অভিমত
সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামবে কবে?
প্রতিদিন অজস্র ঘটনার মধ্যে একটি হলো ‘সড়ক দুর্ঘটনা’। প্রতিদিনই রাস্তাঘাটে আট-দশজন মানুষ অকালে মারা যাচ্ছে। অথচ সেদিকে আমাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। কেন সড়ক দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে তার কারণ জানতেও আমরা উৎসাহী নই। যেহেতু প্রতিদিনই কেউ না কেউ গাড়ির নিচে পড়ে প্রাণটা হারাচ্ছে। তাই বিষয়টি আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা সয়ে যাচ্ছি, অপমৃত্যু সয়ে যাচ্ছি, পঙ্গুত্ব সয়ে যাচ্ছি। আমরা ভাবছি, যে সহে সে রহে? নাকি আমরা প্রশ্ন করি, সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামবে কবে?
৪ ডিসেম্বর জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর একটি তথ্যে চোখ আটকে গেল। পত্রিকাটি জানাচ্ছে, ২৯০ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত দু হাজার ৫০৪ জন। এর মানে হচ্ছে প্রতিদিন গড়ে আটজনের বেশি মানুষ সড়কে প্রাণ হারাচ্ছে! আমাদের মনে পড়ে ২০১৫ ও ২০১৬ সালের ২২ মাসে (জানুয়ারি থেকে নভেম্বর) সড়কে নিহত হয়েছিলেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। অন্যদিকে আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। ভাবা যায়, একটি দেশে সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ১০ হাজার প্রাণ অকালে ঝরে যায়! বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ শারীরিক প্রতিবন্দি হয়ে পড়ে। আর সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি সাধিত হয়। এত বিপুল প্রাণহানি ও অর্থহানির কারণে আমাদের মৃত্যুর মিছিল থামার প্রশ্নটিকে কি আরো তীব্র করে না?
বাংলাদেশের বাইরে যাওয়া যাক। বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনার প্রকোপ কেমন তার একটি পরিসংখ্যান উপস্থাপন করা যাক। ইউরোপীয় ইকোনমিকস কমিশন, ইউএনইসিই, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাত দিয়ে ৩ মার্চ ২০১৭ প্রকাশিত দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশে সংগঠিত হয়। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে নেপাল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি ১০ হাজার গাড়িতে বছরে যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর হার দুজন, নিউজিল্যান্ডে ৩.৩ জন, যুক্তরাজ্যে ১.৪ জন, জাপানে ১.৭ জন ও পাকিস্তানে ১৯ জন। পাঠক, বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার গাড়িতে কতজন মারা যায় তার হিসেবে জানার জন্য আপনারা অপেক্ষমাণ? যেখানে ভারতের মতো এত বড় দেশের এর হার ২৫ জন, সেখানে বাংলাদেশের হার ৬০ জন। এই সংখ্যাটা ভাবা যায় কি? না মেনে নেওয়া যায়?
এই যে এত এত হাজার হাজার মানুষের অকালমৃত্যু তার দায় কে নেবে? জনসাধারণের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করার দায়িত্ব কি সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর নয়? সড়ক দুর্ঘটনারোধে সরকার উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু আমরা উদ্যোগের পাশাপাশি বাস্তবায়ন দেখতে চাই। আমরা দেখতে চাই সড়কে মৃত্যুর মিছিল থেমেছে। নেপাল গত কয়েক বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রথম স্থানে ছিল। তারা এখন দ্বিতীয় স্থানে, আর আমরা কিনা সড়কে মৃত্যুর মিছিলে প্রথম! নেপাল যদি সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস করতে পারে, তবে আমরা কেন পারছি না—এর কারণগুলো খতিয়ে দেখা দরকার। সড়ক দুর্ঘটনা রোধের উদ্যোগগুলো কেন ফলপ্রসূ হচ্ছে না। তার বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। কেন সড়ক দুর্ঘটনা হয় সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় গবেষণা করে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। চালকের অদক্ষতা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লাইসেন্স নেই, প্রশিক্ষণের অভাব, পথচারীর অসচেতনতা, রাস্তার বেহাল দশা, ওভার টেকিংয়ের মানসিকতা, নেশাদ্রব্য খেয়ে গাড়ি চালানো, চালকের বিশ্রামের অভাব, তাড়াহুড়া, ট্র্যাফিকের দায়িত্বহীনতা, সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা। সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন অসংখ্য বিষয় আমাদের সামনে চলে আসে। এসব থেকে সাধারণ মানুষ নিঃসন্দেহে পরিত্রাণ চায়। আমরা চাই, জনগণের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিশেষভাবে ভাবুক, গবেষণা করুক এবং কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করুক। আমরা চাই যে ছেলেটি বড় হয়ে দেশের নাম উজ্জ্বল করতে চায়, যে মেয়েটি পৃথিবীকে জানাতে চায় তার স্বপ্নে কথা, যে শিশুটি পাখি হওয়ার স্বপ্ন দেখে, যে বাবা দিনভর কাজ করে ঘরে ফিরছে, যে শ্রমিক জীবনযুদ্ধে মগ্ন। তারা, আমরা, আমরা সবাই নিরাপদে ঘরে ফিরব। আমাদের এই ন্যায্য দাবি পূরণে সরকার নতুন করে ভাববে এবং মৃত্যুর মিছিল বন্ধে বিশেষ প্রদক্ষেপ করবে বলে আমরা মনে করছি।
লেখক : গল্পকার ও সম্পাদক, বাঁক।