অভিমত
রাজাকার, জেনোসাইড ও খান আতা সমার্থক নয়
খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব খান আতাউর রহমান বহুমুখী প্রতিভা দ্বারা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি ছিলেন একাধারে চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক, সংগীত পরিচালক, গীতিকার, সুরকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা, অভিনেতা, লেখক, সমালোচক এবং সাংবাদিক। সম্প্রতি খ্যাতনামা এই ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বরেণ্য সাংস্কৃতিককর্মী নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর ‘রাজাকার’ মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পুরোনো বিতর্ক নতুনভাবে আলোড়িত হচ্ছে। দীর্ঘ বিরতির পর খান আতা আলোচনায় ঠাঁই পেয়েছেন এবং পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরনের যুক্তি-তথ্য উপস্থাপিত হচ্ছে। অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক নয়।
ঐতিহাসিক সত্য এই যে, খান আতা মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেননি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন এবং তাঁর কিছুকাল পরে পর্যন্ত খান আতা মার্কসবাদী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বায়ান্নতে অনুষ্ঠিত বার্লিন ইয়ুথ র্যালিতে যোগ দিয়েছিলেন। ডিআইবির খাতায় একজন মার্কসবাদী হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত তাঁর সব কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের স্বাধীনতা অন্দোলনকে সমর্থন করে আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু ২৬ মার্চের পর তিনি তাঁর অবস্থান থেকে সরে আসেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি পাকিস্তান আর্মির তত্ত্বাবধানে টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করেন। ১৯৭১ সালের ১৭ মে বিবৃতি দেওয়া ৫৫ জন বৃদ্ধিজীবীর তালিকায় খান আতার নাম পাওয়া যায়। বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির তাঁকে একজন ‘বহুরূপী মানুষ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে ১৯৭৩ সালে যখন তিনি ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের ছবি ‘আবার তোরা মানুষ হ’ নির্মাণ করেন। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তুলে ধরে বিপথগামী মুক্তিযোদ্ধাদের সুপথে ফেরার আহ্বান জানানো হয়েছে। ছবিটি সেন্সরের সময় অভিযোগ উঠেছিল যে, খান আতা মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করার জন্য এ ছবি বানিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধারা কি অমানুষ যে তাদের নতুন করে মানুষ হতে হবে? ২০১৭ সালে এসেও নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু একই অভিযোগে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করে পরিচালককেই মানুষ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অবশ্য ১৯৭৩ সালে মুক্তির আগে ছবিটি এফডিসিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ডেকে ছবিটি দেখানো হয়েছিল। খান আতার সহকারী সি বি জামান দাবি করেন সেদিন কিন্তু কেউই খান আতার বিরুদ্ধে কথা বলেননি। এটা ঠিক যে, মুক্তিযুদ্ধে খান আতার ভূমিকা বিতর্কিত না হলে ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবিটি নিয়ে এত বিতর্ক সৃষ্টি হতো না।
মুক্তিযুদ্ধের মতো এতটা আবেগময়, এতটা স্পর্শকাতর বিষয় বাঙালির ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি নেই। দেশের অগ্রজ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং প্রগতিশীল মানুষ হয়েও খান আতা বাংলার আপামর জনতার দাবি উপেক্ষা করেছেন। যখন সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য খান আতাকে খুব বেশি প্রয়োজন ছিল, সে সময় তিনি পেছনে সরে গেছেন। কারণ হিসেবে তিনি মা-বোন, স্ত্রী ও সন্তান, ব্যক্তিগত অফিস, কর্মচারী সবার নিরাপত্তাহীনতা ও দায়িত্ববোধের কথা বলেছেন। জীবনের ভয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন। খান আতার মতো ব্যক্তিত্বের এমন অসহায় আত্মসমর্পণ সবার কাছে স্বার্থপরতার চূড়ান্ত নমুনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এর ফলে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের অর্জনগুলো ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে।
