অভিমত
সত্যিকারের নায়ক যাঁরা
কমলাপুর রেলস্টেশনে মর্মান্তিক একটি ঘটনা ঘটেছিল। সেখানে ট্রেনের ইঞ্জিনে দুই পা কাটা পড়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রুবিনা আক্তার (২২) নামের এক ছাত্রীর। সে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে রেললাইনের ওপর দিয়ে হেঁটে পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে যাচ্ছিল। এ সময় একটি ইঞ্জিন ঘোরানো হচ্ছিল। এর নিচেই তখন সে চাপা পড়ে যায়। দরিদ্র এই ছাত্রীটি গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য ওই দিন রেল স্টেশনে গিয়েছিল।
এ সময় অসংখ্য মানুষ মর্মান্তিক দৃশ্যটি দেখেছে। কেউ ছবি তুলেছে। কিন্তু কেউ তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যায়নি। দৃশ্যটি দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারেনি লালন নামের এক কিশোর। ছুটে গিয়ে সে-ই প্রথম উদ্ধার করে রক্তাক্ত মুমূর্ষু ছাত্রী রুবিনাকে। না হলে হয়তো মারাই যেত সে।
পত্রিকার খবরে জানা গেল, উদ্ধারকারী কিশোর লালন আমাদের মতো উচ্চশিক্ষিত কেউ না। কমলাপুর স্টেশনেই জুতা পালিশ করে সে।
আহা লালন। নামের প্রতি সুবিচার করেছ তুমি। বাবা-মা এ জন্যই হয়তো তোমার নাম রেখেছে লালন। মানবতাবাদী সাধক লালন সাঁইয়ের মতোই তোমার চিন্তাভাবনা। তোমার জন্য সাধুবাদ রইল।
এই লেখাটি যখন লিখতে বসেছি, সেই ক্ষণে মনে পড়ছে পুরান ঢাকার দর্জি বিশ্বজিতের কথা। সে যখন রক্তাক্ত অবস্থায় মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছিল, তখনো তাকে উদ্ধারে কেউ যায়নি। দৃশ্যটি দেখে লালনের মতোই মাথা ঠিক থাকতে পারেনি রিপন। এই রিপনও বিখ্যাত কেউ না, উচ্চশিক্ষিত কেউ না। সে ছিল রিকশাচালক। শেষ পর্যন্ত রিপন বিশ্বজিৎকে তাঁর রিকশায় তুলে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। বিশ্বজিৎকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টাটি সে করেছিল। কিন্তু সেখানেই বিশ্বজিৎ মারা যায়।
মনে পড়ছে সেই সুমনের কথা। যে সুমন ছিল পোশাক কারখানার একজন সাধারণ কর্মী। ২০১৫ সালের ৩ আগস্টের এক বিকেল বেলা। বনানী সিগনাল পার হচ্ছিলেন যুবক সুমন। কর্মস্থল থেকে যাচ্ছিলেন দুপুরের খাবার খেতে। একটু দেরিতে। হয়তো বস্তিঘরে ডাল-ভাত-ভর্তা তৈরি করে বসেছিলেন তার স্ত্রী। কিন্তু তার আর দুপুরের খাওয়া হয়নি সেদিন।
সেদিন রেলক্রসিং পার হতে গিয়ে দেখেন একটি শিশু রেল লাইনের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। মুক্ত বাতাসে খেলছে শিশুটি। ওদিকে যমের মতো গতি নিয়ে এগিয়ে আসছে ট্রেন। শিশুটির সে দিকে খেয়াল নেই। সুমনের চোখে পড়ে যায় বিষয়টি। মফস্বল শহর থেকে আসা সুমনের (৩৫) হৃদয়টা এই যান্ত্রিক নগরীর মতো এখনো যন্ত্র হয়ে যায় নি। দৌঁড়ে গিয়ে শিশুটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন তিনি। শিশুটি বেঁচে যায়। তারপরের ঘটনা কী হতে পারে? সুমন বেঁচে যেতে পারতেন। সুমন জীবিত থাকতে পারতেন। বিলম্বে দুপুরের খাবারটা আয়েশ করে খেতে পারতেন।
না সুমন ফিরতে পারেননি। শিশুটিকে বাঁচিয়ে নিজে চলে যান ট্রেনের তলায়। এরপর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে সুমনের জায়গা হয়েছিল। সুমন বনানীর মেডোনা ফ্যাশনের স্টোর লোডার ছিলেন। সেই মেডোনা ফ্যাশন কি সুমনের কথা মনে রেখেছে? আমরা কি মনে রেখেছি? হয়তোবা ময়মনসিংহের নান্দাইলের মানুষজন তাদের প্রতিবেশী এই সুন্দরমনের মানুষটিকে মনে রেখেছে আজও।
মনে পড়ল গত বছর জানুয়ারির আরেকটি ঘটনা। রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডের রেলগেটে সেদিন ঘটেছিল মানবতার বিজয়ের আরেকটি ঘটনাটি। এবারের নায়ক বাদল। রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত ছিলেন দীর্ঘ ২৯ বছর ধরে। পেশার প্রতি আর মানবতার প্রতি ভালোবাসাটা এমনই ছিল যে, শেষ প্রতিদানটা নিজের জীবন দিয়ে গেলেন তিনি।
সেদিন ছিল শুক্রবার। বেলা একটার দিকের ঘটনা। দ্রুতগামী একটি ট্রেন ছুটে আসছিল। ছোট্ট এক শিশুকে সঙ্গে নিয়ে তখনো একজন মা রেললাইন পার হতে পারেননি। রেললাইনের পাশ থেকে এক ব্যক্তি ওই মাকে টান দিয়ে সরিয়ে নিলেও লাইনের ওপর রয়ে গেল শিশুটি। এটা দেখে ছুটে গেলেন কোমলহৃদয়ের বাদল মিয়া (৫৮)। শিশুটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন। কিন্তু তিনি আর সরার সময় পেলেন না। ট্রেনের নিচে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলেন তিনি।
বাদলের বাড়ি ময়মনসিংহে। গফরগাঁও উপজেলার মুখি গ্রামে থাকতেন তিনি। আট সন্তানের এই জনকই ছিলেন সংসারের একমাত্র ভরসা।
এই যে লালন, সুমন, রিপন কিংবা বাদল; এরা কেউই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া উচ্চশিক্ষিত কেউ নন। কিন্তু তাদের কাছ থেকে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছুই। এরাই প্রকৃত নায়ক। মানবতার নায়ক। শিক্ষার মূল লক্ষ্য যদি হয় মানুষ হওয়া, মানবতার কল্যাণ করা; তাহলে এই মানুষগুলোই হতে পারে আমাদের বড় শিক্ষক। শুধু বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বড় বড় ডিগ্রি নিলেই শিক্ষিত হওয়া যায় না। সার্টিফিকেট আর সুশিক্ষা অর্জন দুইয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক।
এই দেশেই রাজনের মতো, রাকিবের মতো শিশুদের নির্দয় নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয়। তখন আমরা হতাশ হই। আবার এই দেশেরই গার্মেন্টস শ্রমিক সুমন, জুতাপালিশওয়ালা লালন কিংবা রিকশাচালক রিপন বা রেল শ্রমিক বাদলদের মানবতার জন্য জীবনবাজি আমাদের আশার আলো দেখায়। তাই হতাশ হলে চলবে না; আলো একেবারেই নিভে যায়নি। চারদিকে খুঁজলে এমন নায়ক অনেককেই পাওয়া যাবে। তারা যদিও সামনে আসে না; নিজেদেরকে প্রকাশ করে না। কিন্তু গণমাধ্যমকেই খুঁজে বের করতে হবে, তাদের উদাহরণগুলো বারবার তুলে ধরতে হবে। তবেই মানুষ আশা পাবে। শুধু নেতিবাচক সংবাদ কিংবা প্রভাবশালীকে তোষামোদি করে পত্রিকার পাতা ভরিয়ে রাখলে সমাজে হতাশা বাড়বে।
ছয়শ কোটির এ বিশ্বে, ষোলো কোটির এ বাংলাদেশে দরকার বেশি করে লালন, সুমন, রিপন কিংবা বাদলদের।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।