নিরাপত্তা
বিদেশি নাগরিক হত্যার দায় কার?
বাংলাদেশে এক বিদেশি নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে তুমুল তর্ক-বিতর্ক। গত সোমবার ঢাকার নিরাপদ এলাকা বলে পরিচিত গুলশানে কূটনীতিক পাড়ায় তাবেলা সিজার নামে এক ইতালীয় নাগরিককে গুলি করে হত্যা করা হয়। তারপর এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে শুরু হয় নানা গুঞ্জন। এ হত্যাকাণ্ডের আগে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচনা হতে দেখা যায়। আর এই আলোচনার মধ্যেই নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে গত সপ্তাহে ঢাকা সফর পিছিয়ে দেয় অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল। তার মধ্যে ঘটে গেল বিদেশি নাগরিক হত্যার মতো স্পর্শকতার ঘটনা। সব কিছুই কেমন যেন হঠাৎই ঘটে গেল। এই হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত নাকি এর পেছনে ভূ-রাজনৈতিক কোনো প্রভাব আছে তা সরকারকেই এখন স্পষ্ট করতে হবে।
কারণ এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তি জড়িত। কাজেই যেকোনো মূল্যেই হোক হত্যাকারীদের ধরতে হবে। যে স্থানে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে সেটি ‘ডিপ্লোমেটিক জোন’ (কূটনীতিক অঞ্চল) হিসেবে পরিচিতি। সবসময় সেখানে বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়া হয়। তারপরও সংরক্ষিত এলাকায় কী করে এ ধরনের একটি দুঃসাহসিক ও ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো সেটি অবশ্যই গভীর উদ্বেগের বিষয়। সরকার তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এর দায় এড়াতে পারে না। এ ঘটনায় বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে চরম আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। যুক্তরাজ্য তাদের নাগরিকদের চলাচলে সতর্কতা জারি করেছে। কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের বিষয়েও, যা আমাদের জন্য মোটেই সম্মানের বিষয় নয়।
সম্প্রতি কয়েক বছরে দেশে গুম-হত্যার পরিমাণ ভয়াবহ আকারে বেড়ে গেছে। এই হত্যাকাণ্ড শুধু বিদেশি নাগরিক বলে কথা নয়, বাংলাদেশের যেকোনো পরিবারের মধ্যেও এটা ঘটতে পারে। ফলে এই বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ক্রমেই দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের অক্ষমতা ও ব্যর্থতাই দায়ী। একটি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য আসলে সরকারকেই দায় নিতে হয়। যে সরকার ‘ডিপ্লোমেটিক জোনে’ বিদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না, সে সরকারকেই এই হত্যাকাণ্ডের দায় নিতে হবে। যদি পরিকল্পিত ভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকে, তাহলে বাংলাদেশ কি সন্ত্রাসবাদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠছে? নাকি এমন পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে? এসব প্রশ্নের উত্তর সরকারকেই দিতে হবে।
অস্ট্রেলিয়া যে নিরাপত্তা আশঙ্কা কথা বলছে, তা দূর করার পাশাপাশি ইতালীয় নাগরিকের হত্যার যথাযথ তদন্ত ও অপরাধীদের বিচার হতে হবে। একই সঙ্গে সরকারকে বিদেশিসহ সব নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
গত কয়েকদিনের এসব ঘটনা বাংলাদেশের জন্য বড় রকমের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে জঙ্গিদের তৎপরতা আছে কি না, থাকলে কোন পর্যায়ে রয়েছে- বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া কঠিন। যদিও স্বরাষ্টমন্ত্রী বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) কোনো কার্যক্রম নেই বলে দাবি করেছেন। কিন্তু তারপরও সরকারের প্রচারণার কারণে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এত বেশি জঙ্গি থাকার রব উঠেছে যে, এখন জঙ্গি ঝুঁকি কতটা বাস্তব তা দেশের মানুষ বুঝতে পারছে না। এমতাবস্থায় দেশের মানুষ ও বিদেশি কূটনীতিকদের মধ্যে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে, তা দূর করতে সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। না নিলে বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থার অবনতির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের ওপর জঙ্গি হামলা পরিকল্পনার নির্ভরযোগ্য তথ্য থাকলে তা অবশ্যই উদ্বেগের বিষয়। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তবে গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গি হুমকি বা এ সংক্রান্ত নিরাপত্তাঝুঁকির কোনো তথ্য-উপাত্ত দেখা যায়নি। এ জন্য মানুষের মধ্যে উদ্বেগ আরো বেড়ে গেছে। হঠাৎ কেন ‘জঙ্গি আলামত’ বেড়ে গেল এবং একজন বিদেশি নাগরিককে কী কারণে হত্যা করা হলো, তার উত্তর এ মুহূর্তে জানা খুবই প্রয়োজন।
এসব বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত করতে হবে। এই ধরনের চাঞ্চল্যকর হত্যাকারীদের ধরতে পুলিশের ব্যর্থতার কোনো সুযোগ নেই। হত্যার বিষয়টিকে কোনো ভাবেই অগ্রাহ্য না করে দ্রুত সময়ে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। কারণ এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি জড়িত। এ জন্য হত্যাকাণ্ডের কারণ খতিয়ে দেখা দরকার। একই সঙ্গে হত্যাকারী যারাই হোক, তাদের অবিলম্বে শনাক্ত করে দৃষ্টন্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : সভাপতি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (জাবিসাস)।