আন্তর্জাতিক
কোন পথে ভারতীয় পার্লামেন্ট
প্রতিটি দেশের পার্লামেন্ট হলো গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় স্তম্ভ। ঠিক ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়; বরং ভারত হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু সে দেশের পার্লামেন্টে এখন অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) কয়েকজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তদন্ত এবং তাঁদের পদত্যাগের দাবিতে প্রায় দুই সপ্তাহ পার্লামেন্টে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। চলতি বর্ষাকালীন অধিবেশনে এখন পর্যন্ত একদিনও পার্লামেন্ট সচল করতে পারেনি ক্ষমতাসীন পার্টি। সরকার ও বিরোধীদের অনড় অবস্থানের কারণে দেশটির গণতন্ত্র যেন স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। সংসদকে সচল করতে সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সর্বদলীয় বৈঠকের ডাক দিলেও তাতে কোনো কাজ হয়নি। স্পিকারের উদ্যোগে ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকও ব্যর্থ হয়েছে।
গত বছর ভারতীয় লোকসভা নির্বাচনে বিশাল জয় নিয়ে ক্ষমতায় আসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি)। সে সময় তিনি দুর্নীতিমুক্ত সরকার গঠনের সাহসী অঙ্গীকার করেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসার মাত্র এক বছরের মাথায় তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়। দুই মাস আগে মোদি ও তাঁর দল ক্ষমতায় আসার এক বছর পূর্তি পালন করেন। এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম ভারতীয় অর্থনীতির সংস্কারের নতুন উদ্যোগের ঘোষণা দিয়ে সরকারকে দুর্নীতিমুক্ত বলে দাবি করেন। তার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এবং রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে বিব্রতকর অভিযোগ ওঠে। এর পর লোলিত মোদি ইস্যুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে এবং শিক্ষাবিষয়ক ব্যাপম কেলেঙ্কারির ঘটনায় মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংয়ের পদত্যাগের দাবিতে বিরোধী সংসদ সদস্যরা একাট্টা হন।
ভারতীয় বিশ্লেষক বলছেন, প্রকাশিত দুর্নীতির ঘটনাবলি সত্যি সত্যিই বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের ভাবমূর্তি অনেক নিচে নামিয়ে দিয়েছে। এর আগে তাদের কোনো কেলেঙ্কারি স্পর্শ করতে পারেনি, তারা দুর্নীতিমুক্ত। কিন্তু ১৩তম মাস যেতে না যেতেই সবখানেই দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হতে শুরু করে। দুর্নীতিপরায়ণ সাবেক ক্রিকেট কর্মকর্তা লোলিত মোদিকে যুক্তরাজ্যের পাসপোর্ট পেতে সহায়তা করার জন্য সুষমা স্বরাজকে বরখাস্ত করার দাবি সরকার অগ্রাহ্য করেছে। সরকারের বিরুদ্ধে সর্বশেষ অভিযোগগুলো মোদির গুরুত্বপূর্ণ ভূমি, কর ও অন্যান্য আইন সংস্কারের উদ্যোগকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। এর ফলে পার্লামেন্টে হট্টগোলের কারণে লোকসভার নতুন অধিবেশন বন্ধ রয়েছে। কারণ, বিরোধীরা কেলেঙ্কারিতে জড়িত সুষমা স্বরাজ ও রাজ্য মুখ্যমন্ত্রীদের পদত্যাগ দাবি করেছেন। অন্যদিকে, সরকার বিরোধীদের পদত্যাগের দাবিকে দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে আখ্যায়িত করেছে। সরকার বলেছে, বিজেপি নেতাদের কেউই কোনো আইন ভাঙেনি। সুতরাং তাঁদের পদত্যাগের প্রশ্নই ওঠে না। এর ফলে ভারতীয় পার্লামেন্টে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সংসদ চলতে দেওয়া হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন লোকসভার কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খার্গে। তিনি