের পর তাদের স্থায়ী ঠিকানা হয় করাচিতে। ক্রীড়া পরিবারের সন্তান হানিফের ভাই মুশতাক, সাদিক ও ওয়াজির খেলেছেন পাকিস্তান দলের হয়ে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হানিফ মোহাম্মাদের অভিষেক ঘটে ১৬ অক্টোবর ১৯৫২ সালে ভারতের বিপক্ষে। পাকিস্তান দলের পক্ষে তিনি টেস্ট খেলেছেন ৫৫টি । ১৯৫২-১৯৬৯ সালের ক্রিকেট জীবনে ৪৩.৯৮ গড়ে তিনি মোট রান করেন ৩৯১৫। যার মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৩৭ রানের ইনিংসসহ শতক আছে ১২টি আর অর্ধ শতক আছে ১৫টি।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও ব্যাট হাতে উজ্জ্বল ছিলেন এই ব্যাটিং তারকা। ৫২.৩২ গড়ে ১৭০৫৯ রানের মালিক তিনি। সঙ্গে আছে ৫৫টি শতক আর ৬৬টি অর্ধ শতক। এ ছাড়া, হানিফ প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ভেঙেছেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। তবে দুর্ভাগ্য যে, ৫০০তম রানটি নিতে গিয়ে রানআউট হয়ে যান তিনি। থেমে যেতে হয় তাঁকে ৪৯৯ রানেই। ৩৫ বছর এটিই ছিল প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান। পরে ১৯৯৪ সালে ব্রায়ান লারা ছাড়িয়ে যান তাঁকে।
বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে এই ব্যটিং তারকা পেয়েছেন নানা খ্যাতি। ১৯৬৮ সালে হানিফ উইজডেন ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার মনোনীত হন হানিফ মোহাম্মদ। এ ছাড়া ২০০৯ সালের আইসিসি ক্রিকেট হল অব ফেমে স্থান পান তিনি।
তবে শেষ জীবনে ফুসফুসের ক্যানসার ও শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যায় আক্রান্ত পড়েন এই ব্যাটিং হিরো। তিন বছর অসুস্থ থাকার পর ২০১৬ সালের ১১ আগস্ট করাচির একটি হাসপাতালে পৃথিবীকে বিদায় জানান সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যান।