ছিটমহল
রেজাউলের নাগরিকত্ব পাওয়ার গল্প
রেজাউল ইসলাম প্রামাণিক। বাড়ি দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহলে। জন্ম কবে হয়েছে, জানেন না তিনি। তবে নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করার সময় শিক্ষকরা তাঁর জন্ম ১৯৯৫ সাল বলে লিখে দেন। এ সময় থেকেই তাঁর লিখিত জন্মতারিখ।
বাবা-মা কেউই নিজের নাম লেখা তো দূরের কথা, এক-দুই-তিন করে ৫০-এর বেশি গুনতেও জানেন না।
যতদূর জানা যায়, দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহল থেকে তিনিই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া কোনো শিক্ষার্থী। রেজাউল পড়ছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে (৪৩তম ব্যাচ)।
২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে তিনি ভর্তি হন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক উভয় পরীক্ষাতেই বিজ্ঞান বিভাগ থেকে যথাক্রমে জিপিএ ৪.৯৪ ও ৪.৯০ পেয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। আর দশটা সাধারণ ছেলের মতোই তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমুল প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে মেধার স্বাক্ষর রাখতে হয়েছে।
শনিবার বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহলবাসীর দীর্ঘ ৬৮ বছরের পরাধীন জীবনের অবসান প্রাক্কালে তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতিতে বসে তিনি কথা বলছিলেন। তখন তাঁর চোখে লক্ষ করলাম, স্বাধীনতার উচ্ছ্বাস ও অনাগত ভবিষ্যতের চাহনি।
রেজাউল কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে একটা কথাই বারবার বলছিলেন, ‘আমরা তো মাত্র স্বাধীন হলাম। কোনো একটি দেশের নাগরিকত্ব পেলাম; কিন্তু আমরা তো আদিবাসীদের থেকেও অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের এগিয়ে আনতে সরকার কি শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা চালু করবে?’
রেজাউল আরো বলেন, ‘মৌলিক অধিকার কী জিনিস, নাগরিক অধিকার কী জিনিস তা আমরা এখনো বুঝতে শিখিনি। আমরা আমাদের নির্মম ইতিহাসের পেছনকার কথা এখনো জানতে পারিনি।’
রেজাউল এবার আমার করা কিছু প্রশ্নের উত্তর দিলেন।
প্রশ্ন : আপনার পিতা-মাতার নাম?
উত্তর : নজরুল ইসলাম। মোসাম্মৎ আলেয়া বেগম।
প্রশ্ন : আপনার পিতার জন্ম কোথায়?
উত্তর : এই ছিটমহলেই। যদ্দূর জেনেছি, পূর্বপুরুষ থেকেই আমরা এ এলাকায় বসবাস করছি।
প্রশ্ন : আপনারা ভাইবোন কতজন?
উত্তর : চার ভাই ও এক বোন। আমি সবার ছোট।
প্রশ্ন : পারিবারিক আয়ের উৎস?
উত্তর : একমাত্র কৃষি।
প্রশ্ন : পরিবারের অন্য সদস্যরা কে কী করেন?
উত্তর : বড় ভাই আতেকুল ইসলাম পাটগ্রাম কলেজে ডিগ্রিতে পড়েন। বাকি সবাই মোটেও লেখাপড়া করেননি। কৃষিকাজ করেন।
প্রশ্ন : আপনি লেখাপড়া কোথায় করেছেন?
উত্তর : প্রাইমারি—দহগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়, যা বেরুবাড়ী ছিটমহল চুক্তির পর ২০১১ সালে সরকারি হয়।
মাধ্যমিক—দহগ্রাম হাই স্কুল, যা ২০১১ সালের পর এমপিওভুক্ত হয়।
কলেজ—পাটগ্রাম আদর্শ কলেজ।
প্রশ্ন : আপনার তো কোনো জাতীয় পরিচয় ছিল না, তবে কীভাবে কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন?
উত্তর : নানাবাড়ি ছিটমহলের বাইরে পড়েছে। নিজের পরিচয় গোপন রেখে সেখানকার পরিচয়ে ভর্তি হয়েছি।
প্রশ্ন : কলেজে কীভাবে যাতায়াত করতেন?
