অভিমত
কৃষ্ণপদ ও বাপ্পীদের মৃত্যু, দায় কার?
সোমবার দুপুর দেড়টা। রীমা কমিউনিটি সেন্টারের দুই ফটক ও সড়কে প্রচণ্ড ভিড়। পশ্চিম গেটে সবার সামনেই ছিলেন কৃষ্ণপদ দাশ। গেট খুলতেই হাত থেকে মোবাইলটি ছিটকে পড়ে। কিছুটা ঢালু জায়গা থেকে সেটি নিতে গিয়ে পেছন থেকেই প্রচণ্ড ধাক্কায় লুটিয়ে পড়েন কৃষ্ণপদ। তাঁর পেছনে থাকা ২০-২৫ জন পদদলিত হন। পেছন থেকে তখনো মানুষ ঢুকছিল। মুহূর্তেই সেখানে প্রাণ যায় ১০ জনের।
বন্দর নগরীর রীমা কমিউনিটি সেন্টারে সদ্য প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কুলখানিতে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।
কৃষ্ণপদ একজন জেলে। নগরীর কাট্টলীর জেলেপাড়ায় তাঁর বাসা। পাঁচ বছরের এক ছেলে ও দেড় বছরের এক মেয়ে ছিল তাঁর। সোমবার বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বামী কৃষ্ণপদের জন্য আহাজারি করছিলেন সারথি দাশ। কৃষ্ণের কাকাতো ভাই মিন্টু দাশ বলেন, ‘মহিউদ্দিন চৌধুরীর জন্য কৃষ্ণ পাগল ছিল। তাই সে কুলখানিতে গেছে। তার মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে যায়। সেটা তুলতে গিয়ে কৃষ্ণ পড়ে যায়। আমরা তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পেছন থেকে যেভাবে ধাক্কা দেওয়া হচ্ছিল তাঁকে তোলা সম্ভব হয়নি। আরো কয়েকজন পড়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যেই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যায়।
‘ও বাপ্পী, ওঠো : বাপ্পী তোমার কী হয়েছে? ও বাপ্পী, ওঠো’- কেবল এ দুটি লাইন বলতে বলতে মূর্ছা যাচ্ছিল প্রদীপ তালুকদারের দুই মেয়ে রিফা তালুকদার ও হীরা তালুকদার। রিফা এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। আর ছোটজন পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে। প্রদীপ একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। সোমবার সকালে কর্মস্থলে যাওয়ার কথা বলেই বাসা থেকেই বের হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দুপুরে তাঁর মৃত্যু সংবাদ পায় পরিবার। বিকেলে চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিল প্রদীপের দুই মেয়ে ও স্ত্রী।
পদদলিতের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অনুপ দাশ। তিনি নিজেও পায়ে ব্যথা পেয়েছেন। তিনি বলছিলেন, ‘ফটকের বাইরে অনেক মানুষের ভিড়। ঢোকার সময় ঢালু জায়গায় থাকা বেশ কয়েকজন পড়ে যায়। তাদের গায়ের ওপর দিয়েই পেছনের লোকজন হুড়মুড় করে ঢোকার চেষ্টা করায় এ ঘটনা ঘটেছে।’
কৃষ্ণপদ ও প্রদীপের মতো রীমা কমিউনিটি সেন্টারে প্রাণ গেছে আরো আটজনের। এ ছাড়া আহত হন আরো অন্তত ১৫ জন। নিহতদের মধ্যে অন্যরা হলেন– চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দীপংকর দাশ, পাহাড়তলীর ঝন্টু দাশ পিন্টু, বাঁশখালীর সুধীর দাশ, ধনা শীল, আনোয়ারার লিটন দেব, সীতাকুণ্ডের অলক ভৌমিক, সুচরিত দাশ খোকন ও সুমন দাশ।
চট্টল বীর মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর থেকে দাফন করা পর্যন্ত যত মানুষ তাঁকে শেষবারের মতো দেখতে এসেছিল তা বাংলাদেশের ইতিহাসেই স্মরণীয় ঘটনা। আর তাঁর কুলখানিতেও লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি থাকার বিষয়টি আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন পরিবারের সদস্যরা। তাই ১৪টি কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজন করা হয়েছিল লক্ষাধিক মানুষের খাবার। সে মোতাবেক সোমবার সকালে পাঁচলাইশের একটি কমিউনিটি সেন্টারে শুরু হয় মূল আয়োজন।
সেখানে অংশ নেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদসহ আওয়াম লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাসহ সর্বস্তরের জনগণ। কিন্তু শোকাবহ এ আয়োজনের মধ্যেই ঘটে মর্মান্তিক ঘটনা। কুলখানির আয়োজনে থাকা আসকার দীঘির পাড় এলাকার রীমা কমিউনিটি সেন্টারে উপস্থিত হওয়া মানুষ হুড়োহুড়ি করে ভেতরে প্রবেশ করতে গিয়ে ঘটে যায় পদদলিত হওয়ার ঘটনা।
ঘটনার পরই আহতবস্থায় সবাইকে নিয়ে আসা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আর এতে মৃত্যু হয় ১০ জনের। আহত হন আরো অর্ধশতাধিক। ঘটনার পরই কুলখানির আয়োজনে থাকা মানুষের গন্তব্য হয়ে উঠে চট্টগ্রাম মেডিকেল। এখানেও মারা যাওয়াদের দেখতে আসেন হাজারো মানুষ। এ সময় মৃত ব্যক্তিদের স্বজনদের আর্তনাদে হাসপাতালের পরিবেশ হয়ে উঠে শোকাবহ। কেউই বিশ্বাস করতে পারছেন না এ অনভিপ্রেত ঘটনা।
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।