বিশ্ব পরিবেশ দিবস
নিরাপদে থাকুক বন্য প্রাণীরা
পরিবেশের একটি ব্যাপক পরিধি রয়েছে, অর্থাৎ বস্তুত আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়েই পরিবেশ। কাজেই দেখা যাচ্ছে, আমাদের চারপাশে আছে গৃহ-পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, দুর্যোগ-দুর্বিপাক, রাজনৈতিক পরিবেশ, অর্থনৈতিক পরিবেশ, সামাজিক পরিবেশ, আকাশ-পাতাল, ঘটন-অঘটন, বায়ু, জল-স্থল, পাখপাখালি, বন-জঙ্গল, মানুষ, পশু, গাছপালা, দিগ্বিদিক, আলো-আঁধার, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, দেশ-বিদেশ, জাতীয়-আন্তর্জাতিক, কলকারখানা, যানবাহন, রাস্তাঘাট, কৃষি, শিল্প, আহার-ভোজন, লেখাপড়া, জ্ঞানবিজ্ঞান, অনুসন্ধান-গবেষণা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ইত্যাদি সবই পরিবেশেরই উপাদান। কোনো কিছুই পরিবেশের বাইরে নেই। সে হিসেবে প্রতিদিনই আসলে পরিবেশ দিবস হলে ভালো হতো। কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়, তাই রেওয়াজ অনুযায়ী বছরে মাত্র একটি দিন তা পালন করা হয়ে থাকে। প্রতিবছরের মতো এবারো ৫ জুন পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্ব পরিবেশ দিবস।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ১৯৭২ সালে ‘ইউনাইটেড ন্যাশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনইপি)’ গঠন করা হয়। তারই প্রস্তাবমতে ১৯৭৪ সাল থেকে ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। সময়ের হিসাবে এবারে পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের ৪২তম বার্ষিকী। যেকোনো একটি বিশেষ দিবসকে একটি বিশেষ দিনে পালন করলেই দায়দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। তার পরও এভাবে যদি সারা বিশ্বের মানুষ গুরুত্বসহকারে একটি দিবস একদিনে পালন করে, তবে তার গুরুত্বই আলাদা। একসময় পরিবেশকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হতো না। পরিবেশের কথা বলা হলেই বলা হতো সেটা আবার কী! কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এখন দিন পাল্টেছে। সময়ের বিচারে এটি এখন শুধু নির্দিষ্ট কোনো একটি দেশের একক বিষয় না হয়ে বরং সর্বজনীন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছরই পরিবেশ দিবসের একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। এবারের থিম হলো ‘ফাইট অ্যাগেইনস্ট দি ইলিগ্যাল ট্রেড ইন ওয়াইল্ডলাইফ’, অর্থাৎ ‘বন্য প্রাণীর অবৈধ বাণিজ্যের বিরুদ্ধে লড়ো’। তা ছাড়া এ বছর অ্যাঙ্গোলাকে হোস্ট কান্ট্রি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
২০১৩ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনকালে ‘অভয় কে’ নামের একজন ভারতীয় কবি ও কূটনীতিক ‘আর্থ এনথেম’ হিসেবে একটি পরিবেশ সংগীতের প্রচলন করেন, যা জাতিসংঘের ছয়টি দাপ্তরিক ভাষা আরবি, চায়নিজ, ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান ও স্প্যানিশ ছাড়াও হিন্দি ও নেপালি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এবারের থিমটি একটি যুগোপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বিবেচনায় রেখে করা হয়েছে, যা খুবই যুক্তিযুক্ত হয়েছে। কারণ, পরিবেশসচেতন সবারই একটি বিষয় জানা যে, পরিবেশের অন্য অনেক উপাদানের সঙ্গে গাছপালা অন্যতম। আদর্শ পরিবেশের জন্য একটি ভূখণ্ডের মোট আয়তনের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ গাছপালা, অর্থাৎ সবুজ বনানী থাকতে হয়। আর এসব গাছপালার মূল উৎস হলো বনাঞ্চল। বনাঞ্চলের জন্য আবার জীববৈচিত্র্য বলতে একটি কথা আছে। সে জীববৈচিত্র্যের অন্যতম উপাদান হলো বন্য প্রাণী। এখানে প্রতিটি জীব একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
