উন্নয়ন আছে, তবুও কী যেন নেই
দেশে উন্নয়ন ঘটছে। কেউ কেউ বলেন, উন্নয়নের জোয়ার এসেছে। কথাটা মিথ্যা নয়। অন্তত বিভিন্ন দিকে তাকালে স্বীকার করতেই হয় যে, দেশে উন্নয়ন ঘটছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের নানা ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে পদ্মা সেতু। বিভিন্ন মহাসড়কে ফোর লেনের কাজ এগিয়ে চলেছে দ্রুত। আর যানজট এড়াতে ঢাকা মহানগরসহ বিভিন্ন এলাকায় চলছে বাইপাস সড়ক, ফ্লাইওভার, ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞ। এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দেখে যে কেউ বলবেন, দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় যে, উন্নয়নের এ জোয়ার ঠেকানোটাও দিন দিন অসাধ্য হয়ে উঠছে, কারণ এসব নির্মাণকাজ করতে গিয়ে এরই মধ্যে যে ‘লজিস্টিক সাপোর্টে’র ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে, তা নির্মাণকাজে এনে দিচ্ছে গতি।
আগে হাজারো শ্রমিক অল্প অল্প মাটি নিয়ে যে বাঁধ তিন মাস ধরে নির্মাণ করত, তা এখন গুটি কয়েক খনন যন্ত্র, কয়েকটি ট্রাক দিয়ে অল্প কয়েক দিনেই নির্মাণ করা যাচ্ছে। ফ্লাইওভার নির্মাণে কপিকল লাগিয়ে যে বিম ওপরে টেনে তুলতে শত শত শ্রমিক হিমশিম খেত, তা এখন ক্রেন দিয়ে টেনে তোলা হচ্ছে খুব সহজেই। এই যে ‘লজিস্টিক সাপোর্টের’ ভাণ্ডার, তা কিন্তু ঠিকাদাররা একবার ব্যবহার করেই ফেলে দিচ্ছে না, তা পুনরায় কাজে লাগাচ্ছে। কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে সরকারকে দিয়ে। এভাবে হিসাব করলে দেখা যায়, উন্নয়নের যে জোয়ার এসেছে, তা রুখে দেওয়ার সাধ্য ষড়যন্ত্রকারীদেরও নেই।
তবে এই যে উন্নয়ন, তা জনগণকে স্বাচ্ছন্দ্য দেয়। এ কারণেই জনগণ উন্নয়নকে স্বাগত জানায়। দেশের আরো উন্নতি হোক, তা চায়। যেমন ধরুন, ঢাকা শহরে যানজট থাকবে না, এমন স্বপ্ন দেখেই শহরবাসী ফ্লাইওভার নির্মাণকে স্বাগত জানাচ্ছে, নির্মাণকালে ধকল সহ্য করছে। ফ্লাইওভার নির্মাণ করে যানজট নিরসনের কৌশলটা হচ্ছে, দূরপাল্লার যানবাহনগুলো ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে দ্রুত চলে যাবে, আর কাছের যানবাহন নিচ দিয়ে কাছেই অলিগলিতে ঢুকে পড়বে। এভাবে দুই সড়কে ভাগ হয়ে যানবাহন চলাচল করলে একটি সড়কের ওপর চাপ কমবে, কেটে যাবে যানজট।
কিন্তু দেখা যায়, দূরপাল্লার বাসগুলো সাধারণত ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে যেতে চায় না, কারণ সেখানে তাদের চাহিদা অনুযায়ী যাত্রী তোলার সুযোগ নেই। তারা নিচ দিয়ে বাস চালাতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে অতিরিক্ত আয়ের আশায় যাত্রী তোলার সুবিধার্থে। ফলে ফ্লাইওভার ফাঁকাই থাকছে বেশির ভাগ সময়। এতে দেখা যাচ্ছে যে, ফ্লাইওভার নির্মাণের আসল উদ্দেশ্যই কিন্তু ব্যাহত হচ্ছে। এতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ফ্লাইওভার নির্মাণেই উন্নয়ন ঘটবে না, ঘটবে তখনই যখন এর ব্যবহার নিশ্চিত করা যাবে।
