তারুণ্যের শক্তি
অভিনব উপায়ে সেঁতু তৈরি হচ্ছে ঝাঁপা বাঁওড়ে
এটা কোনো গল্প নয়। কিংবা নয় কোনো ভিনদেশি ইতিহাস, যা শুনিয়ে চায়ের দোকানে কথার খই ফুটবে আর কথায় কথায় বলবে,বাঙালিদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না! ঘটনাটা একদম উল্টো। যশোরের মণিরামপুর উপজেলার ঝাঁপা বাঁওড়। বাঁওরের এক পাশে ঝাঁপা ইউনিয়ন আর ওই পাড়ে রাজগঞ্জ বাজার। বছরের শুরুর দিকের ঘটনা। পাঁচ ছয়জন লোকসহ গল্প করছিলেন গ্রামের শিক্ষক আসাদুজ্জামান। ঠিক তার সামনেই নদী থেকে উত্তোলন করা হচ্ছিল বালু। হঠাৎ তিনি লক্ষ করলেন বালুর এত ভারি মেশিনটি রাখা আছে ব্যারেলের ওপর। তাৎক্ষণাৎ ব্যাপারটি শেয়ার করলেন অন্যদের সঙ্গে। ‘আচ্ছা,বালুর এত ভারী মেশিন এর ভার যদি সহ্য করে ব্যারেল তাহলে ব্রিজের কেন নয়?’
তারপরের গল্পটি সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রিকার পাতায় পাতায়। গ্রামের ৫৬ জন যুবকের সমন্বয়ে তৈরি করা হয় ঝাঁপা গ্রাম উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। কোনোরকম সরকরি-বেসরকারি সাহায্য ছাড়াই সম্পূর্ণ নিজেদের উদ্যোগেই গঠিত হয় ফান্ড। ব্রিজ তৈরির কাজ শুরু হয়ে যায়। এই বিশাল উদ্যোমী টিমের সঙ্গে যুক্ত হন রায়গঞ্জ বাজারের লৌহ কারিগর রবিউল ইসলাম।
কাজ চলছে পুরোদমে। প্রায় ৮৩৯ টি প্লাস্টিক ব্যারেল, ৮০০ মণ লোহার অ্যাঙ্গেল পাত, ২৫০টি লোহার সিটের ব্যবহারে প্রায় শেষের দিকে ব্রিজ নির্মাণের কাজ। ফাউন্ডেশনের সভাপতি টুটুল জানিয়েছেন,আসছে ১ জানুয়ারি ব্রিজটি খুলে দেওয়া হবে সবার জন্য।
যশোরের ঝাঁপা গ্রামের মানুষ নিজেদের এত বড় সমস্যার সমাধান করে ফেলছে নিজেরাই। শুধু তাই নয়, নিজেদের শ্রম দিয়েই তৈরি করে চলছে পুরো ব্রিজ। এ যেন এক অহংকারের গল্প। আমরা কথায় কথায়, গ্রামকে নিয়ে কটাক্ষ করি কিন্তু সেই অজোপাড়াগাঁর গ্রামীণ মানুষগুলো তাদের একতা,তাদের শ্রম,তাদের মেধা দিয়ে দেখিয়ে দিল তারাও পারে।
আমি বলছি না সরকারের কোনো দায়িত্ব নেই। কিন্তু আমরা যখন বর্ষাকালে রাস্তায় পানি দেখে সরকারকে গালি দেই, ঠিক তখন কি ভাবি আমি আমার খাওয়া চিপসের প্যাকেটটি কোথায় ফেললাম? আমার ফেলা ময়লা কোথায় গিয়ে পড়ছে? আজকের এ জলাবদ্ধতা কি একদিনের সৃষ্টি? বাড়ি করবার সময় কি অত্যন্ত নিজের বাড়ির ড্রেনেজ ব্যবস্থাটা কি ঠিক রেখেছি? এটা একটা উদাহরণ মাত্র। এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে যে কাজগুলো সরকার একা কিছুই করতে পারবে না, যদি আমরা সঙ্গে না থাকি।
ঝাঁপা গ্রামের মতোই হাজার গ্রাম আর মহল্লা মিলেই তো পুরো একটি দেশ। ওরাও তো বাংলাদেশের আলো ছায়ায় বেড়ে উঠা সাধারণ মানুষ। প্রতিদিন নৌকায় কষ্ট করে যাদের যাতায়াত। শহুরে শিক্ষার্থীদের মতো তাদের সুযোগ সুবিধা নেই। মাঝেমধ্যেই নৌকা থেকে পড়ে ভিজে যায় বই খাতা। কিন্তু তাতে কী? গ্রামের একজন সাধারণ শিক্ষকের মাথায় চলে এলো সেই সমাধান। আর ভালো কাজ বলেই পুরো গ্রামবাসী সমর্থন দিল তাকে। ৫৬ জন টগবগে তরুণ একত্রিত হলেন। অথচ আমরা প্রায়ই দেখি যে কোনো কাজেই আমরা সহজে একমত হতে পারি না। কোনো উদ্যোগ হলেই যুক্তি, পাল্টা যুক্তি, দ্বিমত, দলাদলি, কোন্দল ইত্যাদির কমতি নেই। আর আমাদের সমাজে আছে আর একটা প্রতিযোগিতা সেটা হলো ক্রেডিট নেওয়ার দৌঁড়।
দেশপ্রেম শুধু ফেসবুকের প্রোফাইল ফটোতে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবে দেখানো উচিত। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ছেড়ে আমাদের উচিত প্রকৃত অর্থে সামাজিক কাজে হাত লাগানো। শুধু দরকার উদ্যোম আর সততা। এ দেশের তরুণদের ভালো কিছু করার ক্ষমতা অপরিসীম।