উত্তর : সাইকেলে। বাড়ি থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে। প্রতিদিন ৪৪ কিলোমিটার যাতায়াত করতাম।
প্রশ্ন : উচ্চশিক্ষার প্রতি কীভাবে উৎসাহিত হলেন?
উত্তর : আমার পুরো জীবনটাই ভাগ্যের ওপর চলছে। বন্ধুদের সঙ্গে চলতে চলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা শুনেছি। বিশ্ববিদ্যালয় কী জিনিস, তা ভালোভাবে বুঝতাম না।
প্রশ্ন : তাহলে কী বুঝতেন?
উত্তর : বুঝতাম, এখানে এলে অনেক বড় হওয়া যায়।
প্রশ্ন : কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেন?
উত্তর : কলেজের সহপাঠীরা বলল, রংপুর যাবে। আমিও তাদের সঙ্গে ট্রেনে করে রংপুর গেলাম। তবে কোচিং কী জিনিস, ভালোভাবে বুঝতাম না। বন্ধুদের সঙ্গে আমিও কোচিংয়ে ভর্তি হলাম। তাদের সঙ্গে মেসে থাকতে শুরু করলাম।
প্রশ্ন : তার পর?
উত্তর : মাঝেমধ্যে বাড়ি গিয়ে চাল নিয়ে আসতাম। চাল বিক্রির টাকা দিয়েই খরচ বহন করতাম।
প্রশ্ন : আপনি কি প্রথমবারেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন?
উত্তর : না। প্রথমবারে কোথাও চান্স পাইনি।
প্রশ্ন : তার পর কী করলেন?
উত্তর : বাড়ি চলে গেছি। কোচিং থেকে যেসব কাগজপত্র-বই দিয়েছে, সেগুলোই বাসায় বসে পড়েছি। দ্বিতীয়বার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে ভর্তির সুযোগ পাই।
প্রশ্ন : আপনার জীবনের লক্ষ্য কী?
উত্তর : আমার জীবনের একটাই লক্ষ্য, বিসিএসে অ্যাডমিন ক্যাডার হওয়া।
প্রশ্ন : বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি আপনার দাবি কী?
উত্তর : উচ্চশিক্ষার জন্য সবাই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না। আর আমাদের মতো ছিটমহলের অধিবাসীদের ক্ষেত্রে যেখানে প্রাথমিক-মাধ্যমিক শিক্ষারই স্বাভাবিক বন্দোবস্ত নেই, সেখানে উচ্চশিক্ষা তো স্বপ্নের চেয়েও দুষ্কর কিছু। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত, ছিটমহলের অধিবাসীদের জন্য কোটাপদ্ধতি চালু করা। এতে কিছুটা হলেও শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে।
প্রশ্ন : আপনাদের এলাকায় শিক্ষার হার কেমন?
উত্তর : প্রায় সবাই অক্ষরজ্ঞানহীন। হয়তো বা ১০ শতাংশ লোক হতে পারে লিখতে-পড়তে জানে। আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আমিই একমাত্র। কলেজে পড়ে দুই থেকে তিনজন।
প্রশ্ন : আপনার এলাকার জনগণের উপার্জনের উৎস কী?
উত্তর : প্রধানত কৃষি। প্রচুর পরিমাণে ধান হয়। দোফসলি জমি। তিস্তা নদীর কারণে আমরা নীলফামারী জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন। এই নদীতে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যায়। সেখানে জেলেপল্লী আছে। আর ভারত থেকে চোরাপথে অনেকে গরু নিয়ে আসে। এটা বেশ লাভজনক ব্যবসা। পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে একটি গরু আনলে বাংলাদেশে তা ২০ হাজার টাকার ওপরে বিক্রি হয়।
প্রশ্ন : আপনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, এটা আপনার এলাকার লোকজন কীভাবে দেখছেন?
উত্তর : তাঁরা মনে করেন, আমি ঢাকা শহরে বড় কিছু হয়ে গেছি। সবাই মনে করেন, আমি ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে গেছি।
প্রশ্ন : লেখাপড়ার খরচ কীভাবে বহন করেন?