বলেছেন, অতীতে বিজেপি যেভাবে বিরোধিতা করে সংসদ অচল করে এসেছিল, আমরাও সেই পথ নিয়েছি। কিন্তু লোকসভার এই কংগ্রেস নেতার বক্তব্যে কি কোনো সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে? শুধু সংসদে আসা, হৈ-হট্টগোল করা, ভাতা নেওয়া এবং বাড়ি চলে যাওয়া—এটাই কি সংসদ সদস্যদের কাজ? এটা কেমন গণতন্ত্র? ভারতে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় এটা খুবই দুঃখজনক। এমন বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে সংসদের কাজকর্মে বাধা সৃষ্টি করা ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে এক বিপজ্জনক প্রবণতা। যার ফলে সংসদের দায়-দায়িত্ব এবং ইতিকর্তব্যের অবনতি ঘটে। জনসাধারণের অর্থের অপচয় হয়। সাম্প্রতিককালে তারই প্রতিফলন ঘটছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতীয় পার্লামেন্টে। এ ধরনের প্রবণতা কোনো দেশের জন্য সুখকর হতে পারে না। অধিবেশন চলাকালীন যেভাবে দিনের পর দিন সংসদ অচল করে রাখা হচ্ছে, তা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের স্ব-বিরোধিতা। এটার মাধ্যমে গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটে। এ ধরনের গণতান্ত্রিক দেশের দিকে সারা বিশ্ব তাকিয়ে থাকে। খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও গত বৃহস্পতিবার সংসদ সদস্যদের কর্মশালার অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘এমপিদের ওপরে মানুষের অনেক প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা পূরণের জন্য আমাদের কাজ করা উচিত। গোটা পৃথিবী আমাদের ওপর নজর রাখছে।’
সর্বশেষ ভারতীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু হলে হাতে কালো ব্যাজ ও প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করে বিক্ষোভ চালিয়ে যান বিরোধীরা। এ ঘটনায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায়ে স্পিকার সুমিত্রা মহাজন লোকসভার ২৫ কংগ্রেস সংসদ সদস্যকে পাঁচ দিনের জন্য বরখাস্ত করেছেন। ‘রুলস অব প্রসিডিউর কনডাক্ট অব বিজনেস ইন লোকসভা’র ৩৭৪(ক) ধারা অনুযায়ী তাদের বরখাস্ত করা হয়। ওই ধারায় বলা আছে, লোকসভার অধিবেশনে কেউ যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন, তাহলে স্পিকার তাদের একাধারে পাঁচ দিনের জন্য বরখাস্ত করতে পারবেন। এর কম সময়ের জন্যও করতে পারবেন। আবার অধিবেশনের বাকি দিনগুলোর জন্যও বরখাস্ত করতে পারবেন। স্পিকারের এ সিদ্ধান্তের পর একে ‘হিটলারি আচরণের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধী। তিনি এও বলেছেন, এমপিদের বরখাস্ত করা হলেও তাঁরা তাঁদের দাবি থেকে সরে আসবেন না; বরং এ ঘটনা ভারতের ‘গণতন্ত্রের জন্য কালো দিন’। এমতাবস্থায় কংগ্রেসের বরখাস্ত এমপিদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেস এবং আম আদমি পার্টিসহ (এএপি) আটটি বিরোধী দল এই পাঁচ দিন পার্লামেন্টের অধিবেশন বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে।
ভারতীয় সংসদীয় রীতি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, লাগাতার সংসদ বর্জন নয়, বরং সংসদে বিরোধী জোটের হৈচৈ, বিক্ষোভ আর সভা করা যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে স্পিকারকে বারবার অধিবেশন মুলতবি করতে হয়। দুই সপ্তাহ ধরে সুষমা স্বরাজ ও বসুন্ধরা রাজের ইস্তফার দাবিতে সংসদ অচলই ছিল। এ ব্যাপারে লোকসভার মধ্যে কখনো গান তুলে, কখনো প্ল্যাকার্ড দেখিয়ে অধিবেশনের শুরু থেকে সভা করতে তৎপর ছিলেন কংগ্রেস সাংসদরা। এর মধ্যে ২৫ সাংসদকে বরখাস্ত করে দিয়ে পরিস্থিতি আরো জটিল করে ফেললেন লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজন। এতে করে মনে হচ্ছে, সমঝতার পথ রুদ্ধ হয়ে গেল। এখন বলাই যায়, সংসদে কংগ্রেসকে একঘরে করতে গিয়ে উল্টে চাপে পড়ে গেল কেন্দ্রের শাসক দল। বস্তুত লোলিত মোদি-কাণ্ডে দুর্নীতির অভিযোগে সুষমা-বসুন্ধরাদের ইস্তফা না হলে সংসদ যে এবার চলতে দেওয়া হবে না, তা অধিবেশন শুরুর আগেই পরিষ্কার করে দিয়েছিল বিরোধীরা।
