চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
কিছু স্মৃতি, কিছু কথা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে (চবি) নিয়ে শিক্ষার্থীদের অনেক স্মৃতি রয়েছে, যা জীবনে চলার পথে অনুপ্রেরণা জোগায়। ছাত্রজীবনের পূর্ণতা বিকাশের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবদান অনস্বীকার্য। আর শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয় দেশের মধ্যে তার অবস্থান ধরে রেখেছে, যা শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের জন্য অনেক গর্বের বিষয়।
আগামী ২২ ডিসেম্বর সিলেটে বসছে চবির প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা। এ আয়োজনকে সফল ও সার্থক করে তোলার জন্য চিটাগং ইউনিভার্সিটি এক্স স্টুডেন্টস ক্লাব, সিলেট কর্তৃক কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
মিলনমেলাকে কেন্দ্র করে প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। অনেক আবেগ ও ভালোবাসা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এতে পড়ার সুযোগ পেয়েই বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষাগুরু শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বন্ধু ও স্যারদের কথা কখনো ভোলা যাবে না।
অনেক আবেগ ও ভালোবাসার এ বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর যাত্রা শুরু করে। ১৭৫৩.৮৮ একর এলাকা নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান, যা চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার উত্তরে হাটহাজারী উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নে পাহাড়ি ও সমতলভূমির ওপর অবস্থিত।
বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এত স্মৃতি ও আবেগ জড়িয়ে আছে, যা প্রকাশ করা সহজ বিষয় নয়। ১৯৮৫-৮৬ সেশনে লোকপ্রশাসন বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর প্রিয় বন্ধু ও শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের পেয়ে খুব ভালো লাগে। আমরা অনেক সময় আনন্দ আড্ডায় মত্ত থাকলেও পড়ালেখার ব্যাপারে সচেতন ছিলাম। শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকদের নজরদারি জোরালো ছিল। স্যারদের অভিভাবকসুলভ কড়া শাসনের জন্য ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার খুব একটা সুযোগ ছিল না। আর স্বনামধন্য স্যারদের কাছে পেয়ে আমাদের পড়ালেখার চিন্তার জগৎ খুলে যায়। প্রফেসর আবদুন নূর, প্রফেসর ড. আহমেদ শফিকুল হক, প্রফেসর নুরুস সাফা, প্রফেসর নুরুল ইসলাম, প্রফেসর আবদুল ওয়াহাব, প্রফেসর নিজাম উদ্দিন, প্রফেসর রুহুল আমিনের মতো স্বনামধন্য শিক্ষকবৃন্দ ক্লাসে যখন আসতেন, তখন শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা মনোযোগসহকারে স্যারদের কথা শুনতাম, ক্লাস উপভোগ করতাম।
প্রিয় স্যারদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার শেষ নেই। শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা সকলে তা মেনে চলতাম। মা-বাবার পর শিক্ষাগুরু স্যাররাই তো আদর্শ মানুষ। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে আসার পরও স্যারদের খোঁজখবর নেই। তবে দেখা-সাক্ষাৎ খুব একটা হয়ে ওঠেনি। একবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীকে নিয়ে প্রফেসর আবদুন নূর স্যার সিলেট বেড়াতে আসেন। স্যার সবাইকে নিয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে এলে স্যারের সঙ্গে আমার দেখা হয়। স্যার আমাকে দেখে অন্যান্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সামনে ‘আমার ছাত্র’ বলে পরিচয় করিয়ে দেন। স্যারের কথা শুনে গর্বে আমার বুক ভরে ওঠে। প্রফেসর আবদুন নূর স্যার ১৯৯২ সালের ১৬ ডিসেম্বর ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শিরোনামে একটি বই লিখেন। মুক্তিযোদ্ধা প্রিয় স্যারের বইটি আমার কাছে সংরক্ষিত আছে।
প্রফেসর আবদুন নূর ও প্রফেসর নুরুস সাফা স্যার দুনিয়াতে নেই, তবে তাঁদের স্মৃতি ও কথা ভোলার নয়।
আমি হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। তবে সে সময় হলে সিট পাওয়া ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। আমার ইমিডিয়েট বড় আমিন ভাই শাহ আমানত হলে থাকার সুবাদে আমিও থাকার জন্য প্রথমে ভাইয়ের রুমে উঠি। প্রথম দিকে দুই ভাই ডাব্লিং করতাম। কিছুদিন পর ভাইয়ের বন্ধু সুনামগঞ্জের সিরাজ ভাইয়ের সৌজন্যে একটি সিটের ব্যবস্থা হয়। তবে আমার থাকার বিষয়টি নেতাগোছের রুমমেটরা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। তাঁদের অনেকটা তোয়াজ করে চললেও সেই রুমে আমার বেশিদিন থাকা হয়নি। এঁদের মানসিক অত্যাচারে আমি অনেকটা বাধ্য হয়ে ভাইয়ের আরেক বন্ধু মৌলভীবাজারের অদুদ ভাইয়ের সৌজন্যে সোহরাওয়ার্দী হলে তাঁর রুমে আশ্রয় নিই। এভাবে হলে থাকা ও পড়ালেখা অনেক কঠিন ছিল। আমার মতো ভুক্তভোগীরাই তা ভালো বলতে পারবেন। একপর্যায়ে আমার দুরবস্থা দেখে টাঙ্গাইলের বন্ধু মীর মনিরুল আলম আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়ায়। বন্ধুর সহযোগিতায় শাহ আমানত হলে একটি সিটের ব্যবস্থা হয়। আমার এ বন্ধুর সহযোগিতার কথা খুবই মনে পড়ে। কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, আমার সেই প্রিয় বন্ধুটি কোথায় আছে, জানি না। একসময় সে ব্র্যাকে চাকরি করত, এতটুকু জানতাম। কিন্তু অনেককে বলেও এখনো তার খবর জানতে পারিনি।
আমার জীবনে চলার ক্ষেত্রে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের অবদান অনস্বীকার্য। ১৬ নভেম্বর ২০১৭ তারিখ অফিস শেষে গাড়িতে করে আসার সময় ফেলে আসা দিনগুলোর বন্ধুদের কথা খুব মনে পড়ে। তাৎক্ষণিক ভাবনা থেকে বন্ধুবিষয়ক চারটি লাইন মনে আসে, যা বন্ধুবিষয়ক আমার ভালোবাসার প্রকাশ :
বন্ধু
বন্ধু মানে প্রাণ খুলে হাসা
বন্ধু মানে অনেক দিনের কথা
বন্ধু মানে দুচোখ দিয়ে মনের মতো দেখা
বন্ধু মানে অনেক অনেক ভালোবাসা।
এখানে প্রাসঙ্গিক বিধায় বন্ধুদের কথা বললেও জীবনে চলার ক্ষেত্রে আরো অনেকের সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অবস্থানকাল মোট সাত বছর। আমদের সময়ে চার বছরের পড়ালেখা সেশনজটসহ অন্যান্য কারণে সাত বছর লেগে যেত, যা আমাদের মতো মধ্যবিত্ত সমাজের যে কারো জন্য অনেক কষ্টসাধ্য। এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেশনজটজনিত সমস্যার অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে তাল মিলিয়ে চলতে শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে আরো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
লেখক : অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বিদ্যালয়, সিলেট।