বিশ্ব পর্যটন দিবস
সম্ভাবনা ছড়িয়ে পড়ুক সবদিকে
আপনার ফেসবুকের বন্ধু-তালিকায় কেউ একজন সিলেটের রাতারগুল কিংবা বিছনাকান্দির ছবি আপলোড করল। ছবি দেখে আপনি এবং আপনার পরিচিত আরো কয়েক বন্ধু মিলে সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন। ঘুরেও এলেন। আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর ইন্টারনেটের কল্যাণে এভাবেই ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন স্থানের স্থিরচিত্র কিংবা ভিডিও। বর্তমানে পর্যটন সম্প্রসারণের অন্যতম একটি উপায় এটি। বাংলাদেশে পর্যটনের প্রচুর সম্ভাবনা থাকার পরও অবস্থা পরিপ্রেক্ষিতে এর বিশেষ কোনো উন্নতি লক্ষ করা যায় না। সাম্প্রতিককালে বেসরকারিভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি সরকারি মনোভাবের পরিবর্তন শুরু হওয়ায় একটু একটু করে এগোচ্ছে পর্যটন খাত। তবে এর প্রায় সবকিছুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সারাবিশ্বে আমাদের পর্যটন সম্প্রসারণের তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ে না।
আমাদের পাশে থাকা নেপাল, ভুটান ও ভারতের জাতীয় আয়ের একটা সিংহভাগ অংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। নেপালের অর্থনীতি কার্যত পর্যটননির্ভর। তা ছাড়া ভারতের অর্থনীতিতে পর্যটনের প্রভাব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মালদ্বীপের মতো ছোট রাষ্ট্রও আমাদের থেকে পর্যটনশিল্পে অনেক এগিয়ে। সেখানে একই অঞ্চলে থাকার পরও আমরা কেন পর্যটনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে পারছি না? এমন তো নয় যে আমাদের দেশে পর্যটনের স্পট নেই। বাংলাদেশের ইতিহাস ও সৌন্দর্য পর্যটনের জন্য যথেষ্ট সম্ভাবনার, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশে পরিচিত-অপরিচিত অনেক আকর্ষণীয় স্থান আছে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে যুগে যুগে ভ্রমণকারীরা মুগ্ধ হয়েছেন। এর মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ঐতিহাসিক মসজিদ এবং মিনার, পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকত, পাহাড়, অরণ্য ইত্যাদি অন্যতম। এ দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের শুধু একবার মুগ্ধ করে না বারবার টেনে আনে।
নতুন করে কৌশল নির্ধারণ করে সম্ভাবনার সবটুকু কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে পর্যটনে মডেল হতে পারে। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ স্বল্প আয়তনের দেশ হলেও বিদ্যমান পর্যটক আকর্ষণে যে বৈচিত্র্য, তা সহজেই পর্যটকদের আকর্ষণ করতে সক্ষম। পৃথিবীতে পর্যটনশিল্প আজ অন্যতম বৃহত্তম শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। পর্যটনশিল্পের বিকাশের ওপর বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন অনেকখানি নির্ভর করছে। দেশে পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটলে কর্মসংস্থান ঘটবে এবং বেকারত্ব দূরীকরণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন সফল হবে আমাদের দেশ। দেশের প্রাচীন যুগের ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রথার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ঐতিহাসিক স্থান দেখার জন্যও বিদেশি পর্যটকরা নিজ দেশের সীমানা পেরিয়ে দূর-দূরান্তে ছুটে চলে। পর্যটন একটি বহুমাত্রিক শ্রমঘন শিল্প। এই শিল্পের বহুমাত্রিকতার কারণে বিভিন্ন পর্যায়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্ভাবনা তৈরি হয়। ফলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারি অনুদান ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে যথাযথ সমন্বয় সাধন করার পাশাপাশি উন্নত অবকাঠামো, সঠিক পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার পর্যটনের জন্য।
পর্যটনশিল্পের উপাদান ও ক্ষেত্রগুলো দেশে-বিদেশে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে পর্যটনশিল্পের অধিকতর বিকাশ ঘটানো যে সম্ভব, সম্প্রতি সরকারিভাবেও এটা উপলব্ধিতে এসেছে। সরকার ২০১০ সালে যে পর্যটন নীতিমালা করেছে, সেখানে বহুমাত্রিক পর্যটনের কথা বলা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বহুমাত্রিক পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা রয়েছে কক্সবাজারে। বহুমাত্রিক পর্যটনে সাংস্কৃতিক, ইকো, স্পোর্টস, কমিউনিটি ও ভিলেজ ট্যুরিজম থাকবে। এর আওতায় দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরতে হবে। তাহলেই বহুমাত্রিক পর্যটনের ধারণা সফল হবে। এই ধারণার ভিত্তিতে কক্সবাজারের পর্যটনশিল্প বিকশিত করতে হলে সামাজিক ও রাজনৈতিক কমিটমেন্ট থাকতে হবে। সুন্দরবন হতে পারে পর্যটনের আরেক সম্ভাবনার নাম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে উন্নতি করছে।
পর্যটনশিল্প একটি শৌখিন শিল্প। আন্তরিকতা ছাড়া এ শিল্পে উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের দেশে গ্রামভিত্তিক পর্যটন ব্যবস্থার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ পর্যটনের সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে হবে। এখানে যত বেশি পর্যটক থাকবে, তত বেশি আয় হবে। এ ক্ষেত্রে মাত্র দেশি পর্যটনের ওপর নির্ভর করলে প্রকৃত সাফল্য আসবে না। আবার দেশি পর্যটকের ওপর নজর সরিয়ে নিলেও হবে না। দেশে পর্যটনবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে দেশি পর্যটকদের কাছে পর্যটনের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। তাহলে বিদেশিরা আমাদের দেশে ভ্রমণে আগ্রহী হবে, যা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক প্রভাব রাখতে সম্ভব। বিশ্বায়নের এ যুগে সম্ভাবনার সবটুকু কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ হতে পারে পর্যটনশিল্পের বিস্তৃত এক জনপদ। এ জন্য সরকারের আন্তরিকতার পাশাপাশি বেসরকারি বিনোয়োগ উৎসাহী করতে হবে। সম্ভব হলে প্রয়োজনীয়তা সাপেক্ষে বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহ দেওয়া যেতে পারে কি না, সেটা ভাবারও সময় এসেছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের দেশি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। মোটকথা, একটি পরিকল্পিত উদ্যোগ আর সঠিক কর্মযজ্ঞ এ দেশের পর্যটনশিল্প বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ইন্টারনেটভিত্তিক পর্যটনের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠছে, সেটা কাজে লাগানো যেতে পারে।
লেখক : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।