বাঙালির অভিধানে ‘রাজাকার’ একটি ঘৃণ্য শব্দ। যা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে হিংস্র বিভৎস কিছু মানুষের ছবি আমাদের মানসপটে ভেসে উঠে। সেই ছবির সঙ্গে খান আতার সাজুয্য কতখানি? খান আতা কি জেনোসাইডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন? সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে তিনি কি ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে চেয়েছিলেন? কেউ কি তাঁর আক্রোশের শিকার হয়েছে? তিনি কি লুটের সঙ্গে জড়িত ছিলেন? তিনি কি ধর্ষণে জড়িত ছিলেন? যদি না থাকেন তাহলে ঢালাওভাবে তাঁকে ‘রাজাকার’ বলায় অনেকের ঘোর আপত্তি রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি কয়েকটি শ্রেণিতে অবস্থান নিয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার, ভুক্তভোগী ও নিরাপদ সুবিধাভোগী। অনেকের মতো খান আতা নিরাপদ অবস্থানটিই বেছে নিয়েছিলেন। বন্দুকের নলের মুখে নেওয়া তাঁর সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল এবং এই ভুল শোধরাতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।
দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করা প্রসঙ্গে খান আতা জবাবদিহি করেছেন এভাবে- ‘মুক্তিযুদ্ধ চলছে। পাক সেনাদের হাতে অগণিত নিরীহ মানুষ এবং মুক্তিযোদ্ধারা মৃত্যুবরণ করছে, অগণিত মা-বোন ধর্ষিতা হচ্ছে আর মানবতার প্রতি এই নিষ্ঠুর অত্যাচারেও আমার পুরুষসিংহসত্তা হুংকার দিয়ে উঠছে না। আমি শুধু সংসারের নিরাপত্তার নিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছি। কারো কারো বিবেচনায় আমার ব্যবহার ক্ষমার অযোগ্য। যদিও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বকাল পর্যন্ত আমার যে কর্মকাণ্ড রেডিও এবং টেলিভিশনে, তার সবই ছিল বাংলাদেশকে স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করা। আজ দেশ ছেড়ে চলে না যাওয়ার অপরাধেই আমি কারো কারো চোখে হয়ে গেলাম অপরাধী।’
‘জীবন থেকে নেওয়া’ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত ‘আমার সোনার বাংলা’ ও ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ গান দুটির অর্কেস্ট্রেশন করেছিলেন খান আতা। চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব আমজাদ হোসেন জানান, ‘এখন আপনারা একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি শোনেন বা আমার সোনার বাংলা যে জাতীয় সঙ্গীত, এর অর্কেস্ট্রেশন করা খান আতউর রহমানের। আগে এই গানগুলোর কাঙ্গাল অবস্থা ছিল।’ মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসর্গ করে ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার স্বাধীনতা আনল যারা, তোমাদের এই ঋণ কোনো দিন শোধ হবে না’ গানটি খান আতার লেখা।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনে খান আতার অবদান খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। খান আতার ঘোরতর শত্রুও তাঁর শিল্প প্রতিভাকে সম্মান করে। ১৯৭১ সালে স্বধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধারা যেমন তাঁকে মারতে গিয়েছিলেন, তেমনি অনেক প্রথিতযশা মুক্তিযোদ্ধাই ছুটে এসেছিলেন এই গুণী শিল্পীকে বাঁচাতে। একজন ‘রাজাকারে’র প্রতি মুক্তিযোদ্ধার এমন সহানুভূতি থাকতে পারে না। খান আতাকে মূল্যায়ন করতে হলে ভুলের পাশাপাশি তাঁর অবদানকেও স্বীকৃতি দিতে হবে। চুলচেরা বিশ্লেষণে খান আতা ভীরুতার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন, কিন্তু ‘রাজাকার’ তিনি নন। বরেণ্য শিল্পীর সমালোচনায় পরিশীলিত সৌজন্যবোধ একান্তভাবে কাম্য।
লেখক : চলচ্চিত্র গবেষক