অভিমত
ভুঁইফোড়দের জন্যই আইন দরকার
দুটি কৌতুক দিয়ে শুরু করছি লেখাটি। সামাজিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের ডিভোর্স হয়েছিল, খোঁজ নিয়ে জানা গেল যে তাদের সবারই বিয়ে হয়েছিল। সে হিসেবে বলা যায়, ডিভোর্সের মূল কারণ হচ্ছে গিয়ে বিয়ে।
অপর কৌতুকটি একটি রাসায়নিক গবেষণা নিয়ে। সেই রাসায়নিক গবেষণায় দেখা গেছে, ভদকার সঙ্গে পানি মিশিয়ে খেলে কিডনির ক্ষতি হয়। রামের সঙ্গে পানি মিশিয়ে খেলে হয় লিভারের ক্ষতি এবং হুইস্কির সঙ্গে পানি মিশিয়ে খেলে ক্ষতি হয় হার্টের। এ থেকে বলা যায়, এই তিনটি পানীয়ের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পানি কমন একটি পদার্থ। সুতরাং শরীরের এই ক্ষয়ক্ষতির জন্য পানিই দায়ী।
সম্প্রতি দেশে একটি আইন নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এই আইনটির সঙ্গে সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার সংশ্লিষ্টতা আছে। আর এ কারণেই হয়তো এ নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা হচ্ছে। হবেই। যেহেতু সাংবাদিকরাই সব প্রচারযন্ত্রের মূলে আছেন, তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আঘাত লাগলে প্রতিক্রিয়ার প্রতিধ্বনিটা বেশিই হওয়ার কথা। তাই তাঁরা প্রতিক্রিয়া বেশি দেখাচ্ছেন। অনেকে বলছেন, এ আইনের ফলে তথ্য সংগ্রহ বাধাগ্রস্ত হবে। সত্যিই কি তাই?
আচ্ছা বাদই দিলাম সাম্প্রতিক আইনটির কথা। সাংবাদিকদের সব আইনের ঊর্ধ্বে রেখে দিলাম। তারা কি অনুসন্ধানে পাওয়া সব সত্য প্রকাশ করতে পারবেন? সেই সিস্টেম কি এই দেশে আছে? ধরুন, কোনো কোম্পানির বড় কর্তার একটি স্পর্শকাতর কেলেঙ্কারির ভিডিও গোপনে ধারণ করে ফেললেন একজন সাংবাদিক। সেটি তিনি নিয়ে গেলেন তাঁর সম্পাদকের কাছে। সম্পাদক ভিডিও দেখে কিন্তু বলবেন, ‘আরে! তুমি করেছ কী! তোমার কি মাথা খারাপ? এই ভিডিও সম্প্রচার করলে তোমারও চাকরি শ্যাষ, আমারটাও। ওরাই দেয় আমাদের সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন। যাও মিয়া, অন্য কাজে মন দাও।’
হ্যাঁ, অনুসন্ধানী বা মুক্ত সাংবাদিকতার বাধা কিন্তু শুধু আইন না। আরো অনেক কিছু আছে। পানি যেমন শরীরের জন্য ক্ষতিকর না, পানি যদি ক্ষতিকর পানীয়ের সঙ্গে মিশে ক্রিয়া করে, তবেই তা ক্ষতিকর বলে সাব্যস্ত হবে। সাংবাদিক দক্ষ-যোগ্য হলে তিনি যেকোনো পরিস্থিতিতে অনুসন্ধানী বা গবেষণামূলক প্রতিবেদন করতে পারবেন। আইন হয়তো তাঁকে সেই সুযোগটা কম দেবে, কিন্তু পথ বন্ধ করে দেবে; এ কথা পুরোপুরি ঠিক না। তবে তিনি মালিক বা সম্পাদক পক্ষের ঝামেলা এড়িয়ে সেই রিপোর্ট প্রকাশ করতে পারবেন কি না, সেটিও বড় কথা। আইনের কথা নিয়ে হৈচৈ করলে এসব বিষয় নিয়েও হৈচৈ করা দরকার।
অনেকে যেভাবে বলাবলি করছেন যে, এই আইনটির কারণেই সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ হবে; তাদের প্রথম কৌতুকটির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি। ডিভোর্সের কারণ নানা রকম দাম্পত্য কলহ, শুধু বিয়ে করে আইনি পাপ করাই কিন্তু এ জন্য দায়ী না।
অনেকে বলছেন, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিসে ঢুকে ভিডিও ধারণ করতে না পারলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা আর থাকছে না। এই ধারণাও কিন্তু সেকেলে। যদিও মফস্বলের অনেক মানুষই এখনো বিশ্বাস করেন, ক্যামেরা হাতে থাকলেই তিনি সাংবাদিক। এবং এ ঘরানার সাংবাদিকে চারদিক এখন গিজগিজ করে। তাঁদের এমন বাড়বাড়ন্ত যে প্রকৃত সাংবাদিকরা এদের সামনে অসহায়। পৃথিবীর আর কোনো দেশ নেই, যেখানে এত বিপুলসংখ্যক ভুঁইফোড় সম্পাদক-সাংবাদিকের ছড়াছড়ি আছে। এ কারণে লাগামহীন একটা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ভুঁইফোড়দের দাপটে প্রকৃত সাংবাদিকরা অসহায়। এদের কারণে প্রেসক্লাবে দাঁড়ানো যায় না। মাঠে দাঁড়ানো দায়। ঘাটে দাঁড়ানো দায়। এদের নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু একটা তো চাই। নাকি?
এখন সাংবাদিকের বাড়ি হয়েছে, গাড়ি হয়েছে; কিন্তু হারিয়ে গেছে সম্মান। সেই সম্মান পুনরুদ্ধারে কারো না কারো কলম ধরা জরুরি।
এত বিপুলসংখ্যক নানা পেশার মানুষ সাংবাদিকতায় আগ্রহী হয়ে ওঠার কারণে মাঝেমধ্যে মনে হয়, সাংবাদিকতা হয়তো এখন বাংলাদেশে নজিরবিহীন মর্যাদার স্থান লাভ করেছে। রাস্তা থেকে দশটা শিক্ষার্থীকে ধরে এনে ‘ভবিষ্যতে কী হইতে চাও’ বা ‘মাই এইম ইন লাইফ’ শীর্ষক একটি প্রশ্ন করলে, নির্ঘাত নয়জনই এখন সাংবাদিকতার নাম নেবে। এমনকি তারা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বাসনাও জলাঞ্জলি দিতে রাজি হবে।
সাংবাদিকতা এমনই লোভনীয় এক মওকা নিয়ে হাজির হয়েছে এই দেশে। সমাজপতি, শিল্পপতি, ধনপতি, নগরপতি থেকে শুরু করে বাস ড্রাইভার, ট্রাক ড্রাইভার, লঞ্চ ড্রাইভার কেউই সাংবাদিক হওয়ার সুযোগ হারাতে চাচ্ছেন না। এককালে কাকের চেয়ে কবি বেশি ছিল, এখন সেই স্থান দখল করে নিয়েছে মহামান্য সাংবাদিকবৃন্দ। এ কারণে ষোলো কোটি জনসংখ্যার দেশে সাংবাদিকতা পেশার সংগঠনের সংখ্যাও এখন 'আঠারো কোটি' ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
কেন সাংবাদিক হওয়ার এমন বাসনা এদেশীয় সিংহভাগ মানুষের? কী মধু এ পেশায়? সাংবাদিকতার 'স' জানেন না; অথচ সম্পাদক, সাংবাদিক হয়ে বসেছেন তাঁরা। এসব নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হতে পারে। তবে গবেষণা এখন শিকেয় তোলা থাকুক, এদের ঠেকাতে হবে, এদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে আগে।
আইন হচ্ছে ব্যাকরণের মতো। কেউ ত্যাড়াব্যাঁকা চললে তাঁর জন্য আইনি ব্যাকরণ। সঠিকভাবে চললে তাঁর জন্য আর ব্যাকরণ লাগে না। সাংবাদিকরা ঠিক থাকলে কোন আইন এলো আর গেল, কিছু যায় আসে না। সঠিক পথে থাকা সাংবাদিক এসবের পরোয়া করে না। এটি আমার নিজের বিশ্বাস।
আমি আইনমুক্ত বিশ্ব চাই। আমি মনে করি, নিজে ঠিক তো, জগৎ ঠিক। তাহলে আবার আইন কিসের? আইন স্বাধীনতার পরিপন্থী। কিন্তু সবাই তো আর সঠিক মতে চলছে না। যেহেতু চলছে না, আইন হোক আর আদালত হোক; কিছু একটা লাগবেই।
চিরায়ত সত্য হলো : সাংবাদিক বা সাংবাদিকতাকে চাপে রাখতে সরকার নতুন কোনো আইন করে, চিরকালই করবে। আর সে আইন হলে সেটি নিয়ে দরকষাকষি করতে হবে সাংবাদিকদেরই। সব সরকারই চাইবে সাংবাদিকদের চাপে রাখতে কঠোর আইন করতে, এর মধ্যেই সাংবাদিকদের নৈতিকতার সাহস এবং যোগ্যতা-দক্ষতার গুণ দিয়ে সেটি মোকাবিলা করতে হবে। আইনটির যতটা সম্ভব অপপ্রয়োগ ঠেকানোর চেষ্টা করতে হবে। এ নিয়ে মিডিয়ার চোখ-কান খোলা রাখতে হবে।
শেষ করছি লেখা। সবাই যখন সাংবাদিকতার সংকট বা ঝুঁকি নিয়ে কথা বলছেন, আমিও তাঁদের সঙ্গে একমত। কিন্তু এই দেশে সাংবাদিকতা ঝুঁকিপূর্ণ করেছে কারা জানেন? কোনো সরকার, প্রভাবশালী মহল, মস্তান, দুর্নীতিবাজ এরা যতটা না এই ঝুঁকি সৃষ্টির জন্য দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী এই পেশার অসাংবাদিকরা। তারাই এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। এই অসাংবাদিকের সংখ্যা এত বেশি যে একজন প্রকৃত সাংবাদিক খুঁজে বের করতে 'লোম বাছতে কম্বল উজাড়' হবে আপনার। ফলে আইন করেই হোক, অন্য কিছু করেই হোক; এই অপসাংবাদিকতা আর সাংবাদিকদের রুখতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।