মহাসড়ক পরিস্থিতি
তিন চাকার বাহন বন্ধ কতটা যৌক্তিক?
হাইওয়ে রোড ঘিরেই আমাদের অনেকের বাড়িঘর। চার লেন কি ছয় লেন—সব হাইওয়েই দিয়ে আমাদের চলতে হচ্ছে স্বল্প দূরত্বের পথে। আর এসব পথে আমাদের অন্যতম সঙ্গী তিন চাকার যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক যানবাহন।
সিএনজিচালিত অটোরিকশা, অটোটেম্পো, নছিমন, করিমন, ভটভটি, আলমসাধু, দুই সিটের অটোরিকশা, ছয় সিটের অটোরিকশা, মাহিন্দ্র, বোরাক ও মিশুক—সবই স্থানভেদে তিন চাকার যানবাহনের নাম। আর রিকশা-ভ্যান তো আছেই।
এগুলোর কোনটি ধীরগতির, আবার কোনোটি মাঝারি গতির।
হাইওয়ে রোডে এগুলো সমানতালে চলছে ভারী যানবাহনের সঙ্গে। তবে এগুলো স্বল্প দূরত্বের পথেই যাতায়াত করে।
বিশেষ করে প্রতিদিন ভোরবেলা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত এ বাহনগুলো হয়ে থাকে নাগরিক জীবনের অফিসে পৌঁছার অন্যতম অনুষঙ্গ। আবার অফিস থেকে ফেরার সময়ও একই অবস্থা। আর রাতদুপুরে এগুলোর কদর যেন আকাশছোঁয়া।
পাবলিক বাসগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। তখন মাঝারি আয়ের মানুষ বেছে নেন এ বাহনই। আবার গর্ভবতী মা থেকে শুরু করে অসুস্থ জনগণও এসব বাহনে স্বাধীনভাবে চলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যাংকার থেকে শুরু করে বেশ সম্মানজনক পদে চাকরি করেন এমন অনেকেই তাঁদের চলাচলের সঙ্গী হিসেবে বেছে নেন এসব যানবাহন, বিশেষ করে অটোটেম্পো।
আবার আপনার বাড়ি হাইওয়ের পাশেই, কিন্তু একটু ভেতরে অথবা আপনার মালামাল নিজের উঠান পর্যন্ত নিয়ে যেতে চান, তাহলে একমাত্র ভরসা এই তিন চাকার বাহনগুলোই। কারণ, এই বাহনগুলোই কেবল মহাসড়কে চলার পাশাপাশি আমাদের শহর-নগরের সরু রাস্তা দিয়ে মোটামুটি চলতে সক্ষম।
এই বাহনগুলো না থাকলে বোধ হয় মানুষের গড়ে ছয় কিলোমিটার পথ যেতে কমপক্ষে তিনবার গাড়ি পরিবর্তন করতে হতো। ধরুন, আপনার বাড়ি মহাসড়ক থেকে আধা কিলোমিটার ভেতরে, আপনার অফিস টাইম বা জরুরি কাজ আছে অথবা হাসপাতালেই যেতে হচ্ছে। তখন আপনাকে একবার আসতে হবে মহাড়কের স্টেশনে, তার পর চার চাকার ভারী যন্ত্রের গাড়িতে চড়ে আপনার গন্তব্য স্টেশনে নামতে হবে। সেখান থেকে আবার আপনার মূল গন্তব্যস্থলে যেতে অন্য গাড়ির জন্য অপেক্ষা। একটি গাড়ির জন্য গড়ে পাঁচ মিনিট করে অপেক্ষা করলেও আপনার বাড়তি সময় ব্যয় করতে হচ্ছে ১৫ মিনিট। অথচ এই ১৫ মিনিট সময়ে এসব হালকা বাহন দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে আপনি যাতায়াত করতে পারবেন এই ছয় কিলোমিটার পথ। আপনি চাইলে একটি গাড়িতে করেই এ পথ পাড়ি দিতে পারবেন।
হয়তো তাই দিন দিন গ্রামাঞ্চল থেকে শুরু করে শহরের হাইওয়ে রাস্তায়ও বাড়ছে এসব যানবাহনের সংখ্যা।
সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে এসব যানবাহনের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, তা কি আসলে যৌক্তিক প্রয়োগযোগ্য? এ প্রশ্ন সবার।
গত ২৭ জুলাই সরকারের পক্ষ থেকে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলো, তাতে যুক্তি দেখানো হলো, এসব যানবাহন হাইওয়ে রোডে চলাচলের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। আসলে বিষয়টা কি শতভাগ সত্যি?
এ পর্যন্ত আমরা যত সড়ক দুর্ঘটনা লক্ষ করছি, তার মধ্যে এমন কারণ যথেষ্ট থাকলেও খেয়াল করলে দেখা যাবে অদক্ষ চালক, ট্রাফিক-নীতি না মানা, গাড়ি চালানোর আগে যন্ত্রাংশ মেরামত করে না নেওয়াও দুর্ঘটনার অহরহ কারণ। তাহলে আমরা কি ড্রাইভার ছাড়াই গাড়ি চালাব? সোজা উত্তর—না। তাহলে আমাদের করণীয় কী? জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। ভারী যান, হালকা যান উভয়ের চালক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ ও ক্যাম্পেইনের আওতায় নিয়ে আসা। চালকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা। তাঁদের মধ্যে মাদকবিরোধী সচেতনতা গড়ে তোলা। উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রদান করা। যানবাহনের ওপর চাঁদাবাজিসহ অবৈধ হস্তক্ষেপ রোধ করা। দোষীদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা। কারণ, অবৈধ টাকার জোগান দিতে গিয়ে অনেক সময়ই এসব বাহনের চালকদের বাড়তি উপার্জনের লক্ষ্যে তড়িঘড়ি করে গাড়ি চালাতে হয়। ফলে ঘটে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।
প্রায়ই রাস্তা ভাঙা থাকার কারণে দুর্ঘটনার সংবাদ শুনতে হয়। তাহলে আমরা কি ওই রাস্তা ব্যবহার বন্ধ করে দেব? নিশ্চয়ই না। সরকারের করণীয় রাস্তা মেরামত করে দেওয়া। মোড়ে মোড়ে গতিরোধক ও নির্দেশনামূলক সাইনবোর্ড স্থাপন করা। হাইওয়ে রোডগুলোতে হাইওয়ে পুলিশসহ সিভিল পোশাকের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি ২৪ ঘণ্টার জন্য অব্যাহত রাখা।
কোনো গাড়ি বা চালকের গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হলে তাকে থামিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা যেতে পারে।
আমাদের হাইওয়ে রোডগুলো এমন নয় যে, এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনের মাঝখানে শত শত মাইল পথ। মাঝখানে কোনো জনবসতি নেই। গড়ে প্রতি কিলোমিটারের মাথায় একটি করে ছোট-বড়-মাঝারি ধরনের স্টেশন লক্ষ করা যাচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে, এসব স্টেশনের সংখ্যা তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব নিকটতম স্টেশনগুলোর সঙ্গে নিকটতম স্টেশনের লোকদের রয়েছে জরুরি যোগাযোগ প্রক্রিয়া। আর তাঁরা এসব স্থানে যাতায়াতের জন্য হালকা বাহন ছাড়া ভারী কোনো বাহনে সাধারণত জায়গা পান না। কারণ, ভারী বাহনগুলোতে অনেক সময়ই দূরত্ব হতে মাঝারি দূরত্বের লোকরাই বোঝাই হয়ে থাকে।
আমাদের লোকসংখ্যার তুলনায় পরিকল্পিত নগর ও রাস্তাঘাট তেমন নির্মাণ হয়নি। ফলে এক রাস্তার ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে স্বল্প দূরত্ব ও বেশি দূরত্বের মানুষকে। কিন্তু আনুপাতিক হারে ভারী যন্ত্রের জোগান নেই। এখানেও দুটি কারণ রয়েছে—এক. মালিকদের পুঁজির অভাব, দুই. সব সময় যাত্রী পাওয়া যায় না। ফলে ভারী যন্ত্রের মালিকদের লোকসানের মুখে পড়তে হয়। অথচ হালকা যন্ত্রের যান তথা থ্রি-হুইলারগুলো পাঁচ-ছয়জনের যাত্রী সহজেই পেয়ে থাকে। তারা দিনের শেষে অল্প উপার্জনেও লোকসান এড়াতে পারে। পরিবারের ন্যূনতম ব্যয় নির্বাহ করতে পারে।
অন্যদিকে, যাত্রীবাহী গাড়িগুলোর, বিশেষ করে সরকারি গাড়িগুলোর সার্ভিস যে তুলনামূলক বাজে, এটা সবারই জানা। একটি বিআরটিসির বাস, বিশেষ করে দ্বিতল যুক্ত, কয়েকবার টেন্ডার শেষে মালিক পরিবর্তন হয়ে রাস্তায় নামানো হয়। আর এসব গাড়ির চেয়ে গরুর গাড়ি বোধ হয় দ্রুত চলে। বিভিন্ন স্টেশনে এসব গাড়ি এত সময় ধরে অপেক্ষা করে যে, সাধারণ যাত্রীদের অফিসের সময় শেষ হয়ে যায়। আর যেগুলো সরাসরি সরকারের মালিকানায়, সেগুলোর সার্ভিসও যে ভালো, তা কেউই হলফ করে বলতে পারবে না। তাই সাধারণ মানুষ নিজের সাধ্যমতো স্বল্প দূরত্বের জন্য বেছে নেয় হালকা যান।
১ আগস্ট থেকে অটোরিক্শা ও অটোটেম্পো চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে কয়েক দিন ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলছে এসব শ্রমিকের কর্মবিরতি। চলছে না এসব বাহন। আর এতেই দেশবাসী দেখতে পেল, মানুষের কী করুণ অবস্থা। রাস্তায় শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। অথচ গন্তব্যে পৌঁছার মতো গাড়ি নেই বললেই চলে।