উত্তর : বাড়ি থেকে প্রতি মাসে টাকা পাঠায়।
প্রশ্ন : আপনারা কোন পথ দিয়ে যাতায়াত করেন?
উত্তর : তিনবিঘা করিডোরই একমাত্র পথ। ২০১১ সালের চুক্তির পর ছয় ঘণ্টা খোলা থাকত। এখন ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে।
প্রশ্ন : কারা এ করিডোর নিয়ন্ত্রণ করে?
উত্তর : মূলত বিএসএফ এটি নিয়ন্ত্রণ করে।
প্রশ্ন : আপনারা যখন করিডোর দিয়ে প্রবেশ করেন, তখন কি আপনাদের আলাদা কোনো আইডি কার্ড দেখাতে হয়?
উত্তর : না। তবে আগে বিএসএফ সদস্যদের বুঝিয়ে বলতে হতো। বিশেষ করে কলেজ থেকে ফিরতে দেরি হলে।
প্রশ্ন : ছিটমহলে থাকাকালীন আপনার অনুভূতি কী ছিল?
উত্তর : কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতাম না। মাঝেমধ্যে নিজেকে জিজ্ঞাসা করতাম, আমরা কী মানুষ। যদি মানুষ হই, তাহলে আমাদের কেন দেশ নেই? সরকার নেই? আমরা কেন ভোট দিতে পারছি না? আমাদেরকে কেন কেউ নাগরিক বলছে না? আমাদের কেন জাতীয় পরিচয়পত্র নেই? আমরা কেন বিদেশ যেতে পারছি না? ছিটমহলের কোনো অধিবাসী বিদেশ যেতে পারে না। কারণ, তাঁদের কোনো জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। দারিদ্র্য ছিটমহলের নিত্যদিনের সঙ্গী। গ্রামের বাইরে গেলেই দেখি, ভিন্ন রকম নাগরিক সুযোগ-সুবিধা। উন্নয়ন। আর দুই পা হেঁটে ছিটমহলে ঢুকলেই মনে হতো, আমি বন্য জাতীয় কিছু হয়ে গেছি।
প্রশ্ন : দহগ্রাম তো একটি ইউনিয়ন। আপনি কোন ওয়ার্ডের বাসিন্দা?
উত্তর : ৩ নম্বর।
প্রশ্ন : মোট জনসংখ্যা।
উত্তর : ২০১১ সালের শুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশি ছিটমহল অধিবাসীর সংখ্যা ৪০ হাজার, যার মধ্যে দহগ্রামে ৩০ হাজার। বর্তমানে তা বেড়ে ৩৫ হাজারের বেশি হবে। ৩৫ হাজার বর্গমাইলজুড়ে এ জনবসতি।
প্রশ্ন : এখন তো ছিটমহল বলতে যা ছিল তার ইতি ঘটল, এখন আপনার বক্তব্য কী?
উত্তর : আমরা দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। আমাদের সেখানে শিক্ষা-চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। কোনো হাসপাতালই নেই। সরকারকে খুব দ্রুত এসব অবকাঠামোগত নির্মাণকাজ শেষ করতে হবে। সব মৌলিক অধিকার ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
আমরা আদিবাসীদের চেয়েও কয়েক গুণ পিছিয়ে রয়েছি। তাই আমাদের এগিয়ে আনার জন্য উচ্চশিক্ষায় ভর্তির পাশাপাশি চাকরিতে কোটার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার সুযোগ পেলেন। এখন কেমন লাগছে?
উত্তর : এখন মনে হচ্ছে আমরা মানুষ। এতদিন জেলে ছিলাম। এখন মুক্তি পেয়েছি। আমাদের অভিভাবক রয়েছে।
প্রশ্ন : সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
উত্তর : আপনাকেও সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আপনারা আমাদের জন্য লিখে গোটা জাতিকে আমাদের দুর্বিষহ জীবনের কথা জানান। এতে আমরা উপকৃত হব।
সানাউল্লাহ মাহী : সাংবাদিক