আমরা এখন কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্কের কল্যাণে ‘অ্যানিমেল প্লানেট’, ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফি’, ‘ডিসকভারি’ ইত্যাদি টিভি চ্যানেলে চোখ রাখলেই সেগুলো সহজেই দেখতে পাই। অনেকে মনে করে থাকেন, উল্লেখিত চ্যানেলগুলো শুধু বাচ্চাদের বিনোদনের জন্য। আসলে মোটেও তা নয়। কিন্তু সেখানে মূলত পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য ইত্যাদি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশ্যেই এগুলো দেখানো হয়ে থাকে। সেখানে একটু দৃষ্টি দিয়ে দেখলে সহজেই দেখা যাবে, বনের মধ্যে বন্য প্রাণীগুলো একটি আরেকটির ওপর কতভাবে আন্তনির্ভরশীল। দেখা যাচ্ছে, একে অন্যের সঙ্গে মারামারি করছে, এমনকি একটি অপরটিকে খেয়ে পর্যন্ত ফেলছে। এগুলোই তো জীববৈচিত্র্য। কথায় আছে, ‘বন্যরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। অর্থাৎ যে যেখানে থাকার কথা তাকে আসলে সেখানেই ভালো মানায়। তারা ফুড চেইন কিংবা খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল, যারা বনকে তাদের জীবিকা হিসেবে নিয়ে একদিকে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করছে, অন্যদিকে বন্য প্রাণীদের তাদের শিকারে পরিণত করছে। সেভাবেই বন্য প্রাণীরা হয়ে পড়ছে অনৈতিক ও অন্যায় ব্যবসা-বাণিজ্যের পণ্যে।
আমরা যদি পৃথিবীর অন্যতম জীববৈচিত্র্যের বেলাভূমি, অনলাইন ভোটিংয়ে নতুন সপ্তাশ্চর্যের একটি এবং বিশ্বের সবচেয়ে ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে পরিচিত আমাদের বাংলাদেশের সুন্দরবনের কথা ধরি, তাহলেই বিষয়টি আরো পরিষ্কার করা যাবে। সুন্দরবনের প্রধানতম ঐতিহ্য হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, চিতাবাঘ, বিভিন্ন ধরনের পাখি, সাপ, গুইসাপ, ব্যাঙ, কচ্ছপ, সুন্দরী, গেওয়া, কেওড়া গাছ, মৌচাক, বিভিন্ন দেশি প্রজাতির সুস্বাদু মাছ ইত্যাদি। তার মধ্যে সবই আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। অনেক বন্য প্রাণী কালের আবর্তনে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অনেক বিলুপ্তির পথে রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি কমছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও হরিণ। একসময় হাজার হাজার বাঘ ছিল, যা এখন মাত্র ২০০ থেকে ৩০০-তে এসে ঠেকেছে। শিকারিরা অনায়াসে বনে ঢুকে শিকার করছে এবং পাচার করছে এসব অমূল্য সম্পদ হিসেবে পরিচিত বন্য প্রাণী, এর চামড়া, হাড়, মাংসসহ আরো বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ইত্যাদি। কথিত আছে, এসব স্থানে যোগসাজশ রয়েছে স্থানীয় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের। শোনা যায় রক্ষকই নাকি ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় মাঝেমধ্যে। কিছু কিছু প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, যেগুলো একবার হারালে আর কখনো ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। বন্য প্রাণী এগুলোর মধ্যে অন্যতম। কাজেই ধরিত্রীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বন্য প্রাণীকে অনৈতিক ও অবৈধ শিকারের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সেগুলো বন্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আফ্রিকা মহাদেশের একটি দেশ হলো অ্যাঙ্গোলা। সেটি মূলত একসময় বনজঙ্গলে আবৃত ছিল। সেই সঙ্গে ছিল প্রচুর বন্য প্রাণীও। কিন্তু কালের সংকটে পড়ে এখন সেসব বনভূমি ও বন্য প্রাণী উভয়ই হুমকির মুখে। সে জন্য ২০১৬ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের হোস্ট কান্ট্রি হিসেবে অ্যাঙ্গোলাকে নির্বাচন করা হয়েছে। কাজেই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ২০১৬ সালের প্রতিপাদ্য এবং থিম ও হোস্ট কান্ট্রি নির্বাচন একেবারেই সময়োপযোগী হয়েছে।
এখন আসা যাক, পরিবেশের সর্বজনীন কিছু বিষয় আলোচনার জন্য। আগেই বলেছি, একসময় পরিবেশ বিষয়টিকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হতো না। নব্বইয়ের দশকের আগে পরিবেশ বিষয়টি কখনো কারো বিবেচনাতেই আনা যায়নি। তারপর যখন দেখা গেল যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে পরিবেশবিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা হতে লাগল, তখন ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরোতে ‘আর্থ সামিট’ নামে একটি সম্মেলন হয়। সেখানেই সর্বপ্রথম প্রতিকূল পরিবেশের বিভিন্ন বিষয় সচিত্র আকারে তুলে ধারার কারণে বিশ্বের