প্রতিক্রিয়া
মুহম্মদ জাফর ইকবাল, এক বাতিঘরের নাম
মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণার স্লোগান ‘জয় বাংলা’, এটি ব্যবহার করেই শিক্ষকদের ওপর হামলা চালিয়েছে শাবিপ্রবি ছাত্রলীগ। বিষয়টি শুনে বিমর্ষ হয়ে পড়েন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য জাফর ইকবাল যখনই সরকার সমর্থিত কোনো অংশের সমালোচনা করেছেন, ঠিক তখনই দেখা গেছে একটি পক্ষ এই বিষয়টিকে লুফে নিয়েছে। এবারের ঘটনায় এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। লজ্জাজনক হলেও সত্য, স্যারকে ব্যঙ্গ করে ফেসবুকে একটি ইভেন্টও খোলা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো স্যার কাদের কাছে অপছন্দের পাত্র? অবশ্যই স্যার যাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন, সে ক্ষেত্রে প্রথমেই আসবে জামায়াত-শিবির এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম এবং ঘটনার পরে ওই পক্ষই বিষয়টা নিয়ে কৌশলে ব্যাপাক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি আরো একটি গ্রুপ আছে যারা সব সময়ই পরশ্রীকাতর। পাশাপাশি লজ্জাজনক হলেও সত্য শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করতে চাওয়া একদল মানুষও আছে এর মধ্যে, ভুলে গেলে চলবে না অভিন্ন প্রশ্নপদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা চালু করতে চাওয়ার কারণে স্যারকে নিন্দার তীরে বিদ্ধ হতে হয়েছিল।
যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ না দেখা প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটা এই ভদ্রলোক চালিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর, সেহেতু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাঁর মাধ্যমে ওই স্বাধীনতাবিরোধীরাই। মজার ব্যাপার হলো একদল আবার মনে করেন স্যার কেবল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়েই পড়ে আছেন, তাঁদের ভাষ্যমতে এসব চেতনার কোনো দাম নেই, আরো খারাপভাবে বললে ভাত নেই। মূল বিষয়টা হলো, এহেন প্রজাতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে কেবল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি আর জামায়াত-নিষিদ্ধকে বুঝে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে ন্যায়বিচার, শিক্ষালাভের অধিকার (৭.৫% ভ্যাট ছাড়া, শিক্ষা শেষে চাকরি লাভের অধিকার, মৌলিক অধিকার, দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ অর্থাৎ যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন। আরো স্পষ্টভাবে বললে ৭২-এর সংবিধানের পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
সুতরাং স্যার যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে কথা বলেন, তখন আমার কাছে মনে হয় এই বিষয়গুলো নিয়েই কথা বলেন। মজার বিষয় হলো, গতকালের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ঘটনা দেখে স্যারের লেখা সেই বিখ্যাত বই ‘মহব্বত আলীর একদিন’-এর কথা মনে পড়ে গেল। যেখানে স্যার দেখিয়েছিলেন দুর্নীতিবাজ ভিসির উত্থান, আত্মসম্মানবোধহীন ওই ভিসির কার্যক্রম। ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে সব শিক্ষার্থীর গর্জে ওঠা, তার লাঠিয়াল বাহিনী মানে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন কর্তৃক আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, এবং ছাত্র-শিক্ষক সম্মিলিত আন্দোলনে ভিসির পতন। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের শিক্ষক পেটানোর ঘটনা নতুন নয়, কতিপয় সমালোচক বলেন, স্যার তখন কেন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। স্যার ওই একটি বই দিয়েই ক্যাম্পাসে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া নোংরা রাজনীতির বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান প্রকাশ করেছিলেন বহু আগেই। যদিও তথাকথিত ওই সব সমালোচক জাফর ইকবাল স্যারকে না পড়েই গলাবাজি করতে এসেছে।
শেষ কথা, প্রতিটি সমাজেই একটি বাতিঘর থাকে, যে আলো দেখায় প্রজন্মকে, সঠিক দিকে পরিচালনার জন্য। জাফর ইকবাল স্যার হচ্ছেন সেই বাতিঘর, আমার মতো অগণিত তরুণ, কিশোর-কিশোরীর মধ্যে সবচেয়ে পরম শ্রদ্ধেয় ও অনুকরণীয় মানুষ হচ্ছেন তিনি। একটি বাতিঘর থেকে কিন্তু হাজার, লক্ষকোটি বাতিবাহক বের হয়, যারা অন্ধকারের পূজারি তাদের জন্য ওই বাতিঘর এবং বাতিবাহকরা হয় বিপজ্জনক। সুতরাং বাতিঘর ভাঙার চেষ্টা করবেন না, তাহলে নিজেরাই বাতিঘরের আগুনে পুড়ে ছাই হবেন।
লেখক : শিক্ষার্থী, সরকারি বি এম কলেজ, বরিশাল।