ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেসের দাবিতে আর কত কী?
২০১৫ সালের এপ্রিল মাসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের অন্য জেলাগুলোয় মাথাপিছু আয় যেখানে গড়ে এক হাজার ১৯০ ডলার, সেখানে কুড়িগ্রামে তা ৮২৮ ডলার! দারিদ্র্যের হার অন্য জেলায় ৩০ দশমিক ৭ ভাগ, কুড়িগ্রামে ৬৩ দশমিক ৭! কম ওজনের শিশু জন্মগ্রহণের হার অন্যদের ১৭ দশমিক ৭, কুড়িগ্রামের ৩৮ দশমিক ৭ ভাগ। বার্ষিক মাছ গ্রহণের মাথাপিছু হার অন্যদের গড়ে ১২ কেজি আর কুড়িগ্রামে ৭ দশমিক ৫ কেজি। স্বাক্ষরতার হারও একই রকম—৬৫ ভাগ বনাম ৩৬ দশমিক ৯৯ ভাগ।
এ ছাড়া অন্য জেলাগুলোর প্রবাসী শ্রমিক (২০০৪-২০১৪) ৭৮ হাজার ৭১১ জন, কুড়িগ্রামের নয় হাজার ২৪৩ জন। বাংলাদেশ ব্যাংকে নোয়াখালী জেলার সঞ্চয় যেখানে ১৪ হাজার কোটি টাকা, সেখানে কুড়িগ্রাম জেলার সঞ্চয় সর্বনিম্ন চার হাজার কোটি টাকা।
কেন এই বিপরীত অবস্থা? উত্তর দিচ্ছে রাষ্ট্রীয়-অরাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থাই। তারা বলছে, বড় ও মাঝারি শিল্প (২০০০-২০০১ সালে) যেখানে অন্যান্য জেলায় গড়ে ছিল ৩৮৭টি, কুড়িগ্রামে তা মাত্র ১০টি। ২০১৫ সাল পর্যন্ত পোশাক কারখানা অন্যদের গড়ে ৮৬টি আর কুড়িগ্রামে একটি। পাটকল যথাক্রমে ২ দশমিক ১টি ও একটি (তাও বন্ধ); মেডিকেল কলেজ + প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় + বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় + বিশ্ববিদ্যালয় যথাক্রমে ১ দশমিক ৫টি ও শূন্যটি।
অথচ একসময় এ জেলায় জাহাজ তৈরির কারখানাসহ কয়েকটি নৌবন্দর ছিল, লালমনিরহাট-ভূরুঙ্গামারী রেলপথ ছিল, নব্বই দশক পর্যন্ত চিলমারী-বাহাদুরাবাদ, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত কার্গো ও ফেরি চলাচল করত আর রমনা রুটে চলত চারটি ট্রেন। আর এখন কুড়িগ্রাম জেলা এক পরিত্যক্ত জনপদ।
২.
জেলাওয়ারি পরিসংখ্যানে কুড়িগ্রাম জেলা সর্বাধিক নদ-নদী ভাঙনকবলিত জেলা হওয়ায় এখান থেকেই সর্বোচ্চ সংখ্যক শ্রমিক কাজের সন্ধানে দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়ান। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় ১১৫টি দূরপাল্লার বাস চলাচল করে। গরু-ছাগলের মতো অমানবিক ব্যবস্থায় যাতায়াত করে বলে এই জেলাবাসীকে 'মফিজ' বলা হয়। এতগুলো বাসের চলাচল প্রমাণ করে, ঢাকা টু চিলমারী রুটে অনায়াসে দুটি আন্তনগর ট্রেন চলাচল করতে পারে। উপরন্তু চিলমারী নদীবন্দর ও সোনাহাট স্থলবন্দরকে যুক্ত করার ব্যাপার তো আছেই।
গণকমিটির নেতৃবৃন্দ বলছেন, রেললাইন আন্তনগর ট্রেনের উপযোগী না হওয়া পর্যন্ত শাটল ট্রেনের ব্যবস্থা করা যায়, যাতে ঢাকাগামী যাত্রীরা চিলমারী, উলিপুর, পাঁচপীর, কুড়িগ্রাম ও রাজারহাটে আন্তনগরের টিকেট কেটে শাটল ট্রেনে উঠতে পারেন। আর স্বপ্নের আন্তনগর ট্রেনটির নাম তাঁরা দিয়েছেন 'ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেস'।
রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, কুড়িগ্রাম জেলা কয়েক বছর ধরে লাখ লাখ লিফলেট বিতরণ, রেলমন্ত্রীকে দুই লাখ গণস্বাক্ষর জমা, প্রতি মাসে স্মারকলিপি প্রদান, প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যদের শত শত চিচি প্রেরণ, জেলার আনাচে-কানাচে পথসভা, মানববন্ধন, মোটরযাত্রা, 'বন্দরনগরী কুড়িগ্রাম জেলায় মঙ্গা কেন' শিরোনামের হাজার হাজার ক্যালেন্ডার প্রকাশ ইত্যাদির মাধ্যমে ভাওয়াইয়া এক্সপ্রেসের দাবিকে জনগণ ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে। গত বছর ১৫ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী কুড়িগ্রামের জনসভায় প্রতিশ্রুতিও দিয়ে গেছেন। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি।
সংগঠনটির পক্ষ থেকে গত ২৮ এপ্রিল জেলা সদরে সংবাদ সম্মেলনে ৩০ এপ্রিল রেলপথ অবরোধ ঘোষণা করেছে। প্রতিটি চাওয়াই কি রক্ত দিয়েই আদায় করতে হবে!
লেখক : প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।