মাকে মনে পড়ে॥
মাগো! বড় সাধ হয় তোমাকে পাই আরো একবার।
কেমন করে আছো আমাকে ফেলে একা?
তবে কি তুমি সেই জনয়িত্রী নও আর?
যে আমাদের শঙ্খচিলের ছোবল থেকে
আঁচল দিয়ে ডানা বানিয়ে আগলে রাখত প্রতিক্ষণ!
শৈশবের বন্ধু মানিক ডাকাত যখন গলায় বাহারি রুমাল আর
ট্যালকম পাউডার মেখে ঘুরে বেড়াত পাড়াময়
আমি অভিসম্পাত করতাম আমার মাকে,
স্কুলের বন্ধুরা ডাংগুলি খেলার ফাঁকে রগরগে যৌনালাপে মত্ত,
খ্যাপাটে আমি উন্মত্ত,
“দূর হও তুমি, আমার স্বাধীনতা হরণকারী”!
“কী হবে এত লেখাপড়া শিখে?
শাসনের বেড়ি হাতে-পায়ে দিয়ে কেনো রেখেছ আটকে”?
বুলেট ছিল না বলে গুলি করিনি স্বৈরাচারী মাকে,
কথার বুলিতে জখম করেছি শত।
দুবেলা দুমুঠো ভাত দিতেই হিমশিম আমার অকর্মন্য় জননী।
সারা দিনের দুরন্তপনার ক্লান্তি,
রাতের আঁধারের সাথে ক্ষুধার তাড়না,
দেহে আনে অবসাদ, তবুও চিৎকার করে বলি,
“ভাত দে মা, নইলে মানিক ডাকাত হবো”।
পুঁটি মাছ দিয়ে বেগুনের চচ্চড়ি ধোয়া ওঠা ভাত গপাগপ গিলি,
শূন্য থালা সামনে নিয়ে দুরুদুরু বুকে তাকিয়ে থাকেন জননী,
যদি আরো ভাত চায় ওরা?
শূন্য উদর পূর্ণ করেন পুরো একগ্লাস পানিতে।
স্বার্থপর মোরা তোমার সন্তান, ভ্রূক্ষেপ নেই তোমাতে॥
এমনি করেই চিলের থাবায় বিদীর্ণ হয়েছে পিঠ,
সন্তানদের ঠোকরে হৃৎপিণ্ডে হয়েছে রক্তজবার ক্ষত,
দিনের আলিঙ্গনে বারে বারে হেরে যাও
তবুও তীব্র অসহায়ত্বের সাথে যুদ্ধ কোরে,
উত্তাল বিক্ষুব্ধ জলধি পাড়ি দিয়ে
ভাঙ্গা তরণী সামনে ঠেলে, নিশ্চিন্তপুরের শান্ত দ্বীপে,
পৌঁছে দিয়েছো মোদের, অকুতোভয় নাবিক হয়ে।
নিশুতি রাত ঘুমন্ত সবায়, পায়চারী করি বাড়ির আঙিনায়,
স্মৃতির ভেলার মেঘগুলি আজ ভেসে বেড়ায় চোখের কার্নিশে।
সুদুর গগনের অযুত তারার ভিড়ে, তৃষিত চোখ খুঁজে ফেরে,
আমার জন্মদার, আমার সৃষ্টিকর্তা, বিশ্বপতিকে।
“পারো না তুমি একটিবার, শুধু একবার ফিরিয়ে দিতে তাকে?
হে মহাশক্তির গর্বকারী! তাহলে কেন এত ক্ষমতার বড়াই”?
যদি ফিরে পাই চুমোয় চুমোয় তুলে নেবো,
আমার সমস্ত অভিসম্পাতের কালো দাগ,
জননীর গায়ের গন্ধে ভরে নেবো বুক,
চোখের পানিতে ধুঁয়ে দেবো রক্তজবার ক্ষত
একটি কথাই বলবো তারে, বারে বারে, হাজার বার,
“মাগো বড় ভালোবাসি তোমায়”।
বুকের জমাট কষ্টগুলো আছড়ে পড়ে বাগানে,
লকলকিয়ে বেড়ে ওঠা মটরশাঁকের চারাগুলি জেগে যায়
ফিসফিসিয়ে কী বলে তারা? কী কথা কয়? নাকি বলে,
“শাঁক পিঠালি দিয়ে আগুন গরম চিতই পিঠা খাওনা আর”?
আমি বলি “কেমন করে খাবো? মা যে মরে গেছে”!
শতকোটি আলোকবর্ষ দূরের, অনন্ত নক্ষত্র বীথির ওপার হতে,
কোমল একটি ছায়ামূর্তি হেঁটে আসে কাছে।
ব্যথিত হদয়ের সজল মানবী, অশ্রু টলমল চোখে,
মৃদু হেসে কয়,“পাগল ছেলে! এত কষ্ট কেনো পাস, বাপ”?
“মায়েরা কি কখনো মরে? মায়েরা শুধু চলে যায় কালের আঁধারে।
অমর হয়ে আসে ফিরে, বারে বারে, সন্তানের বুকের পাঁজরে”!