মাঠে নেমে যাওয়া এসব শ্রমিকের একটাই দাবি, পৃথক লেন তৈরি করে দিতে হবে। তার মানে তারাও সরকারের যুক্তিকে একেবারে অস্বীকার করছে না। তাহলে কী করতে হবে? সড়ক ও মহাসড়ক সচিব এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, আইন লঙ্ঘনকারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তার মানে কী? এতসব লোককে জেলে পুরে দেবেন? নাকি জরিমানা করবেন? কোনোটিই সামগ্রিকভাবে প্রয়োগ সম্ভব নয়।
তাহলে যা করা যেতে পারে, সরকারকে এসব যানবাহন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে একটা আলোচনায় আসতে হবে। আলোচনায় সরকারের পক্ষ থেকে এ প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, যেসব মহাসড়কে আপাতত আলাদা লেন তৈরি সম্ভব হচ্ছে না, সেখানে তারা যথাসম্ভব দ্রুত তা বাস্তবায়ন করবে। আন্দোলনকারী পক্ষেরও এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, তারা সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে গাড়ি চালাবে। অতিরিক্ত মালবোঝাই করে গাড়ি চালাবে না। মাঝ রাস্তায় গাড়ি চালাবে না। কারণ, এতে দূরপাল্লার গাড়িগুলোর লেন পরিবর্তন করতে হয়। এতেই ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। আর সব স্তরের চালকদেরই হতে হবে দক্ষ। সরকার ও স্থানীয় গাড়ি মালিকদের যৌথ উদ্যোগে গড়ে তোলা যেতে পারে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। যেখানে নিরাপদ গাড়ি চালানোর বিষয়ে সরকারি কর্তাব্যক্তিরা ক্যাম্পেইন করবেন। এতে বেশ ফল বয়ে আনবে বলে আমি মনে করি।
আরেকটা কথা বলে রাখি। ঘুষ বন্ধ করতে হবে। দলীয় সখ্য বন্ধ করতে হবে। কারণ এ দুটোর কারণেই রাস্তায় চলছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি। আর আনাড়ি ব্যক্তিই পেয়ে যাচ্ছেন ড্রাইভিং লাইসেন্স।
এবার আসা যাক ভিন্ন প্রসঙ্গে। এরই মধ্যে হাইকোর্টও দেশের বিভিন্ন স্থানে বাস মালিক-শ্রমিকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অটোরিকশা ও টেম্পোর মতো যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। কয়েক বছর ধরে বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফা আন্দোলনও হয়ে গেল। পরিশেষে দেখা গেল, সরকারের আদেশ বা হাইকোর্টের আদেশ শুধু আদেশই রয়ে গেল। কেউই তা মানছে না। কারণ, পেট তো আর মানবে না। টাকা লাগবে। নিজে চলতে হবে। পরিবার চালাতে হবে।
প্রাইভেটকার ও বাইকের জন্য অহরহ ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। প্রশিক্ষণার্থী প্রাইভেটকারের চালক গাড়ি নিয়ে উঠে যান মহাসড়কে, যাঁরা সাধারণত সমাজের ক্ষমতাধর ব্যক্তি। এঁদের বেলায় কিছুটা হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নমনীয়তা লক্ষ করা যায়।
অন্যদিকে, সড়ক-মহাসড়কে সবচেয়ে অহরহ দুর্বিষহ দুর্ঘটনাটি হচ্ছে মোটরসাইকেলসহ নানা ধরনের যানের কারণে। এদের বেশির ভাগই হচ্ছে দ্রুতগতিতে চালাতে গিয়ে বা ওভার টেক করতে গিয়ে।
বাস মালিক-শ্রমিকরা বরাবরই দুর্ঘটনার জন্য এসব হালকা বাহনকে দায়ী করে আসছেন। তাঁদের এ দাবি মোটেও অসত্য নয়। কিন্তু এটাও তো সত্য, বাসে-বাসে, বাসে-ট্রাকে দুর্ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। তাহলে এ ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় কী? বা বাস মালিকদেরও কী করণীয়? তাঁরা কি বাস চালানো বন্ধ করে দেবেন, নাকি ট্রাক চালানো বন্ধ করে দেবেন?
কোনো বন্ধ করাই সমস্যার সমাধান নয়। দুর্ঘটনা শতভাগ বন্ধ করা কি পৃথিবীর কোথাও সম্ভব হয়েছে? তবে দেশভেদে, আইন মানা-না মানাভেদে এ দুর্ঘটনা প্রবণতায় তারতম্য রয়েছে। আমাদের মতো দেশগুলোতে এ দুর্ঘটনা বেশি।
আলোচনা, ক্যাম্পেইন, আলাদা লেন তৈরি, সড়ক মেরামত, যতটা সম্ভব সোজা রাস্তা তৈরি, ফিটনেসসম্পন্ন গাড়ি চালানো ও দক্ষ চালকই পারে এসব দুর্ঘটনার পরিমাণ কমাতে।
লেখক : সাংবাদিক