নীতিনির্ধারকদের টনক কিছুটা নড়তে শুরু করে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ বিষয়টি যে অগুরুত্বপূর্ণ কিংবা ফেলনা কোনো বিষয় নয়, তা অনুধাবন করতে থাকে সবাই। সেটি অনুধাবনের অংশ হিসেবে ১৯৯৫ সাল থেকে জাতিসংঘের পরিবেশ কার্যক্রমের ব্যবস্থাপনায় শুরু হয় কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ (সিওপি-কপ)। সেই ১৯৯৫ সাল থেকে ২০১৫ অবধি প্রতিবছর জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ পর্যন্ত ২১টি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে পরিবেশ বিষয়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সে সম্মেলনে বর্তমান বিশ্বের যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, ভারত, বাংলাদেশসহ ১৯৫টি দেশ অংশগ্রহণ করেছিল।
মজার ব্যাপার হলো, ১৯৯৫ সাল থেকে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো অভিযোগ করে আসছিল যে, দ্রুত শিল্পায়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার, সর্বস্তরে আধুনিকায়ন ও নগরায়ণের ফলে এর কুফল হিসেবেই জল-স্থল-অন্তরীক্ষ দূষিত হয়ে একদিকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে মারাত্মক পরিবেশ দূষণের শিকার হয়ে ক্রমেই পরিবর্তিত হয়ে পড়ছে জলবায়ু ও পরিবেশ। আর সে জন্য যে উন্নত ও শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলোই দায়ী, তা কোনো অবস্থাতেই তারা মানতে চাইছিল না এত দিন। কিন্তু এখন এর ক্ষতিকর প্রভাবে পড়ে তারাই আবার কমবেশি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে দেখে, এখন তা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। আর সে রকমই একটি সুখবর রয়েছে ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত কপ-২১ সম্মেলনে। সেখানে ১৯৫টি দেশই একমত হয়ে দীর্ঘদিনে আলোচনায় থাকা কার্বন নিঃসরণ কমানোর মাধ্যমে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য একটি আইনগত বাধ্যবাধকতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। সে সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির ধকল সামাল দেওয়ার জন্য অত্যধিক ক্ষতিগ্রস্ত ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর জন্য ১০০ বিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল গঠনের বিষয়ে সকলে একমত পোষণ করেন।
এরই মধ্যে পূর্বনির্ধারিত সময়সীমা অনুযায়ী ২০১৬ সালের ২২ এপ্রিলের মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দেশ চুক্তিটিতে স্বাক্ষরের মাধ্যমে তাদের সায় দিয়েছে। কাজেই নিঃসন্দেহে বিষয়টি ২০১৬ সালে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের ক্ষেত্রে একটি ভিন্ন নতুন মাত্রা যোগ করেছে। একসময় যে বিষয়টিকে কখনো আমলেই নেওয়া হতো না, এখন তা বিশ্বের নেতৃবৃন্দের নেকনজরে রয়েছে। এটাই আসলে বিশ্ব পরিবশে দিবস পালনের স্বার্থকতা ও সফলতা। কারণ, ১৯৭৪ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী তা নিয়মিতভাবে পালনের জন্যই এ বিষয়ে সবার মধ্যে এক ধরনের সচেতনতাবোধ সূষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পেরেছে। আর বাংলাদেশ এ বিষয়ে সব সময়ই অগ্রগামী। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়সহ সরকারি-বেসরকারি অনেক পরিবেশকর্মী, সংস্থা ও বিশেষজ্ঞরা আগে থেকেই দিবসটির তাৎপর্য ও গুরুত্ব তুলে ধরে অনেক কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। সে সঙ্গে গণমাধ্যমও এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করে থাকে। এবারও তার কোনো ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
আমরা বিশ্ব পরিবেশ দিবসের সাফল্য কামনা করি। আর প্রতিজ্ঞা করি যেন, একটি গাছ কেটে সেখানে ১০টি গাছ লাগিয়ে বিশ্বকে সবুজ-শ্যামল করে তুলি। বন্ধ করি নির্বিচারে বন্য প্রাণী নিধন। সেখানেই নিরাপদে থাকবে আমাদের বন্য প্রাণীরা। আর তারা ভালো থাকলেই ভালো থাকব আমরা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। আসলে মানুষের জন্যই তো সব।
লেখক : কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।