আওয়ামী লীগের সম্মেলন
একজন ওবায়দুল কাদের
আওয়ামী লীগ যে জনগণের দল, সর্বোপরি রাজনৈতিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র, তা আবারও ২২-২৩ অক্টোবরের ২০ জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে আরো একবার প্রমাণিত হলো। প্রতিবছরের জাতীয় কাউন্সিলের ন্যায় এবারও পূর্বঘোষিত অনেক চমক লক্ষ করা গেছে। কারণ, অন্যান্য সময়ের মতো এবারও কথা উঠেছিল—শেখ হাসিনাই হচ্ছেন সভাপতি এবং সৈয়দ আশরাফুল ইসলামই হচ্ছেন তৃতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক। শেখ হাসিনা সভাপতি হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু চমক এসেছে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের নির্বাচিত হওয়ায়। আর ওবায়দুল কাদের এবারে সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় আওয়ামী লীগের যে ছয় হাজার ৫৭০ জন কাউন্সিলর, তাঁরা তো খুশি হয়েছেনই, সেইসঙ্গে সারা দেশের রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক আওয়ামী পরিবারের লক্ষ-কোটি মানুষ খুশি হয়েছেন। খুশি হয়েছেন অন্য রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষও।
কারণ, বাংলাদেশের মানুষ এখন অনেক রাজনীতিসচেতন। কাজেই সবাই চান, রাজনীতি যেন থাকে রাজনীতিবিদদের কাছেই। ওবায়দুল কাদের পুরোদস্তুর আগাগোড়া একজন ফুলটাইম রাজনীতিক। রাজনীতি ছাড়া তাঁর আর কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। ওবায়দুল কাদের তাঁর ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বড় রাজপুর গ্রামে ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষক বাবা মোশাররফ হোসেন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী ও সহযোদ্ধা ছিলেন। তাঁর মা ফজিলাতুন্নেছা সুগৃহিণী এবং স্ত্রী ইসরাতুন্নেছা একজন আইনজীবী। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিজ এলাকা থেকেই। তিনি বসুরহাট হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি এবং নোয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন, সেই রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় তিনি এখনো সক্রিয় রয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে ’৬৬-এর ছয় দফা ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। তিনি সব সময়ই তরুণ প্রজন্মের একজন হিরোয়িক নেতা ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি কোম্পানীগঞ্জ থানার মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনার পর তিনি আড়াই বছর কারাবন্দি ছিলেন। তারপর ছাত্রলীগে তাঁর পূর্ব অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে কারাগারে রেখেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সে সভাপতির দায়িত্বও তিনি পরপর দুই মেয়াদ পালন করেন। তার পর থেকে তিনি আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ ও নিবেদিত কর্মী হিসেবে কাজ করেন আওয়ামী লীগদলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে। ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদে তিনি নোয়াখালী-৫ আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়ে তৎকালীন সরকারের যুব, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তিনি তাঁর সফল দায়িত্বকাল শেষ করেন। তখনো তিনি হয়ে ওঠেন যুবসমাজের পছন্দের পাত্র এবং মধ্যমণি। তিনি ২০০০-০২ মেয়াদে আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক এবং ২০০২-০৯ মেয়াদে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
এর পর ২০০৭ সালে তৎকালীন কথিত সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে ৯ মার্চ ২০০৭ তারিখে গ্রেপ্তার হয়ে ১৭ মাস ২৬ দিন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ থাকেন। তারপর তিনি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউর সেই ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় অন্যদের সঙ্গে মারাত্মকভাবে আহত হন। ২০০৯ সালে তিনি আওয়ামী লীগের দলীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরাম, অর্থাৎ সভাপতিমণ্ডলীর মেম্বার নির্বাচিত হন।
২০০৯ সালে নবম জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে দলকে সুসংগঠিত করার জন্য তিনি প্রথম দিকে মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব না নিয়ে কিছু সময়ে দলকে গুছিয়ে ২০১১ সালের ৫ ডিসেম্বর যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এর পর তিনি ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদে তৃতীয়বারের মতো সাংসদ হয়ে অন্তর্বর্তীকালীন এবং পরবর্তী নতুন সরকারে ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি আবারও দ্বিতীয়বারের মতো যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবেই তাঁর দায়িত্ব বহাল থকে। তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন পূর্বেকার যোগাযোগ মন্ত্রণালয়টিই এখন পরিবর্তিত হিসেবে ‘সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয়’ হিসেবে পরিচিত। তিনি একসময় জনপ্রিয় দৈনিক বাংলার বাণীতে সহকারী সম্পাদক হিসেবে সাংবাদিকতার পাশাপাশি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত থেকে নয়টি বই বের করেছেন। তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর সম্মেলন প্যান্ডেলজুড়ে মুহুর্মুহু ধ্বনিতে উদ্ভাসিত হয়েছে সম্মেলনস্থল।
অভিনন্দনের ঝড় উঠেছে ভার্চুয়াল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে। এর একটিই কারণ, তিনি এখন তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন নেতা। সভাপতি শেখ হাসিনা নিজেও সম্মেলনের ঘোষণামঞ্চে এ কথা উল্লেখ করেছেন। কাজেই তাঁর নেতৃত্বে সত্যিকারের তৃণমূলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মূল্যায়ন পাবেন। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কোথাও কোনো ব্যর্থতার কথা শোনা যায়নি। তিনি সরকারের মন্ত্রিসভায় অন্যতম সফল একজন মন্ত্রী।
দেশের বর্তমান ও আগামীর স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণে রয়েছে তাঁর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ। দেশের সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে, সেখানে শৃঙ্খলা সৃষ্টিতে তিনি অত্যন্ত সততা ও দক্ষতার সঙ্গে প্রতিটি কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করে চলেছেন। তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ায় এরই মধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বন্ধুপ্রতিম অনেক রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে তাঁকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। তিনি অভিনন্দন পাচ্ছেন বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রের রাজনীতিকদের কাছ থেকেও। এর আগে সদ্য-সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ ইতোপূর্বে শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে যাঁরা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন—আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, জিল্লুর রহমান, আবদুল জলিল প্রমুখ সবাই ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত থাকলেও একেবারে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতিদের মধ্যে তিনিই প্রথম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলেন।
তাঁর সঙ্গে সভাপতি শেখ হাসিনাসহ সভাপতিমণ্ডলীতে নতুন যে সাতজন এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নতুন আরেকজন, কোষাধ্যক্ষ—এসব পদে যাঁদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে, তাঁদের সবাইকে নিয়ে আগামী দিনে দল ও দেশের জন্য কাজ করবেন তিনি—এ বিশ্বাস সবার আছে। কাজেই বর্তমানে দেশের উন্নয়নধারাকে সমুন্নত রেখে সামনের মিশন ও ভিশনগুলো অর্জন করাই এখন সামনের বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওবায়দুল কাদের বর্তমান নবনিযুক্ত কমিটিকে নিয়ে সামনের দিকেই এগিয়ে গিয়ে উন্নয়ন ও গণতন্ত্র সমুন্নত রাখবেন। আমরা তাঁর সাফল্য কামনা করি। জয়তু শেখ হাসিনা, জয়তু ওবায়দুল কাদের।
(কলামে ব্যবহৃত তথ্যগুলো সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত)
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।