প্রতিক্রিয়া
‘হামরা এই দ্যাশের নাগরিক’
রোগা শরীর। ক্ষীণ হয়ে এসেছে চোখের দৃষ্টি। সেই ছানিপড়া ঝাপসা চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন, ‘জীবনের বাকি দিন তো কবার পারমো, হামরা বাংলাদ্যাশের নাগরিক। হামার ছাওয়ার ঘর পরিচয় দিবার পাইরবে, হামরা এই দ্যাশের নাগরিক। এখন হামরা মরিও শান্তি পামো।’
ছিটমহলের নাগরিকত্বের দীর্ঘ বঞ্চনা সয়ে জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে শুক্রবার আঞ্চলিক ভাষায় এভাবেই কথাগুলো বলেন নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার জিগাবাড়ী ছিটমহলের বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন (৭০)। সারা জীবনের পুষে রাখা স্বপ্নপূরণের শেষ ধাপে এসে এখন আর যেন তর সইছে না। কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন, ‘হামরা মানুষে আছিনো না। হামার জন্ম-মৃত্যুর কোনো সরকারি হিসাব আছিল না। দুই দ্যাশের ছিটমহল বিনিময় হয়া হামরা একটা দ্যাশের নাগরিক হইনো। হামার জন্মের হিসাব না হইলেও অন্তত মরার হিসাবের খাতাত হামার নাম থাইকবে।’
দীর্ঘ লড়াই শেষে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ে নতুন করে আঁকা হলো সীমানারেখা। ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণে নতুন মানচিত্র পেল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দারা এখন বাংলাদেশের নাগরিক। ছিটমহল বিনিময়ে ঐতিহাসিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করল সারা বিশ্ব। প্রায় ছয় দশকের বঞ্চনার ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটল। মিলেছে মুক্তির লাল-সবুজের পতাকা। বাংলাদেশ ও ভারত দুই অংশেই বিলীন হয়ে গেল ছিটমহল নামের বন্দিশালাগুলো। মুক্তি মিলল এসব বন্দিশালায় দুঃসহ জীবন কাটানো প্রায় অর্ধলাখ মানুষের।
সদ্যবিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর বাসিন্দারা এই ৬৮টি মোমবাতিকে তাদের ৬৮ বছরের শোষণ-বঞ্চনার প্রতীক হিসেবে নিয়েছেন। তাঁরা মনে করছেন, এই মোমগুলো জ্বলে-পুড়ে শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হবে নাগরিকত্বহীন পরাধীন দিনযাপনের ৬৮ বছরের গ্লানি। সেই গ্লানি মুছে যাওয়ার আনন্দে আত্মহারা মানুষ মশাল মিছিল নিয়ে ঘুরেছেন পুরো ছিটমহল এলাকা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, চাপা স্বরে মেঘের মৃদু গর্জন, ভেজা হাওয়া—সবকিছু ছাপিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠল শতপ্রাণের আলোর মিছিল। কোনো কিছুই তাঁদের আটকে রাখতে পারেনি।
স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সময় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ছিটমহলের বাসিন্দারা। তাঁরা সমস্বরে গাইলেন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। উড়ল বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়ার পর পতাকার প্রতি সালাম দেওয়ার সময় অনেকে কেঁদে ফেলেছেন। এমন দৃশ্যের অবতারণা সত্যিই বিরল। শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে ছিটমহল বিনিময়ের মধ্য দিয়ে নতুন জীবনের অধ্যায় রচনা হয় এসব ছিটমহলবাসীর। রাজনীতির পাশা খেলায় যবনিকাপাত ঘটল। জয় হলো মানুষের। মুছে গেল রাষ্ট্রহীনতার কষ্ট। রাষ্ট্রহীন মানুষগুলো এখন পাবে আইডি কার্ড, জন্মনিবন্ধন সনদ। আনন্দের মধ্যেও বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্ত ছিটমহল থেকে যাঁরা ভারত চলে যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। মন খারাপ তাঁদের স্বজনদেরও। সর্বশেষ গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার সকালে সূর্য উদয়ের আগেই প্রতিটি ছিটমহলে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
ছিটমহল বিনিময়ের পর নতুন বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পাওয়া সদ্যবিলুপ্ত ছিটমহলের এসব অধিবাসী হাতে বাংলাদেশি জাতীয় পতাকা নিয়ে খণ্ড খণ্ড বিজয়-আনন্দ মিছিল করেন। অন্ধকার জীবনের দীর্ঘ কঠিন লড়াই শেষে প্রকৃত স্বাধীনতা পেয়েছেন তাঁরা। মূলত এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলেন তাঁরা।
লেখক : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।