আন্তর্জাতিক
সংকটে মালদ্বীপ
ছোট্ট দ্বীপদেশ মালদ্বীপে রাজনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে ঘনীভূত হচ্ছে। দেশটির রাষ্ট্রপতি আবদুল্লাহ ইয়ামিন গতকাল সোমবার মালদ্বীপে ১৫ দিনের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। আজ আবার দুজন বিচারককে গ্রেপ্তার করা হয়। দেশটির সেনাবাহিনী এবং পুলিশ উচ্চ আদালত ঘিরে রেখেছে। সেখানকার আইনপ্রণেতাদের দাবি তাঁরা উচ্চ আদালতে খাদ্যহীন অবস্থায় বন্দি রয়েছেন। সরকার ও বিচারবিভাগ একদম মুখোমুখি পর্যায়ে অবস্থান করছে। যা দেশটির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে চরম বিপন্নতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এমনিতেই দেশটিতে ২০১৩ সালের পর থেকে এক ধরনের পরোক্ষ একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান। বিরোধীদের অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
বর্তমান সংকট চরম মাত্রা পায় গত সপ্তাহে। ওই সময় দেশটির সুপ্রিম কোর্ট সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে কারাবন্দি বিরোধীদলীয় নয়জন নেতাকে মুক্তির আদেশ দেন। এঁদের মধ্যে বিদেশে স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকা দেশটির সাবেক রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ নাশিদও রয়েছেন। এ ছাড়া বহিষ্কার করা ইয়ামিনের দলের ১২ জন আইনপ্রণেতাকে স্বপদে ফিরিয়ে আনার আদেশও দেন আদালত। এই ১২ জন আইনপ্রণেতার ওপর থেকে বহিষ্কারাদেশ ফিরিয়ে নেওয়া হলে ৮৫ সদস্যের আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবে সরকারি দল। কিন্তু ইয়ামিনের সরকার এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করলে শুরু হয় রাজনৈতিক সংকট।
দক্ষিণ এশিয়ার এই ছোট্ট দ্বীপদেশটিতে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা খুব বেশি একটা হয়নি। মালদ্বীপ ১৯৬৫ সালে দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত রাজতন্ত্রের অধীনে ছিল দেশটি। তখন দেশটির রাষ্ট্রপতি হন ইব্রাহিম নাসির। এরপর ১৯৭৭ সাল থেকে একটানা রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন একনায়ক মামুন আব্দুল গাইয়ুম। তিনবার বড় ধরনের সেনা অভ্যুত্থান থেকে তাঁকে রক্ষা করার নেপথ্যে ছিল এই অঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র ভারত। বিশেষ করে ১৯৮৮ সালে তাঁকে রক্ষা করার জন্য সরাসরি ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী দেশটিতে এক ধরনের আগ্রাসন চালায়। তাঁর ক্ষমতার অবসান ঘটে ২০০৮ সালে। ঐ বছরই প্রথম সংবিধান গৃহীত হয় এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি হন মোহাম্মদ নাশিদ। তিনি ২০১৩ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। ওই বছরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নাশিদ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও তাঁকে অযোগ্য ঘোষণা করেন সুপ্রিম কোর্ট। সন্ত্রাসবাদে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাঁকে দেশছাড়া হতে হয়। রাষ্ট্রপতিত্ব পান সাবেক স্বৈরশাসক মামুন আব্দুল গাইয়ুমের সৎভ্রাতা আবদুল্লাহ ইয়ামিন।
বর্তমানে মালদ্বীপের বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকারের দ্বন্দ্বে সবচেয়ে লাভবান হচ্ছে বিরোধীরা। এমনিতেই তারা নানা ধরনের দমনপীড়নের মধ্যে অবস্থান করছে। শুধু নাশিদের মালদ্বীপিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির(এমডিপি) নেতা কর্মীরাই নন, এমনকি ইয়ামিনের সৎভ্রাতা মামুন আবদুল গাইয়ুম কিংবা দেশটির ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কাশিম ইব্রাহিমসহ সবাই রাষ্ট্রপতির রোষানলে রয়েছেন। গাইয়ুমের বাসস্থান অনেক দিন ধরেই পুলিশ দ্বারা ঘেরাও। তাঁর পুত্রসন্তান এবং জামাতা জেলে রয়েছেন। অবশ্য গাইয়ুম এবং ইব্রাহিম কেউই আগামী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বয়সজনিত কারণে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। অনেক বিরোধী নেতা শ্রীলঙ্কায় পালিয়ে গেছেন। শ্রীলঙ্কা অবশ্য মালদ্বীপের অনেক নাগরিকের কাছে দ্বিতীয় মাতৃভূমি। বিশেষ করে অভিজাত শ্রেণির কাছে। তাদের অনেকের সন্তান শ্রীলঙ্কার নামিদামি স্কুলে পড়ে এবং অনেকেরই সম্পত্তি রয়েছে সেখানে।