এ জন্য ট্রাফিক আইনেই সংস্কারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিভাগকেও ঢেলে সাজাতে হবে, বাস মালিক সমিতি এবং শ্রমিক ইউনিয়নকেও সচেতন করে অথবা আইন মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে, তবেই ফ্লাইওভার নির্মাণের সুফল নগরবাসী দেশবাসী পাবে। না হলে এ উন্নয়ন অপচয়ের নামান্তর হতে বাধ্য।
উন্নয়নে ফ্লাইওভার যেহেতু উদাহরণ হিসেবে এসেছে, তা হলে এ সংশ্নিষ্ট পরিবহন ব্যবসা নিয়েই এ আলোচনা চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে। স্বাধীনতাযুদ্ধের পর এ দেশের প্রধান প্রধান হাইওয়ের পাকা সড়ক ছিল মাত্র ১২ ফুট চওড়া। ১৮ ফুট চওড়ার সড়ক খুব কমই দেখা যেত। এখন সড়কব্যবস্থার প্রভূত উন্নয়ন ঘটেছে। একই সঙ্গে ফুলেফেঁপে উঠেছে পরিবহন ব্যবসাও। মুক্তিযুদ্ধের পর যে মালিক একটি বেবিট্যাক্সি বা মুড়ির টিন মার্কা বাস নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল, তারাই এখন শত বাস বা ট্রাকের মালিক। তাঁদের ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠলেও ব্যবসা পরিচালনায় তাঁরা দক্ষতার পরিচয় দিতে না পারায় ব্যবসা পরিচালন ব্যবস্থা রয়ে গেছে সেই মান্ধাতার আমলের। পরিবহন সেক্টরে নিয়মিত বা দক্ষ শ্রমিক সৃষ্টি করতে পারেননি তাঁরা। এখানে প্রায় সব শ্রমিকই নিয়োগ দেওয়া হয় অস্থায়ী ভিত্তিতে, যাঁদের কোনো নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না। দেশে প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের সুবিধা দেওয়া হয় না। শ্রমিকদের চাকরি নির্ভর করে মালিকদের মেজাজ-মর্জির ওপর। এ কারণে শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তায় ভোগেন, নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে নেন নানা কূটকৌশলের আশ্রয়। তাই তো শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত মালিকদের সঙ্গে ‘সাপলুডু’ খেলায় মেতে থাকেন। এবং একসময় শ্রমিক নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ব্যবসায়ীরা দিন বা সপ্তাহ ভিত্তিতে বাসটি ভাড়া দিতে বাধ্য হন শ্রমিকদের কাছে। শ্রমিকরা ওই পরিবহন ভাড়া নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মালিকের ভাড়া এবং নিজেদের মুনাফার অর্থ তুলে নেওয়ায় জন্য নিজেদের নিয়োজিত করেন। যত্রতত্র বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী তুলতে আইন ভাঙেন, রাস্তায় জ্যাম লাগান; অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেন যাত্রীর কাছে থেকে, যা নির্যাতনের শামিল।
এই রাস্তাঘাট, লাক্সারিয়াস বাস—এই যে উন্নয়ন; অনুযায়ী কিন্তু। যাত্রীদের সুবিধা, আরাম-আয়েশ কিন্তু বাড়েনি। আনন্দদায়ক হয়ে ওঠেনি সাধারণ মানুষের যাতায়াত। তাই তো পরিবহন খাতকে এখনো কেউ সেবা খাত বলে মনে করেন না।
বিভিন্ন খাতকে গড়ে তোলার দায়িত্ব সরকারের। সরকার যদি এসব কোম্পানিকে আইন অনুযায়ী ব্যবসা পরিচালনায় বাধ্য করতে পারত, তাহলে শ্রমিকরা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হতো না, হয়ে উঠত দক্ষ শ্রমিক। তেমনি মালিকরাও আইন মেনে দক্ষ মালিক হয়ে উঠত, আজ শ্রমিক বা শ্রমিক নেতাদের কাছে যানবাহন ভাড়া দিয়ে মালিকানা হাতছাড়া হওয়ার দিকে যেত না। উন্নয়নের সুফল পেত সবাই। তবেই উন্নয়ন হবে সঠিক উন্নয়ন।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা