আমাদের আসলে কপালটাই খারাপ। কোনো একটা অর্জন যখন আমাদের সেলিব্রেট করার কথা, তখনই সেই অর্জনকে বিসর্জন দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগি আমরা। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনের দাবির মুখে ক্রসফায়ার যখন কমে আসে, তখন আমাদের উৎসব করার কথা। কিন্তু আমরা উৎসব করতে পারি না। যখন ক্রসফায়ার কমে যায়, তখন বেড়ে যায় গুম। এটার একটা সুবিধাও আছে। ক্রসফায়ার করলে মিথ্যা হলেও একটা প্রেস রিলিজ দিতে হয়। গুম করলে খালি তাও লাগে না, স্রেফ অস্বীকার করলেই হয়। ক্রসফায়ার আর গুমের ক্ষেত্রে দুটি অপরাধ করতে হয়। একটি হত্যা, অপরাটি মিথ্যাচার।

বলছিলাম অর্জনের কথা। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল হচ্ছে। এটা নিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাস করার কথা। কারণ, ৫৭ ধারা আমাদের কম ভোগায়নি। অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম, প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ৫৭ ধারা বাতিল হচ্ছে বটে, কিন্তু সেই অর্জনটা আমরা সেলিব্রেট করতে পারছি না।

আমি কিন্তু সব সময় বলে আসছি, সাধারণ মানুষকে ডিজিটাল হয়রানির কবল থেকে রক্ষা করতে ৫৭ ধারার মতো একটা সুরক্ষা আমাদের দরকার। বিশেষ করে নারীরা নানাবিধ হয়রানির কবলে পড়ছেন। কোনো আইনি সুরক্ষা না থাকলে, ভার্চুয়াল জগতে মানুষের হয়রানি, অপরাধ বাড়তেই থাকবে। সমস্যাটা হলো আপনি ছুরি কিনেছেন অপারেশন করবেন বলে। কিন্তু সেই ছুরি যখন ব্যবহৃত হয় ছিনতাইয়ের কাজে, তখন আপনার মূল উদ্দেশ্যটাই ব্যাহত হয়। অপরাধের ঢালাও ধরন আর এর ঢালাও অপব্যবহারে ৫৭ ধারা হয়ে উঠেছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রধান প্রতিপক্ষ। ৫৭ ধারায় বেশিরভাগ মামলা হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। হয়রানির শিকার হয়েছেন নিরপরাধ সংখ্যালঘুরা। ৫৭ ধারা বাতিল হচ্ছে, কিন্তু এই ধারায় দায়ের হওয়া মামলাগুলো কিন্তু চলবে। এ কেমন স্ববিরোধিতা? খারাপ বলে যে ধারা আপনি বাতিল করছেন, সেই ধারার মামলা চলতে পারে কীভাবে?

৫৭ ধারা বাতিল হলেও আমরা আশ্বস্ত হতে পারিনি। কারণ, ৫৭ ধারাকে সুকৌশলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চারটি ধারায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অপরাধের সাজা কমেছে, ধারাগুলো জামিনযোগ্য হয়েছে। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা ৫৭ ধারা বাতিলের সব অর্জনকে বিসর্জনে বদলে দিয়েছে। আমাদের অবস্থা হয়েছে, ‘ভিক্ষা চাই না, কুত্তা সামলাও’র মতো। হয়রানির আগের সব অস্ত্র তো থাকছেই, সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আরো ধারালো অস্ত্র। সরকারের মন্ত্রীরা বারবার বলছেন বটে, এ ধারায় সাংবাদিকদের শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের শঙ্কিত হতে বাধ্য করেছে। সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপি-নেতারা মুখে যাই বলুন, তাঁদের প্রধান ভয় সাংবাদিকদেরই। তাই ৫৭ ধারার মতো ৩২ ধারারও মূল টার্গেট হবেন সাংবাদিকরাই। ৩২ ধারা প্রয়োগ হলে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় তারা যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন, সাংবাদিকদের সেখানে কোনো কাজ থাকবে না। তাদের খালি প্রেস রিলিজের ওপর নির্ভর করতে হবে। এমনিতে যে বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ব্যাপক বিকাশ হয়েছে, তা নয়। কিন্তু ৩২ ধারার মাধ্যমে সেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার গলা টিপে হত্যার সব আয়োজন সম্পন্ন হলো। দেশ যখন ডিজিটাল হচ্ছে, আমাদের ভাবনা তখন আরো অ্যানালগ হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যদি ৩২ ধারা থাকত, তাহলে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি ফাঁস হতো না; বরং সেই সাংবাদিককে ১৪ বছর ১৪ শিকের ভেতরে থাকতে হতো।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে কিন্তু শুধু সাংবাদিকদের মতপ্রকাশের অবাধ অধিকার নয়। মতপ্রকাশের অধিকার সবারই আছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মেনে দেশের যেকোনো নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। তাই শুধু সাংবাদিকদের কথা ভাবলেই চলবে না; ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিরোধী সব ধারা নিয়েই কথা বলতে হবে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মাত্র মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। এটি আইনে পরিণত হতে আরো অনেক ধাপ পেরোতে হবে। সংসদে উত্থাপিত হবে। যাচাই-বাছাইয়ের জন্য কমিটিতে পাঠানো হবে। কমিটির সুপারিশের পরই কেবল তা সংসদে পাস হবে। আশা করি, এসব ধাপের কোনো না কোনো পর্যায়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। এই প্রক্রিয়ার নানা পর্যায়ে সিনিয়র সাংবাদিক বা গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞদের মতামত নিতে পারে। ৫৭ ধারার মত পরে বাতিল করার চেয়ে আইন হওয়ার আগেই ভুল শুধরে নেওয়া ভালো।

লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।