বর্তমান বিশ্বে এক ধরনের ঠান্ডা যুদ্ধের প্রচ্ছন্ন প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। একদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্ব এবং আরেকদিকে চীন রাশিয়া নেতৃত্বাধীন বিশ্ব। বর্তমান মালদ্বীপ সংকটেরও নেপথ্যে এই দ্বন্দ্বের পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। কেননা মালদ্বীপের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই অঞ্চলে চীনের স্বার্থ বনাম ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটি। আর এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে ভারতের বর্তমান বহুজাতিক স্বার্থের তাবেদার উগ্র সাম্প্রদায়িক মোদি সরকার এই অঞ্চলের মার্কিন স্বার্থের ঠিকাদার। ভারতের শাসকশ্রেণি মালদ্বীপের বর্তমান ঘটনায় বিরোধীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তারা দেশটির বর্তমান সরকারকে বিচার বিভাগের নির্দেশের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। তাদের মাথাব্যথার সবচেয়ে বড় কারণ দেশটিতে চীনের উপস্থিতি। চীনের সিল্করুট বাস্তবায়নের জন্য মালদ্বীপকে তার দরকার। এ জন্য সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির সরকারের সঙ্গে চীনের একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। যা ভারতের মাথাব্যথার কারণ। যেজন্য তারা বিরোধীদের প্রচ্ছন্ন মদদ জোগাচ্ছে।
এমনিতেই এই অঞ্চলে ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অনেকদিনের। এজন্য তারা যেকোনো ধরনের হস্তক্ষেপের জন্য প্রস্তুত। মালদ্বীপে মামুন আবদুল গাইয়ুমের সময় তাঁকে রক্ষার জন্য সামরিক হস্তক্ষেপের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা এবং নেপালেও তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের হস্তক্ষেপ করেছে। আর বাংলাদেশে তাদের ভূমিকা নতুনভাবে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। তাই মালদ্বীপের সরকারের চীনমুখী প্রবণতাকে তারা যে সুনজরে দেখছে না তা সহজেই অনুমেয়।
আর এদিকে চীনের রাষ্ট্রপ্রধান যখন চেয়ারম্যান মাও সে তুং ছিলেন তখন দেশটি এই অঞ্চলের কমিউনিস্ট বিপ্লবী তৎপরতাকে সহায়তা করত। কিন্তু দেং জিয়াও পিংয়ের সময় তারা এই নীতি থেকে সরে আসে। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কারণে যে প্রভূত অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল তা থেকে উঠে দাঁড়ানোর জন্য তারা অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের পথ বেছে নেয়। কিন্তু বর্তমানের রাষ্ট্রনায়ক শিং জিনপিংয়ের সময় তারা তাদের বর্ধিত অর্থনৈতিক স্বার্থজনিত কারণে এই অঞ্চলসহ অনেক দেশেরই বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের সংশ্লিষ্ট করছে। তাদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যও এই ভূমিকায় তাদের অনেক জায়গাতে অবতীর্ণ হতে হচ্ছে।
মালদ্বীপের সাবেক রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ নাশিদ অনেকদিন ধরেই দেশছাড়া। তিনি এখন পশ্চিমা শক্তিগুলো এবং ভারতের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু তাঁর জন্য সমস্যার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর পুরোনো মিত্ররা কেউই আর ক্ষমতায় নেই। তাঁর ঘনিষ্ঠ ডেভিড ক্যামেরন আর যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রক্ষমতায় নেই। আর মার্কিন রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছেন উদ্ভট চরিত্রের একজন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান ঘটনায় সরাসরি তাঁর পক্ষাবলম্বন করছে না। তারা জানিয়েছে যে তারা মালদ্বীপের বর্তমান ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছে। অবশ্য তারা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির পক্ষে কথা বলছে।
বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল্লাহ ইয়ামিন আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি আল-জাজিরা একটি দুর্নীতির রেকর্ড প্রকাশ করেছে। আর এদিকে বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় মালদ্বীপের পর্যটন অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যেহেতু এটা ওই দেশের অর্থনীতির প্রধান খাত তাই জনগণ ভোগান্তিতে পড়তে পারে। পাশাপাশি দেশটিতে উগ্র মৌলবাদী মনোভাব তরুণদের মধ্যে ভালো প্রভাব রাখছে বলে জানা গেছে। তাই যেকোনো অস্থিতিশীলতা দেশটির জন্য অশনিসংকেত হয়ে উঠতে পারে। মালদ্বীপের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার কেবল সেই দেশের জনগণের। তাই তাদের কর্তব্য কারো ক্রীড়নক হিসেবে দেশটিকে পরিণত না হওয়ার জন্য তাদের সংগ্রাম প্রস্তুত করা।
লেখক : রাজনৈতিককর্মী