তবে স্পিকারের এমন সিদ্ধান্তে পরিস্থিতি যে আরো অবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তা বলাই যায়। তাহলে প্রশ্ন, সরকার এখন কী করবে? মঙ্গলবার আনন্দবাজার পত্রিকায় লিখেছে, বিজেপির কিছু নেতা সোমবার বিকেলেই এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, স্পিকার যেন সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেন, সে জন্য যেন তিনি (প্রধানমন্ত্রী) তাঁকে সরকারি অনুরোধ করেন। তাতে শাস্তির সিদ্ধান্তটি যে স্পিকারের ব্যক্তিগত ছিল, সেটা যাতে কংগ্রেস নেতাদের বোঝানো যায়। কিন্তু বিজেপির এই উদ্যোগে পার্লামেন্টে স্বস্তির বাতাস আসবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কারণ, দলটি লোলিত মোদি ইস্যুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ও রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে এবং শিক্ষা-সংক্রান্ত ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানের পদত্যাগের দাবিতে অনড় রয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এসব দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি; বরং বিজেপি মন্ত্রী এবং নেতারা বারবারই বলে আসছেন, মন্ত্রীদের পদত্যাগের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তবে বিজেপি জানিয়েছে, তারা লোলিত মোদি ইস্যুতে পার্লামেন্টে আলোচনা করতে রাজি। সুষমা স্বরাজ এ বিষয়ে কথা বলবেন। আর ব্যাপম কেলেঙ্কারি রাজ্যের বিষয়। এ নিয়ে সরকার কোনো আলোচনা করতে রাজি নয়। তবে কংগ্রেসও এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, পার্লামেন্ট সচল করতে এসব ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বক্তব্য দিতে হবে।
এমন পরিস্থিতিতে অচল আর বর্জন যেন ভাতীয় পার্লামেন্টে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধিবেশন চলাকালীন সরকার ও বিরোধী পক্ষের মধ্যে নানা ইস্যু নিয়ে বাদানুবাদ, অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ যেন একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি এমন নয় যে, যাঁরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না; বরং এটার সামধান পার্লামেন্টেই হাতে পারে। তবে প্রয়োজন উভয় পক্ষে সদিচ্ছা। অনেক সংসদ সদস্যের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কোনো ইস্যুর গভীরে গিয়ে বিতর্কে যোগ দিতে প্রবল অনীহা। গভীরে গেলে সংসদীয় বিতর্কটা হয়ে ওঠে প্রণিধানযোগ্য। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সস্তায় নিজেদের প্রচার এনে জননেতার দায়িত্ব পালন করতে চান। এটা তাঁর পেশা হতে পারে না। এ রকম অব্যাহত পার্লামেন্টের অচলাবস্থাকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে। দেশের উন্নয়নকে ব্যাহত করে, যা টেকসই উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের ওপর চরম আঘাত। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং গণতন্ত্রকে আরো সুসংহত করতে এখন প্রয়োজন সমঝোতা। দেশের স্বার্থে সরকার ও বিরোধী পক্ষের সমঝোতাই পারে বর্তমান অচলাবস্থা থেকে মুক্তি দিতে, যা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম নিয়ামক।
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক